বিদায় মনোজ মিত্র

চলে গেলেন মনোজ মিত্র। তিনি ছিলেন অধ্যাপক, নাট্যকার, নির্দেশক এবং অভিনেতা। সামলেছেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতির দায়িত্ব। চলে গেলেন। তবে থেকে যাবে তাঁর নাটক। যুগের পর যুগ। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

হারাধনের চরিত্রে মঞ্চে প্রথমবার
অদ্ভুত এক গ্রাম। কাঁচা-পাকা ছোট ছোট বাড়ি। চারদিকে গাছপালা। গাছে গাছে ফুটে থাকত আনন্দ। সমস্যা ছিল। তবে গায়ে মাখতেন না কেউই। গ্রামে ছিল থিয়েটারের চল। গ্রামের লোকেরাই অভিনয় করতেন। মেয়েদের ভূমিকায় দেখা যেত ছেলেদের। নাটক দেখার জন্য ভিড় জমত। কম বয়সে সেই ভিড়ে মিশে থাকতেন মনোজ মিত্র। তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার ওই গ্রামেরই সন্তান। কোনও এক বছর বিজয়া সম্মিলনীতে ঠিক হল রবীন্দ্রনাথের ‘রোগের চিকিৎসা’ নাটিকাটি মঞ্চস্থ হবে। হারাধনের চরিত্রে প্রথমবার মঞ্চে পা রাখেন মনোজ। ঠিক ছিল, তুলো দিয়ে তৈরি করা হবে হাঁস। নাটকের দৃশ্যে পেটে খোঁচা মারলে পরিচালক হাঁসের আওয়াজ করবেন। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে বিকেল থেকে একটা জ্যান্ত হাঁস পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন মনোজ। সেই দৃশ্যে পেটে খোঁচা পড়তেই জ্যান্ত হাঁস জোরে ডেকে ওঠে। বেরোয় পেট থেকে। ফলে থিয়েটার গেল জমে। তবে হাঁসের নখের আঁচড়ে মনোজের পেট গেল চিরে। রক্তারক্তি কাণ্ড! প্রথম অভিনয়ের স্মৃতি কোনওদিন ভোলেননি। পরবর্তী সময়ে নাটকই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান, প্রধান অবলম্বন।

আরও পড়ুন-মায়েদের ছোটরা

দেশভাগের পর স্কুলজীবন শুরু
বাবা চাইতেন না যে ছেলে থিয়েটার করুক। তবে ছকে বাঁধা জীবনকে কখনই আমল দেননি মনোজ মিত্র। নাটক তাঁকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে। প্রথম দিকে বাড়িতেই পড়াশুনা করতেন। কারণ বাবার বদলির চাকরি। দেশভাগের পর শুরু হয় তাঁর স্কুলজীবন। বসিরহাটের কাছে ডান্ডিরহাট এনকেইউএস নিকেতনে। পরে দর্শনে অনার্স-সহ স্কটিশচার্চ কলেজে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ। ডক্টরেটের জন্য শুরু করেন গবেষণা। ততদিনে জন্ম হয়েছে ‘সুন্দরম’ নাট্যগোষ্ঠীর। বন্ধু পার্থপ্রতিম চৌধুরীর উৎসাহে দলের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন মনোজ মিত্র। মঞ্চস্থ করেছেন নাটক। পড়াশোনার শেষে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগে যোগদান। বিভাগীয় প্রধান হন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন।
মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র
নাটক লিখতেন মনোজ মিত্র। প্রযোজনা ও পরিচালনা করতেন। করতেন অভিনয়ও। মূলত মঞ্চে। ‘সাজানো বাগান’, ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’, ‘কালবিহঙ্গ’, ‘পরবাস’, ‘নরক গুলজার’, ‘চকভাঙ্গা মধু’, ‘নৈশভোজ’ তাঁর কালজয়ী নাটক। অভিনয় করেছেন টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রেও। তপন সিংহ পরিচালিত ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ তাঁর অভিনীত অন্যতম সেরা ছবি। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’, প্রভাত রায়ের ‘লাঠি’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শক-মনে রেখাপাত করেছে। এ ছাড়াও বহু বাণিজ্যিক ছবিতে দেখা গেছে তাঁকে। নানান চরিত্রে। ১৯৩৮-এর ২২ ডিসেম্বর জন্ম। ২০২৪-এর ১২ নভেম্বর, ৮৬ বছর বয়সে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। মনোজ মিত্রের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগৎ।

আরও পড়ুন-আমার ছেলেবেলা

অসম্ভব সেন্স অফ হিউমার ছিল
স্মৃতিচারণ করলেন নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ। তিনি বললেন, ‘মনোজ মিত্রের নাটক দেখতে শুরু করেছি থিয়েটার আসার আগেই। থিয়েটারে আসার পরেও তাঁর কাজ দেখেছি। মুগ্ধ হয়েছি। ২০১১ সালে মনোজদা পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতি হন। তখন আমি নাট্য আকাদেমির মেম্বার হিসেবে ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি সভাপতি, তবে কোনও কিছুই আমাদের উপর চাপিয়ে দিতেন না। আলাপ-আলোচনা করতেন। দেখে অবাক হতাম। এত সিনিয়র মানুষ। যে কোনও বিষয়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সেটা না করে সবসময় একটা আলোচনার জায়গা রাখতেন। জুনিয়রদের দেখতেন গুরুত্ব সহকারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অসম্ভব সেন্স অফ হিউমার ছিল মনোজদার। মিটিং চলাকালীন গম্ভীর মুখে মজার মজার কথা বলতেন। শিশু কিশোর আকাদেমি থেকে আমরা ওঁর বই প্রকাশ করেছি। একটা সময়ের পর নাটক করা কমিয়ে দিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই কারণেই সরে এসেছিলেন নাট্য আকাদেমির দায়িত্ব থেকে। অবশেষে চলেই গেলেন। আমার মনে হয় মনোজ মিত্র তাঁর নাটকের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকবেন। যে নাটকগুলো লিখেছেন, তার মধ্যে নিজের জীবনদর্শন, সূক্ষ্মতা রেখে গেছেন। আগামী প্রজন্মের দায় আছে সেগুলো চিহ্নিত করবার। যে কাজ তিনি করে গেলেন, তার জন্য বাংলা থিয়েটার তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ থাকবে বলে আমার মনে হয়।’
নাটকের নানান পরিধিতে কাজ
কথা হল অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘মনোজ মিত্র নাটকের নানান পরিধিতে কাজ করেছেন। তাঁর অভিনয় করার কথা ছিল দুটো বিশেষ নাটকে। কিন্তু সময়ের অভাবে করতে পারেননি। সেই দুটো চরিত্রে আমি অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমার কাছে বিরাট সম্মানের। তখন মনোজদার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি। শিখেছি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দিয়েছেন কোথায় কী করতে হবে। তাঁর মতো প্রয়োজনীয় এবং উপকারী নাট্যকার আমাদের দেশে আর আসেননি। পাড়ার পুজো প্যান্ডেল, অফিস ক্লাবের নাটক যেমন লিখেছেন, তেমন লিখেছেন গ্রুপ থিয়েটারের সিরিয়াস নাটক, দম-ফাটানো হাসির নাটক। সবমিলিয়ে তিনি একজন সফল নাট্যকার। যুগের পর যুগ তাঁর নাটক অভিনীত হতে থাকবে। এইভাবেই তিনি থেকে যাবেন আমাদের মধ্যে।’

Latest article