আমরা তো আর বুড়ো নই

শৈশব, কৈশোর, যৌবন আবার শৈশব। বৃত্তটা পূর্ণ হল। প্রথম শৈশব থেকে দ্বিতীয় শৈশব— ফাঁক অনেকটা। সময়ের। বয়সের। ভাবনার। দেশে দেশে দ্বিতীয় শৈশবের ভাবনা বদলেছে। বিজ্ঞানীরাও দ্বিতীয় শৈশবের অন্য ছবি তুলে ধরছেন। সেখানে অবহেলা নেই, অভিমান নেই, শুধু আছে স্বপ্ন। এ পৃথিবীতে আর কেউ বুড়ো হবে না। আসবে না দ্বিতীয় শৈশব। এই দ্বিতীয় শৈশবের নতুন করে স্বপ্ন দেখলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

কেন চেয়ে আছো গো মা
ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজছে। বিকেল তখন ৪টে। পশ্চিম আকাশে হেলে আছে সূর্য। আলো এবং তাপের তীব্রতা কমছে। অ্যালার্মের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে পড়লেন সত্তরোর্ধ্ব শমীকবাবু। বাবিনকে নিয়ে পার্কে যেতে হবে। ৭ বছরের বাবিন সকালে বায়না ধরেছে দাদাভাইয়ের সঙ্গে পার্কে যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। দাদাভাইকে নিয়ে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দু-মিনিটেই পৌঁছে গেল বাড়ির সামনের পার্কে। তারপর দু’জনের সে কী খেলা! বোঝার উপায় নেই যে কে বড় আর কে ছোট! এ যেন দুই শৈশবের অন্য ক্যানভাস। জীবনের রঙে ভরপুর। সন্ধে নামার আগেই বাড়ি ফিরে বউমার কাছে বকুনি। দু’জনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। অবুঝ দুই শৈশব। এক শৈশবের বুকে অভিমানের পাহাড় আর অন্য শৈশবের বুকে আশকারা। সন্ধ্যার পরে শমীকবাবু তাঁর ঘরের জানলায় একা বসে আছেন। আর জানলা দিয়ে শুকতারা দেখা যাচ্ছে। আর অন্য আকাশে একফালি চাঁদও উঁকি মারছে। শমীকবাবু চা হাতে তাকিয়ে আছেন ওই আকাশের শুকতারার দিকে। ঘরের ভিতরে পুরনো ট্রানজিস্টরে বাজছে, ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’। দু-চোখে জলের বারিধারা। দ্বিতীয় শৈশবে এসে আরও অবুঝ আর অভিমানী হয়ে আছেন শমীকবাবু।

আরও পড়ুন-বিদায় মনোজ মিত্র

মনে পড়ে সেই
শমীকবাবুর গল্পটা ব্যতিক্রম নয়। বার্ধক্য এলেই শুরু হয় দ্বিতীয় শৈশব। উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর সেভেন এজ্ কবিতায় এই দ্বিতীয় শৈশবের ছবি এঁকেছেন। দেখিয়েছেন এই দ্বিতীয় শৈশবেও প্রয়োজন মনোযোগের, প্রয়োজন যত্ন নেওয়ার, প্রয়োজন ভালবাসার। বার্ধক্যে এসেই তারা শিশুর মতো আচরণ করতে শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আশঙ্কা করেন যে তাঁদের জ্ঞান কমছে। তাঁরা ভরসা হারান স্মৃতিশক্তির উপর। যুক্তির উপর। বিচারের উপর। ডেমনশিয়া বা অ্যালঝাইমারের মতো অবস্থাগুলো তাঁদের ডিপ্রেশনের দিকে নিয়ে যায়।
মানসিক ভাবে প্রবীণ বয়স্ক দ্বিতীয় শৈশবের ব্যক্তিরা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নিজেকে দুর্বল ভাবতে শুরু করেন। তাঁদের আবেগের সঙ্গে মোকাবিলার উপায় হিসেবে শিশুর মতো পরিবারের থেকে যত্ন, আশা করতে থাকেন। সামাজিক গতিশীলতায় তাঁরা নাতি-নাতনিদের সঙ্গেও যুক্তিহীন ব্যবহার করতে থাকেন। শরীরের সক্ষমতা কমার কারণে অন্যের প্রতি তাঁর নির্ভরতা বাড়ে। এই নির্ভরতা এমন আচরণের দিকে নিয়ে যায় যেন মনে হয় নতুন করে আবার শৈশব শুরু হল। তাঁদের সরলতার মধ্যে শিশুদের মতো আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। কখনও কখনও এই দ্বিতীয় শৈশবে এসে তাঁরা প্রথম শৈশবের কথা ভাবতে থাকেন। এইসব মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক মন্ত্রে বুড়োরাও শিশুর মতো আচরণ করতে থাকেন।
দ্বিতীয় শৈশব— সুখানি চঃ দুখানি চঃ
পরিবারের বৃদ্ধ মানুষগুলো বটবৃক্ষের মতো। বিশাল এ-বৃক্ষ তাঁর নিখাদ ভালবাসার ছায়ায় পরিবারকে ঘিরে রাখে গভীর মমতায়। পরিবারের জন্য কিছু করার ক্ষমতা তাঁদের না থাকলেও কুঁচকে যাওয়া চামড়ার দু’খানা হাত আছে যা বারংবার মুষ্টিবদ্ধ হয় পরিবারের সবার কল্যাণ কামনায়। তাঁদের এই প্রার্থনায় থাকে না কোনও লৌকিকতা ও স্বার্থের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া। জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করার মতো যখন আর কেউ থাকে না তখন বোঝা যায় সেই দু’খানা হাতের মর্ম! মানুষের জীবনটা একটি বৃত্তাকার চক্রের মতো! শৈশবের বিন্দু থেকে শুরু হয়ে বয়সের কম্পাসটা কৈশোর ও যৌবনের গণ্ডি পেরিয়ে আবারও দ্বিতীয় শৈশব তথা বার্ধক্যের বিন্দুতে এসে মিলিত হয়।

আরও পড়ুন-তিলক-সঞ্জুতে ভারতের সিরিজ

বার্ধক্যকে ‘দ্বিতীয় শৈশব’ বলা মোটেও ভুল বা অপরাধ নয়। একজন শিশু যেমন শৈশবে পরিবারের সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল ও কর্মক্ষমহীন একজন সদস্য মাত্র, পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকা নির্ভর করে অন্যের দয়া-ভালবাসা ও সহযোগিতার উপর, দ্বিতীয় শৈশবের বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই। অনাকাঙ্ক্ষিত বায়না, অযাচিত বাক্যের ব্যবহার, অভিযোগ— ভুল ধরা ও ভুল বোঝার প্রবণতা বৃদ্ধি, কৌতূহলী মনোভাব, কথা না শোনা বা না বোঝার প্রবণতা, অহেতুক রাগ ও অভিমান, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে নাক গলানো, ধারাবাহিক অসুস্থতা, নানারকম জিনিসের বায়না, হাজারো শিশুসুলভ আচরণ একজন মানুষের দ্বিতীয় শৈশবে আবারও ফিরে আসে। শিশুদের ভুল কথাগুলো শুনে আমরা হেসে ফেলি বা আদর করে শুধরিয়ে দিই, তাদের কৌতূহলী মনের পিপাসা মেটাতে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিই কোনওপ্রকার বিরক্তি ছাড়াই, অনর্থক রাগ ভাঙাতে চেষ্টা করি, সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তাদের আবদার পূরণ করতে চেষ্টা করি, তাদের অসুস্থতায় উৎকণ্ঠিত হই বা রাত জেগে সেবা করি হাসিমুখে। কিন্তু দ্বিতীয় শৈশবের মানুষগুলোর প্রতি আমরা বড়ই নির্মম! বৃদ্ধ মানুষগুলোর কিছু আচরণ মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন! কিন্তু একবার ভাবুন আমাদের প্রথম শৈশবে আমাদের বিরক্তিকর আচরণগুলো তাঁরা হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন, আমাদের জীবনের সবচেয়ে অসহায়ত্বের সময়ে তাঁরা যৌবনের সবটুকু শক্তি ও পরম ভালবাসা দিয়ে আমাদের বাহুডোরে আগলে রেখেছিলেন, এখন তাঁদের অসহায়ত্বের সময়ে যদি আমরা পিছপা হই তবে আমাদের মনে রাখা উচিত বয়সের কম্পাসটা বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় শৈশবে এলেই আমরাও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একই প্রতিদান পাব! সমাজে এমন প্রতিদানের সাক্ষী থাকবে! এই দ্বিতীয় শৈশব নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবনা রয়েছে। যেমন ঠিক শৈশব কী এটা নিয়েও মনোবিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত তাঁরা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শৈশবকে বিভিন্নভাবে দেখেছেন।

অ্যারিসের এবং ডনজেল্ট-এর প্রথম শৈশব বনাম দ্বিতীয় শৈশব
ফিলিপ অ্যারিস (১৯৬২) বিখ্যাতভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে মধ্যযুগীয় ইউরোপে শৈশব বিদ্যমান ছিল না। অ্যারিস যুক্তি দিয়েছিলেন যে পুরনো সময়ের শিশুরা আসলে ছোট প্রাপ্তবয়স্ক ছিল। যত তাড়াতাড়ি তারা শারীরিকভাবে স্বাধীন ছিল, শিশুরা পোশাক পরে, অভিনয় করে, কাজ করত এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই আচরণ করত। অ্যারিসের মতে, শিল্প বিপ্লবের প্রথম দিকে শ্রমজীবী শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে কারখানা ও খনিতে কাজ করত। শৈশবকাল যেমনটি আমরা জানি আজ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছিল। ১৬ শতকের শুরুতে উচ্চ-শ্রেণির শিশুরা স্কুল শুরু করলে, ১৯ শতকের আগে পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠেনি। এই সময়ে কারখানা এবং খনিগুলিতে শিশুদের নিয়োগ করাও আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। একটি অনন্য জীবন পর্যায়ের এই উত্থানের কারণে, মানুষকে এটিকে কীভাবে নেভিগেট করতে হয় তা শিখতে হয়েছিল। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ এবং শিশুমনোবিজ্ঞানীদের মতো দক্ষতার একটি বড় পরিসর গড়ে উঠতে শুরু করে। জ্যাক্স ডনজেলট (১৯৭৭)-এর মত, এটি কেবলমাত্র সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আরেকটি রূপ, যার মাধ্যমে পরিবারের নিয়ম, মূল্যবোধ এবং আচরণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা নজরদারি করা হয় যাতে সামাজিক শৃঙ্খলার একটি নির্দিষ্ট রূপ বজায় থাকে। অনেক পণ্ডিত এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন বরং যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই দক্ষতার সৃষ্টি মূলত এই ধারণাটিকে দৃঢ় করেছে যে শিশুদের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের নির্দেশনা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-মধ্যরাতে বিধ্বংসী আগুন নিমতলা ঘাট সংলগ্ন এক কাঠগোলায়

নীল পোস্টম্যানের দুই শৈশব
নীল পোস্টম্যান (১৯৮৩) বিশ্বাস করেন যে শৈশব, যেমনটি আমরা আজ জানি, আর বেশিদিন থাকবে না। তিনি বলেছেন যে টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া-সহ গণমাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার— সবই অল্পবয়সি শিশুদের এমন বিষয়বস্তুতে ব্যবহার করে যা মানুষ আগে শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় ব্যবহার করত। এর উদাহরণ সহিংসতা বা পর্নোগ্রাফি হতে পারে। পোস্টম্যান আরও বিশ্বাস করেন যে এর ফলে শৈশব এবং যৌবনের মধ্যে সীমানা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেক সমাজবিজ্ঞানী পোস্টম্যানের তত্ত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি দেন। তাঁরা বলেন যে, শৈশব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে না, তবে কেবল পরিবর্তন হচ্ছে এবং শিশুরা ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে আরও জটিল হয়ে উঠছে মিডিয়া কিছু উপায়ে স্বাধীনতা চাওয়া, কিন্তু এখনও অন্যান্য উপায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের উপর নির্ভরশীল।
দ্বিতীয় শৈশবে বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতির সঙ্গে অনেকে শৈশবের ক্রেস সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেন। অনেকে গোলান ভাষার ভিত্তিতে। শৈশব এবং দ্বিতীয় শৈশবে অনেকে ভাষার সূচকে গুরুত্ব দেন। জার্মান বাবা মা-রা তাঁদের সন্তানদের চাহিদা এবং ইচ্ছার দিকে মন দেন। একই ভাবে সন্তানরা স্বাবলম্বী হয়ে বার্ধক্যের বাবা-মায়েদের চাহিদা এবং ইচ্ছাগুলোকে গুরুত্ব দেন। এখানে প্রথম শৈশব আর দ্বিতীয় শৈশব ভাইসভারসা আফ্রিকার কেমুরুনের অভিভাবকেরা শিশুদের সামাজিক ও ইন্টারেক্টিভ দিকগুলিকে বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে বাবা-মায়েদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অভিভাবকরা দ্বিতীয় শৈশবে পৌঁছলেও তাঁদের বন্ধুই মনে করা হয়। গ্রামীণ বলিভিয়ায় সামান্থা পাঞ্চ গবেষণা করে দেখিয়েছেন এই দুই শৈশবের সবচেয়ে বড় মিল হল কাজ থেকে অব্যাহতি। কিন্তু দক্ষিণ বলিভিয়ায় শিশুরা পারিবারিক আয়ে যেমন অবদান রাখে তেমনি দ্বিতীয় শৈশবের শিশুরাও পারিবারিক আয়ে তাদের অবদান রাখে। বলিভিয়ার সঙ্গে অবশ্য ইউরোপের দেশগুলোর পার্থক্য আছে। ইংল্যান্ডে শৈশবে অর্থ উপার্জনের অনুমতি দেয় না। কিন্তু দ্বিতীয় শৈশবের অর্থ উপার্জনের কোনও বাধা নেই।

আরও পড়ুন-পাহাড়ে ৪টি স্কিল সেন্টার, শিলিগুড়িতে ফ্যাশন ইনস্টিটিউট: ট্রেনিং-কর্মসংস্থানের বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী

বয়স একটা সংখ্যা মাত্র
বার্ধক্যকে পরাজিত করা যেতে পারে এমন প্রতিশ্রুতি শতাব্দীরও পুরনো। অনেক জৈবিক পদ্ধতি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই প্রচার চালাচ্ছে। আমাদের দেহের বয়স হয় কারণ আমাদের কোষগুলি বুড়ো হয় এবং আমাদের কোষের বয়স হয় কারণ জেনেটিক স্তরে কিছু ভুল হয়ে গেছে। বার্ধক্য সময়ের রহস্যের মধ্যে গেঁথে আছে। সেই রহস্যের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানুষের বার্ধক্য এলে বোঝা যাবে না।
মানুষ যখন বার্ধক্যের কথা চিন্তা করে, তখন তারা সময়ের ব্যবধানকে দায়ী করে— বছর গড়িয়ে যায় এবং শরীর বছরের পর বছর তরুণ দেখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু যে কোষগুলি শরীর তৈরি করে তারা কেবল বর্তমানের মধ্যেই বাস করে। এখন একমাত্র অবস্থান যা নিরবধি। স্মৃতি যেমন একটি রহস্য রয়ে গেছে। মস্তিষ্কের কোষগুলি একটি ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল কার্যকলাপের মাধ্যমে কাজ করে যা তাৎক্ষণিকভাবে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া বা বৈদ্যুতিক আবেগ ঘটাতে সক্ষম হয়।
ডেভিড সিনক্লেয়ার : আর বুড়ো নই
দ্বিতীয় শৈশব নিয়ে সবচেয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন জেনেটিক বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার। তিনি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব— দীর্ঘ এবং সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন শুধু কিছু সহজ অভ্যাস। ড. সিনক্লেয়ার বিশ্বাস করেন, এমন দিন খুব দূরে নেই যখন ওষুধের সাহায্যে বার্ধক্য সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এসব ওষুধ এখন পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে এবং এই ওষুধগুলো দিয়ে বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া আসলেই আটকে রাখা যাবে। বিজ্ঞানী ড. ডেভিড সিনক্লেয়ার অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করে পরবর্তীতে গবেষণা করেছেন আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে। বর্তমানে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একটি ল্যাবরেটরির প্রধান, যেখানে তাঁর গবেষণার বিষয়— ‘কেন আমরা বুড়ো হই’। মেরিল লিঞ্চ ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী বার্ধক্য-সংক্রান্ত কাজে বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২৫ সালে গিয়ে পৌঁছবে ৬০ হাজার কোটি বা ৬০০ বিলিয়ন ডলারে। সিনক্লেয়ারের লেখা— ‘লাইফস্প্যান-হোয়াই উই এজ-অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু’ (কেন আমরা বৃদ্ধ হই-আর কেন আমরা বৃদ্ধ হব না) এই বইয়ে তিনি প্রচলিত বিশ্বাস ভাঙার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন— কেন বার্ধক্য একটা অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া নয়। ড. সিনক্লেয়ার বিশ্বাস করেন বৃদ্ধ হওয়া নিয়ে যেভাবে আমরা ভাবি, সে ভাবনাতে আমাদের আমূল পরিবর্তন করতে হবে : আমাদের ভাবতে হবে বার্ধক্য বা দ্বিতীয় শৈশব একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, আমাদের এটাকে একটা ‘অসুখ’ হিসাবে দেখতে হবে— অর্থাৎ রোগ হিসাবে এর চিকিৎসা সম্ভব এবং এর নিরাময়ও সম্ভব। বৃদ্ধ বয়স নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা একেবারে পাল্টে ফেলতে পারি, তাহলে মানবজাতির আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি হয়েছে তার ফলে আমাদের আয়ু আরও বছর দুয়েক হয়ত বাড়ানো যাবে : ‘আমাদের লক্ষ্য সেটা আরও অনেক বাড়ানো।’

আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে হাসপাতালে অভিনব ঠগবাজির শিকার গ্রামের অজ্ঞমানুষ

এপিজিনোম : স্বপ্নের জাদুকাঠি
ড. সিনক্লেয়ার দেখিয়েছেন আমাদের শরীরের দুই ধরনের তথ্য মজুত থাকে— এর মধ্যে এক ধরনের তথ্য আমরা বংশগতভাবে পাই আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে, আর অন্য ধরনের তথ্যগুলো শরীরে তৈরি হয় সময়ের সাথে সাথে পরিবেশগত নানা কারণে। এর একটি হল ‘ডিজিটাল’ তথ্য— অর্থাৎ যেগুলো জেনেটিক সূত্র এবং অন্যটি হল ‘অ্যানালগ’ তথ্য— যাকে বলা হয় ‘এপিজিনোম’, যেটি কোষের ভেতরকার একটা পদ্ধতি, অর্থাৎ কোন জিন চালু রাখতে হবে, কোনটা বন্ধ করে দিতে হবে সেটা যে পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে।
একটা কোষের ভেতর যে ২০ হাজার জিন থাকে, সেগুলোর মধ্যে কোনটি সক্রিয় থাকবে আর কোনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, সেটাই কোষটিকে বলে দেয় সে কে— অর্থাৎ ওই কোষের পরিচয় কী হবে এবং কীভাবে সেই কোষটি কাজ করবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই এপিজিনোম পদ্ধতি তথ্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। ধরুন ঠিক যেভাবে আপনার গানের একটা সিডিতে আঁচড় লেগে গেলে সিডি সেখান থেকে গানের অংশটা আর খুঁজে বের করতে পারে না। ফলে তথ্যের অভাবে কোষগুলোও ঠিক সময়ে সঠিক জিনকে চালু করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে— তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই আমরা বুড়ো হই।
আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার অঙ্গীকার। বার্ধক্যকে জয় করতেও আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করব। সহস্রাধিক বছর ধরে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়েছি। এটাই হবে পরের ধাপ— অর্থাৎ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের সীমাবদ্ধতাকে আমরা অতিক্রম করব। আমরা প্রতিদিন কিন্তু এই কাজটা করি। আমরা শরীরে বদল আনতে ওষুধ খাই, আমরা পরিবেশ বদলাতে পদক্ষেপ নিই। একইভাবে আমরা শরীরের রসায়নও বদলাব। বুড়ো হওয়া দেরি করানো যায়, এমনকী বন্ধ করা যায়। ভাবছেন তো একটু বিপ্লবী চিন্তাভাবনা? বিপ্লবী বইকি! কিন্তু বিমানে ওড়া, অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া, কম্পিউটার ব্যবহার করা— এগুলো কি বিপ্লবী ছিল না? মানবজাতি তো এভাবেই এগোয়। সিনক্লেয়ার দ্বিতীয় শৈশবহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। যেখানে প্রথম দ্বিতীয় ভাগ থাকবে না শুধু থাকবে শৈশব আর শৈশবের উদযাপন। দ্বিতীয় শৈশবে শরৎবাবুর লেখা এ-কথাও মিথ্যে হবে— লেখা পাঠাবার শেষ দিন কবে।/ আমারও তো বয়স হয়েছে,/ চোখে ভালো দেখতে পাই না,/ হাত থেকে জিনিস পড়ে-পড়ে যায়,/ ছেলে-মেয়েদের টেলিফোন নম্বর ভুলে যাই আজকাল/আমার ওপর নির্ভর করা আর নিরাপদ নয়/এ-কথা তুমি আর কবে বুঝবে।

Latest article