যেখানে ধান্দা নেই, সেখানে বিজেপিও নেই, এ একেবারে পরিষ্কার। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
প্রতিবার অমিত শাহ ঘুরে যাওয়ার পর তাঁর দেওয়া টার্গেটই চর্চার বিষয় হয়। কিন্তু এবার অমিতজির বেঁধে দেওয়া টার্গেট নয়, আলোচ্য বিষয় আরজি করের ঘটনার প্রতি তাঁর উদাসীনতা। অভয়ার জাস্টিসের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। তাই অনেকে ভেবেছিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় এসে আরজি কর-কাণ্ডের ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করবেন। দোষীদের চরম শাস্তির আশ্বাস তাঁর মুখ থেকে সবাই শুনতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে অভয়ার অভাগা বাবা-মা।
আরও পড়ুন-অনিশ্চিত স্টুয়ার্ট, উদ্বিগ্ন মোহনবাগান, কাল সামনে ওড়িশা
অপরাধীর সংখ্যা এক না একাধিক, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অভয়ার জাস্টিস পাওয়া নিয়ে দ্বিমত আগেও ছিল না, এখনও নেই। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন আপাতত কমিটি গঠন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হওয়ার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু অভয়ার বাবা-মায়ের একটাই লক্ষ্য, মেয়ের খুনি ও ধর্ষকের চরম শাস্তি নিশ্চিত করা। তাই সিবিআইয়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কলকাতায় আসছেন শুনেই তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অমিত শাহ তাঁদের আর্জি নাকচ করে দিয়েছেন। অথচ এই অমিতজিই পুরসভা নির্বাচনের আগে কর্মসূচি স্থগিত করে ছুটেছিলেন আত্মঘাতী বিজেপি কর্মীর কাশীপুরের বাড়িতে।
অভয়ার বাবা-মায়ের ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণ আরজি কর-কাণ্ড থেকে গেরুয়া শিবিরের ফায়দা নেই। আর যেখানে ধান্দা নেই, সেখানে বিজেপিও নেই।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলায় মা মাটি মানুষের সরকার বিরোধী কোনও ইস্যু পেলেই বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিন বছর ধরে বাংলায় ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। আবাস যোজনার টাকাও কেন্দ্র দিচ্ছে না। কেবল রাজ্যের প্রাপ্য আটকানোর ফন্দি আঁটছে। দফায় দফায় কেন্দ্রীয় টিম পাঠিয়ে রাজ্য সরকারকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। বাংলার গায়ে কালি লাগানোর কোনও সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। সন্দেশখালি ফ্লপ হওয়ার জ্বালা আর জি করের ঘটনায় মিটিয়ে নেওয়ার একটা জবরদস্ত সুযোগ ছিল। তাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগানোর জন্য অগ্নিমিত্রা পল ‘গোব্যাক’ স্লোগানের অপমান পর্যন্ত গায়ে মাখেননি। অমিত শাহের সঙ্গে অভয়ার বাবা-মায়ের সাক্ষাতের তদ্বির করেছিলেন অগ্নিমিত্রাই। কিন্তু অমিত শাহ সেই দাবিতে পাত্তাই দিলেন না।
আরও পড়ুন-যুবভারতীতে আজ ডার্বিতে মুখোমুখি ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান
অমিতজির এহেন আচরণ দেখে এখন বঙ্গ বিজেপির অনেকে বলছেন, বিষয়টি বিচারাধীন। তার উপর সিবিআই অভয়া খুনের তদন্ত করছে। তাই অমিত শাহ এবার দেখা করেননি। পরে তিনি অভয়ার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হল, বিচারাধীন বিষয়ে আলোচনায় আপত্তি থাকলে অগ্নিমিত্রা কেন অভয়ার বাবা-মায়ের সাক্ষাতের আর্জি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন? কেন অভয়ার বাবা-মায়ের মনে আশার আলো জ্বালিয়েও নামিয়ে আনলেন অমাবস্যার অন্ধকার?
আসলে অন্য কিছু করার ছিল না। সেটা বোঝা গেল বৃহস্পতিবার। আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের মামলার বিচার বাংলা থেকে সরানোর দাবি খারিজ। বিচার প্রক্রিয়া চলবে রাজ্যেই। বৃহস্পতিবার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। মামলাটি উঠতেই ভিনরাজ্যে বিচার প্রক্রিয়া সরানোর দাবি তোলেন এক আইনজীবী। পত্রপাঠ সেই আর্জি খারিজ করে দেন দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বলেন, ‘‘সোমবার ১১ নভেম্বর থেকে নিম্ন আদালতে বিচার শুরু হচ্ছে আরজি কর মামলার। নিম্ন আদালতের উপর আমাদের ভরসা রয়েছে।’’ এমনকী এদিন সিবিআইয়ের তদন্ত সংক্রান্ত স্টেটাস রিপোর্ট দেখেও সন্তোষ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তদন্ত চলবে। শুধু ধর্ষণ-খুন নয়, আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগেরও।
এক আইনজীবী তো এদিন আরও একধাপ এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিচারব্যবস্থা ও পুলিশের উপর ভরসা নেই বলেও অভিযোগ করেন। সেকথা শোনামাত্র কড়া ধমক দেন দেশের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, ‘‘কে বলেছে আপনাকে এসব কথা? ক্যান্টিনের গসিপ আদালতের অন্দরে নিয়ে আসবেন না। তাছাড়া বাংলার মানুষের হয়ে যে দাবি তুলছেন, কার আইনজীবী আপনি?’’ যদিও ওই আইনজীবী নিজের পরিচয় দেননি। ধমক খেয়ে অন্যদের ভিড়ে মিশে যান।
আরও পড়ুন-‘প্রতিটি মামলাই স্বতন্ত্র, শিখেছি এখানেই’ কাজের শেষদিনে আবেগপ্রবণ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়
সিবিআইয়ের তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে সওয়াল খাড়া করেন মামলার এক আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। তিনি বলেন, ‘‘৯৩ দিন হয়ে গেল। সিবিআই নতুন কিছু বলতে পারল না।’’ তখনই তাঁর কথা কেড়ে নিয়ে এক আইনজীবী রাজ্যের বাইরে মামলার বিচার প্রক্রিয়া সরানোর আবেদন করেন। তা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘চার্জশিট হয়ে গিয়েছে। চার্জ ফ্রেম হয়ে গিয়েছে। তাই নিম্ন আদালতেই বিচার চলবে। তাছাড়া ট্রায়াল কোর্টে জেলা বিচারকের কাছে যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। তিনি চাইলে তদন্তের নতুন নির্দেশও দিতে পারেন। আমরা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছি না।’’
যাঁরা এতদিন ধরে কাটা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন, মিথ্যে রটনাকে সত্যি বলে চালাতে চাইছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ করে এই পর্যবেক্ষণ জানাটা জরুরি।
এ তো গেল একটা দিক। অমিতের নীরবতার আর একটি দিকও আছে।
আরও পড়ুন-এবার যোগীরাজ্যে নয়া ফরমান মহিলাদের জন্য পুরুষ দর্জি নয়
কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে রাজ্যকে বঞ্চনা করছে সেই বিষয়ে প্রস্তাব আনা হবে ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হতে চলা বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার গত সাড়ে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কীভাবে বাংলাকে বঞ্চনা করছে, তার হিসাব তুলে ধরবেন রাজ্যের মন্ত্রী ও বিধায়করা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের তুলনায় নরেন্দ্র মোদির সরকার রাজ্যকে অনেক বেশি অর্থ দিয়েছে। শাহের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের জমানায় পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া হয়েছিল ২ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পশ্চিমবঙ্গকে দিয়েছে ৭ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। একেবারে ডাহা মিথ্যে। অমিত শাহ রাজ্যে বেশি সময় থাকলে তাঁর মুখেই জবাবটা দিতে পারত রাজ্য সরকার। তাতে আরও মুখ পুড়ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। সেই বিড়ম্বনা এড়াতেই মুখ লুকিয়ে পালিয়েছেন উনি।
এইসব ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন কারও ডাকের অপেক্ষা করেন না। আর একজন রাজনৈতিক ফায়দা না থাকলে সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কাতর বাবা-মায়ের আর্জিতেও মুখ ফিরিয়ে নিতে কুণ্ঠিত হন না। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তফাত এখানেই।