মানুষের অসুবিধা করে রাস্তার মাঝে মন্দির, দরগা কিংবা গুরুদ্বার থাকতে পারে না। আগেই বলেছিল শীর্ষ আদালত। এবার বলল, দেশের কোনও রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসন ‘বেআইনি নির্মাণ’ ভাঙার যুক্তি দিয়ে বুলডোজ়ার চালাতে পারবে না। একই সঙ্গে বলে দিল, সরকারি রাস্তা, জলাশয়, রেললাইনের ধার বা ফুটপাথ জবরদখল করে গড়ে ওঠা বেআইনি নির্মাণের ভাঙার ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ নেই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সব ধর্ম এবং গোষ্ঠীর জন্য। এই রায় থেকে কয়েকটা বিষয় উঠে আসছে—
এক, পুলিশ-প্রশাসন কাউকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে পারে না। এখন থেকে ঘরবাড়ি ও অন্যান্য ‘অবৈধ’ কাঠামো ভাঙতে গেলেও তা হবে নির্দিষ্ট নিয়মবিধি মেনেই।
আরও পড়ুন-শীঘ্রই জগন্নাথ মন্দিরের কাজ দেখতে দিঘা যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
দুই, বাসস্থানের অধিকারের বিষয়টার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। সংবিধানের ১৯ এবং ২১তম অনুচ্ছেদ মোতাবেক, বাসস্থানের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। এই ধরনের অধিকার থেকে নিরপরাধ মানুষকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।
তিন, যখন কোনও নির্দিষ্ট বাড়ি কিংবা কাঠামো হঠাৎ করে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অথচ অন্য কাঠামোগুলিকে রেয়াত করা হয়— তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই কাজটি বেআইনি নির্মাণে বাধা দিতে নয়, বরং আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কোনও ব্যক্তিবিশেষকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে। এই ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার মেনে নেবে না সুপ্রিম কোর্ট। কোনও ব্যক্তি বা দল বিচার করতে পারেন না, কে দোষী আর কে দোষী নয়। কেউ এ ভাবে আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না।
সুতরাং, আগে থেকে শোকজ নোটিশ ছাড়া কোনও কাঠামো ভেঙে ফেলা যাবে না। নোটিশ পাঠানোর পর ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে। তারপর বিষয়টি জেলাশাসককে জানানো হবে। জেলাশাসকের নিয়োগ করা নোডাল অফিসারের তত্ত্বাবধানে ভাঙার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে। সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুযায়ী নির্দেশিকাও জারি করেছে শীর্ষ আদালত। কোনও ব্যক্তি অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হলেও তাঁর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হবে কেন? বরং বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিত। বলছে সুপ্রিম কোর্ট।
এতদিন জানা ছিল যে নরেন্দ্র মোদি চমকের মাস্টারপিস। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর পদার্পণ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নানা সময়ে তাঁর কিছু পদক্ষেপ, দেশবাসী তো বটেই বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে। মোদিজির ওইসব কাণ্ড কতটা যুক্তিগ্রাহ্য ও আইনসিদ্ধ ছিল এবং দেশবাসী তাতে কতটা উপকৃত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকে সবসময়। মোদিজির চমকের সিরিজ— তাঁকে, তাঁর দল বিজেপি’কে এবং তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত জোট এনডিএ’কে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড কতটা দিয়েছে? সাময়িক কিছু ফায়দা তিনি এবং তাঁরা পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন চমকের ‘বোঝা’ যে ভারতের রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদে বইতে অপারগ, তা মালুম হয় এবারের লোকসভা নির্বাচনে। তৎপরবর্তী বিধানসভাগুলির নির্বাচনেও স্পষ্ট হয়েছে তার ছাপ। তবু, চমক সৃষ্টিতে মোদিজিকে এখনও বোধহয় থামানো যায়নি।
আরও পড়ুন-ড্রাগমাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য গুজরাত! মোদিরাজ্যের উপকূলে আটক মাদকবোঝাই ইরানি জলযান, ধৃত ৮
আর তিনিই যখন গোটা গেরুয়া শিবিরের মাথা এবং মুখ, তখন তাঁকে টুকে লেটার মার্কস পাওয়ার চেষ্টাও জারি আছে ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলিতে। মোদিযুগের রামরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আবার প্রধানমন্ত্রীকেও দশ গোল দিয়ে চলেছেন। গুরু মারা বিদ্যের প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত যাকে বলে! যোগী আদিত্যনাথ আমদানি করেছেন বুলডোজ প্রশাসন। অর্থাৎ সংবিধান, দেশীয় আইনকানুনের ব্যাপার নেই, মুখ্যমন্ত্রীর ফতোয়াই সবার ঊর্ধ্বে। যোগীর প্রশাসনের কাছে চক্ষুশূল ঠেকল মানেই তা ‘বেআইনি’, অতএব তা বলপ্রয়োগ করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নাগরিকের আর্জি, আপত্তি, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও এই একরোখা প্রশাসনকে থামাতে পারবে না। আসলে, এই হুব্বা মার্কা রাজনীতির মাধ্যমে যোগী নিজের ‘দুষ্টের যম আর শিষ্টের পালনকর্তা’র ভাবমূর্তি খাড়া করতে চেয়েছেন। সোজা কথায়, সস্তার হাততালিতেই মোক্ষ খুঁজেছেন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করেছেন বিজেপি-শাসিত আরও একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সস্তা হাততালি কুড়োবার লালসা কতটা সংক্রামক, মোদিযুগ তার প্রমাণ রেখেছে। এর বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। তাকে সমর্থন করেছে একাধিক বিরোধী দল। সংশ্লিষ্ট বিধানসভাগুলি এবং সংসদেও ধ্বনিত হয়েছে প্রতিবাদ। কিন্তু ‘হিরোদের’ রোখা যায়নি।
নানা বিষয়ের মতো, এক্ষেত্রেও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ তাকিয়ে ছিল আদালতের দিকে। তাদের ভরসা ছিল যে, এই অন্যায়ের বিহিত আদালত নিশ্চয় করবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা মতোই মুখ খুলেছে শীর্ষ আদালত। ‘বুলডোজার জাস্টিসকে’ ভর্ৎসনা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার বলে দিয়েছে, অভিযুক্ত, এমনকী সাজাপ্রাপ্ত হলেও কারও বাড়ি বা সম্পত্তি সরকার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারে না। আদালত সংগত প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, সরকার-প্রশাসন বিচার করার কে? তারা বিচারক নয়। আইন এভাবে হাতে নেওয়ার অর্থ, তারা লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করছে। অপরাধের বিচার করবে কেবলমাত্র জুডিশিয়ারি বা বিচারবিভাগ। দেশের আইন সরকারকে সেই ক্ষমতা দেয়নি। বুঝতে বাকি থাকে না যে, শীর্ষ আদালতের এমন অভূতপূর্ব মন্তব্যের নিশানা শাসক বিজেপি। কারণ, বুলডোজার চালিয়ে কিছু নির্মাণ নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়াকেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সুবিচারের রোলমডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা চলছে।
আরও পড়ুন-পুলিশ, দমকল, স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ ছুটি বাড়াচ্ছে প্রশাসন
এই বুলডোজার জাস্টিসের জনক যোগী আদিত্যনাথ। এই ব্যবস্থাকে ক্রমেই কঠোর শাসনপ্রক্রিয়ার সমার্থক হিসেবে তকমা দেওয়ার একটি তাড়নাও লক্ষণীয়। আর তাই যোগী মডেল অনুকরণ করে মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র— বিজেপি-শাসিত প্রতিটি রাজ্য সরকারই শাসন ব্যবস্থায় এনেছে বুলডোজার নীতি। গুঁড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি, ঘর, দোকান। আর যোগীর নতুন পরিচয়? বুলডোজার বাবা! জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের তরফে-সহ একঝাঁক আবেদনের ভিত্তিতে বুধবার সুপ্রিম কোর্ট বহু ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যের উপর রীতিমতো খড়্গহস্ত হয়। আদালত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা কোনও বিচারব্যবস্থাই নয়। অনেকগুলি স্তর পেরিয়ে তবেই এই পর্যায়ে আসতে হয়। অর্থাৎ নোটিশ, জরিমানা, মামলা এবং তারপর কাঠামো অবৈধ প্রমাণিত হলে, তা চিহ্নিতকরণ। সব পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার পরই বুলডোজার ব্যবহারের প্রসঙ্গ। কিন্তু তখনও রাতারাতি কাউকে নিরাশ্রয় করে দেওয়া যায় না। সরকারি প্রশাসন কাউকে দোষী ঘোষণা করতে পারে না, এই অধিকার একান্তভাবেই ন্যস্ত রয়েছে বিচার বিভাগের উপর। বুলডোজ প্রশাসন যে পক্ষপাতদুষ্ট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাও জানাতে ভোলেনি কোর্ট। আইনের শাসনের বিপরীত এই ব্যবস্থার দায় সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসারদের ঘাড়েও চাপবে বলে অত্যন্ত কড়া ভাষায় সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। বুলডোজ বাবাজিদের আস্ফালন এবার অন্তত বন্ধ হওয়া উচিত। তাঁরা যদি গুরুর অন্ধ অনুকরণে যথেচ্ছাচার চালিয়ে যান, তবে বুঝতে হবে— আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি গেরুয়া শিবিরের শ্রদ্ধা নেই। এমন রাজনীতির কারবারিদের প্রাপ্য মেটাতে গণতন্ত্রপ্রিয় ও স্বাধীনতাকামী দেশবাসী নির্বাচনের মতো উপযুক্ত সময় বেছে নিতে ভুল করবেন না।
আর একটা বিষয় উঠে এসেছে। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে আমল দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করছে না মোদি সরকার। উলটে প্রশ্ন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বারবার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এত উদ্বেগ প্রকাশ করছে কেন? কেনই বা লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে রেপো রেট কমানো হচ্ছে না?
অন্যদিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলছেন, বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলেই রেপো রেট কমিয়ে দিতে হবে, এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল? আমরা বিভ্রান্ত। মোদি সরকার আমাদের ঠকিয়ে চলেছে।