বড়দের মতো বড় হয়ে ওঠার ইচ্ছেটা শিশুদের চিরন্তন এক চাহিদা। যা রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই। ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’। এখানে শুধু বড় হয়ে ওঠার আকুতি নেই, রয়েছে সন্তানের তার মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ববোধ, ভালবাসা। কিন্তু মা সন্তানের মধ্যের এই অনুভূতি কি এ-যুগে সত্যি চোখে পড়ে? শিশু মনস্তত্ত্বের প্রথম ধাপই হল আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে শিশুটির মনোজগৎকে চেনার চেষ্টা করা। আধুনিক মায়েরা শিশুর মনোজগৎকে চেনার কতটা চেষ্টা করেন?
আগেকার দিনে সমাজ যখন একান্নবর্তী পরিবারে বিভক্ত ছিল তখন শুধু মা নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে শুরু করে নানা বয়সি ভাইবোনেরাও একে অপরকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করত। কিন্তু আজকের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বড় হয়ে ওঠা কচিকাঁচারা টুনটুনির গল্প’, ‘রামের সুমতি’কে অতীত করেছে। ব্যস্ত কেরিয়ারিস্ট মায়ের সঙ্গ-বঞ্চিত বেশিরভাগ শিশু ছোট্ট থেকে মোবাইল-নির্ভর ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর অযাচিত তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে দিনে দিন বয়সের তুলনায়, মনের তুলনায় পরিপক্ক হতে শুরু করেছে। এটাকেই কি ম্যাচিওরিটি বলে? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা!
আরও পড়ুন-আমার ছেলেবেলা
অনর্থক বোঝা তৈরি হচ্ছে শিশুমনে
পায়েল ঘোষ (পেরেন্টিং কনসালটেন্ট)
আসলে আজকের শিশুদের বিবর্তিত মনোজগতের জন্য অনেকংশেই দায়ী তার মা-বাবা। আগে ভাল রেজাল্ট করলে ছেলেমেয়ের কাছে মা-বাবার আদর-স্নেহ, প্রশংসাই বড় প্রাপ্তি ছিল। কিন্তু এ-যুগে সবটাই মেটিরিয়ালিস্টিক। এখন আদর আছে, স্নেহ আছে আবার তার সঙ্গে বস্তুও আছে। এ-যুগের মায়েদের সঙ্গে সন্তানের গিভ অ্যান্ড টেক রিলেশনটাই চোখে পড়ে। তুমি এটা কর তাহলে আমি তোমাকে এই প্রাইজটা দেব। পেতে পেতে তারা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে যে না শোনার অভ্যেসটা চলে যাচ্ছে।
আগেকার দিনে মায়েরা পরিবারের সব সমস্যা, জটিলতা থেকে সচেতনভাবেই সন্তানকে দূরে রাখতেন। কিন্তু এখন বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে বা পারিবারিক সমস্যার মধ্যে একটা পাঁচ-ছ’ বছরের শিশুও অবলীলাক্রমে ঢুকে পড়ছে। শুধু তাই নয়, তারা বাবা-মাকে এমন সাজেশন দিচ্ছে যা ওই বয়সে কল্পনাই করা যায় না। অনেক জটিলতার মধ্যে ঢুকে পড়ছে বলে শিশুর মস্তিষ্ক ভরে যাচ্ছে অনর্থক জাঙ্ক ফাইলে।
পাশাপাশি ইন্টারনেট-বহির্ভূত জীবন এবং ইন্টারনেট-সমেত জীবন এই দুইয়ের মধ্যে একটা বিরাট তফাত ঘটে গেছে। এখনকার বাচ্চাদের কাছে ইনফরমেশন প্রচুর। আগেকার বাচ্চাদের কাছে যেটুকু তথ্য ছিল তার বেশিটাই বইকেন্দ্রিক। বই পড়ে পাওয়া যা কিছু সবটাই নলেজ। কোন র ডেটা নয়। যে ডেটার বেশিরভাগেরই কোনও গভীরতা বা সত্যতা নেই। ফলে নলেজ তৈরি হচ্ছে না। এখনকার শিশুদের ছোট থেকেই কেরিয়ারগ্রাফ খুব স্পষ্ট। তারা জানে কী করতে চায়। এটা একটা ভাল বিষয় আবার একই সঙ্গে খুব আত্মকেন্দ্রিকও। এমপ্যাথি বিষয়টা কমছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাড়ছে ক্রাইম। যেমন, একদিকে কেরিয়ারিস্ট মন তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি একটা অন্ধকার মনও হচ্ছে। শিশুমনে সম্পর্ক নিয়ে, পরিবার নিয়ে গড়ে উঠছে অন্য ধারণা যা আপাত অর্থে ম্যাচিওরিটি মনে হলেও তা নয়।
আরও পড়ুন-অলিম্পিকে পদক আনবে জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা
আন্তর্জাল-নির্ভর হয়ে পড়ছে শিশুরা
প্রথমা গুহ (মনোবিদ)
আসলে একটা প্রজন্মের সঙ্গে আরেকটা প্রজন্মের সবসময়ই তফাত হয়, এটা নতুন কিছু নয়, এটা প্রকৃতির নিয়ম। শিশুদের মনোজগতের যে আমূল পরিবর্তন সেটা ইন্টারনেট বিপ্লবের কারণে এসছে বলতে পারি। কানেক্টিভিটি বেড়ে গেছে, সবার সঙ্গে সবার সংযোগ স্থাপন হচ্ছে, গোটা পৃথিবীর সঙ্গে মুহুর্মুহু যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে, এর ভাল দিক যেমন আছে তেমন খারাপ দিকও রয়েছে। আন্তর্জালের ওপর খুব ছোটবেলা থেকে খুব বেশি নির্ভরশীল হওয়ার ফলে অ্যাডিকশন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যন্য নেশার চেয়েও বড় নেশা হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জালের নেশা। আর পরিবারে বাবারা চিরকালই ব্যস্ত থাকতেন, এখন মায়েরাও চাকরিজীবী ফলে শিশুদের সঙ্গী একমাত্র মোবাইল ফোন। এমনটা নয় যে শিশুদের ফোনের নেশার জন্য প্রত্যক্ষভাবে বাবা-মা দায়ী তবে পরিস্থিতির শিকার তো বটেই।
যদি বুদ্ধির দিক থেকে ম্যাচিওরিটির কথা বলি তাহলে বলব প্রত্যেক প্রজন্মেই মানুষ কিন্তু আগের তুলনায় আর একটু বেশি তথ্য-সংবলিত হয় ফলে তাদের আর-একটু করে বুদ্ধি বাড়ে। শিশুরা তার ব্যতিক্রম নয়। তবে যদি শৈশবের সারল্যের নিরিখে ভাবি তাহলে সেটা কিন্তু অনেকটাই চলে গেছে। এরও বড় কারণ বাবা-মায়েদের মধ্যে ভারসাম্যের অভাব। এখন তারা আবেগের বশে ছোটদের সামনেই নিজেদের সবকিছু শেয়ার করেন ফেলেন। আলোচনা করেন, সমালোচনাও করেন। ফলে অনেক অনর্থক বস্তু শিশুর মস্তিষ্কে জমতে থাকে এবং বয়সের তুলনায় ম্যাচিওর যত না হয়, ততটাই পাকা হয়ে ওঠে। শিশুদের মধ্যে সহজ, স্বাভাবিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। তাই বলে ভালটাকেও অস্বীকার করা যায় না। এই জেনারেশন অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ। ফলে কেরিয়ার তৈরিতে ছোট থেকেই ফোকাসড। অনেক কিছুই তাদের বলে দিতে হয় না।
আরও পড়ুন-তিলক-সঞ্জুতে ভারতের সিরিজ
নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ম্যাচিওরিটি নেই
রিমা মুখোপাধ্যায় (মনোবিদ)
ডিজিটালাইজেশনের যুগে, ইন্টারনেটের যুগে অনেক ছোট বয়স থেকে শিশুরা অনেক কিছু জানতে পারছে, ভিজুয়াল ফর্মে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে। অল্প বয়সে ওরা অনেক বেশি এক্সপোজড হচ্ছে। যেটা আমাদের ক্ষেত্রে ভাসা-ভাসা ছিল সেটা ওদের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। ফলে এ-যুগের শিশুরা অনেক বেশি কৌতূহলী, যুক্তিবাদী। সবকিছুতে ওদের প্রশ্ন থাকে। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা মনে করি ওরা বুঝি খুব পরিণত এবং বুদ্ধিমান কিন্তু আসলে তা নয়। আসলে তখন আমরা নিজেদের প্রেক্ষিতে তুলনা করি যে ওই বয়সে আমরা কী ছিলাম। তার মানেই সেটা ম্যাচিওরিটি নয়। বরং এ-যুগের শিশুরা নিউক্লিয়ার পরিবারে বড় হয়। যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা ওভার প্রোটেক্টিভ। নিজেরা ব্যস্ত থাকেন বলে সন্তানকে সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক ভুলভাল আবদার বা চাহিদা মেনে নেন। ফলে শিশুটির মনে ‘যা চাইব তা আমায় পেতে হবে’ এই ধারণার সৃষ্টি হয়। তার মনোজগতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আগে বাড়ির সবচেয়ে বড় বাচ্চাটি বাড়ির সবচেয়ে ছোট শিশুটির দেখভাল করত। ছ’বছরের দিদিকে দু’বছরের ভাইয়ের দায়িত্ব নিশ্চিন্তে তুলে দিতেন মা। এখনকার বাচ্চারা তা ভাবতেও পারবে না। বিবর্তন অবশ্যই হয়েছে শিশুর মনোজগতে তবে তার বেশিটাই ইনফরমেশন বা তথ্যভিত্তিক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ম্যাচিওরিটি এই যুগের শিশুর নেই।
আরও পড়ুন-আমার ছেলেবেলা
পরিশেষে বলা যায় আসলে শিশুর মনোজগৎ এবং বড়দের জগতের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী চিন্তার প্রাচীর রয়েছে। সেই প্রাচীর ভাঙার কাজ শিশুর নয়, বড়দেরই। অতিরিক্ত পরিপক্বতা সব-সময়েই যে খারাপ এমন নয়। অতিরিক্ত পূর্ণতা শিশুকে বহু বিপদ সম্পর্কে আগাম সতর্ক করে দেয়। কিন্তু এর খারাপ দিকও রয়েছে। এই জগৎ অনেক সময়েই তাকে অজানাকে জানতে ও অচেনাকে চিনতে এত বেশি উদগ্রীব করে তোলে যে তার টানে সে দিশাহারা হয়ে পড়ে। তারই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করে বিপদ। আবার পারিবারিক জীবনে বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তির মতো ঘটনা একটি শিশুর উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শিশুদের পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরির জন্য ধাপে ধাপে তার মনস্তত্ত্বকে বিকশিত করতে দিতে হবে এবং সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিতে হবে একজন মাকেই।