দেশের প্রথম বিজ্ঞান জাদুঘর
কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম বা বিআইটিএম। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়ামের অধীনে দেশের প্রথম বিজ্ঞান জাদুঘর। বিভিন্ন ইন্টারেক্টিভ মডেল, প্রদর্শনী, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান এবং ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে এবং প্রচারে নিযুক্ত রয়েছে। সারা বছর এখানে আয়োজিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী। এই মুহূর্তে বিআইটিএম-এ চলছে বিশেষ এক প্রদর্শনী— ‘ব্রিলিয়ান্স বিয়ন্ড বর্ডারস’। ৯ নভেম্বর প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছেন মেডিসিন-ফিজিওলজি ক্ষেত্রে নোবেল মনোনয়ন কমিটির সদস্য প্রফেসর অসীমকুমার দত্ত রায়। অনুষ্ঠানে ছিলেন বিশিষ্টজনেরা। এই প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছেন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনের মতো পুরোপুরি বিজ্ঞান-নির্ভর বিষয়ের উপর কাজ করে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হওয়া ভারতীয় এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীরা। তাঁদের পাশাপাশি আছেন নোবেলে নমিনেশন পেয়েও শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাননি, এমন ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও। সারা জীবন যাঁদের একনিষ্ঠ বিজ্ঞান সেবা শেষ পর্যন্ত উপেক্ষাই করেছে নোবেল কমিটি— প্রদর্শনীতে রয়েছেন তাঁরাও। সবমিলিয়ে আন্তরিক আয়োজন।
আরও পড়ুন-প্রাকৃতিক চিকিৎসায়
দ্বিমাত্রিক এবং ত্রিমাত্রিক
ঘেঁটে দেখা যাক ইতিহাসের পাতা। ১৯০১ থেকে ২০২৪— এই ১২৪ বছর ধরে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনের তিন বিভাগ মিলিয়ে ৩৪৯ বার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সম্মানিত হয়েছেন ৬৫৩ জন। তবে এই তালিকায় ভারতীয় বিজ্ঞানীর সংখ্যা মাত্র পাঁচ। এঁদের মধ্যে রোনাল্ড রস ব্রিটিশ নাগরিক। তবে ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী স্ত্রী অ্যানাফিলিস মশার জীবনচক্র সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার একটা বড় অংশই হয়েছিল কলকাতায়। পাখিদের মধ্যে ম্যালেরিয়াল প্যারাসাইটের জীবনচক্র আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯০২ সালে। চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রমন বা সিভি রমন পুরোপুরি ভারতীয়। ১৯৩০ সালে পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। বিজ্ঞানের যে-কোনও শাখায় নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম এশিয়ান এবং প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ তিনি। তাঁর পরের তিন নোবেল প্রাপক— হরগোবিন্দ খুরানা, সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর এবং ভেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণন। নোবেল পেয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে। কারণ, তাঁরা তিনজনই ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। হরগোবিন্দ খুরানা ১৯৬৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আমিনো এসিডের কোডন-এর সিকুয়েন্স বের করার এক সহজ পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৮৩ সালে। ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণান রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে। ‘ট্রায়াম্ফস’ বিভাগে দেখা মিলছে এই সব কৃতী বিজ্ঞানীদের। সঙ্গে বাড়তি পাওনা হিসেবে রয়েছে চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রমণের স্পেকট্রোস্কোপ যন্ত্রের রেপ্লিকাও। বিজ্ঞানে তাঁদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিকভাবে।
নমিনেশন পেয়েও নোবেল পাননি
প্রদর্শনীর ‘ট্রায়ালস’ বিভাগটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এই বিভাগে জায়গা পেয়েছেন সেইসব বিজ্ঞানীরা, যাঁরা এক বা একাধিকবার নমিনেশন পেয়েও শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পাননি। এই তালিকায় রয়েছেন কালাজ্বরের ওষুধের আবিষ্কর্তা উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা, জি এন রামচন্দ্রন, টি আর সেশাদ্রি, হোমি জে ভাবার মতো ব্যক্তিত্বরা। এঁদের মধ্যে প্রথম জন ছ’বার এবং পরের দু’জন সাতবার মনোনীত হয়েছিলেন। এই বিভাগে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি হাইপার রিয়েলিস্টিক মডেলও রাখা হয়েছে। ঢুকলেই মনে হবে তিনি যেন দর্শকদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন। অপেক্ষা করছেন। যে চেয়ারে মডেলটা রাখা হয়েছে, সেটা কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ব্যবহৃত চেয়ার।
পুরস্কারের কাল্পনিক শংসাপত্র
‘ট্রাভেইল’ অংশে রয়েছেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, বীরবল সাহনি, জেবিএস হালডেন, সেলিম আলি, ইকে, জানকী আম্মাল, অসীমা চট্টোপাধ্যায়, আনা মানি, বিক্রম সারাভাই, ভার্গিস কুরিয়েন, এমএস স্বামীনাথন, এমকে, ভাইনু বাপ্পু, দিলীপ মহলানবিস, বিজয় পি ভাটকরের মতো অক্লান্ত বিজ্ঞানসাধকেরা।
যাঁরা সারা জীবন নিষ্ঠার সঙ্গে বিজ্ঞানের সেবা করে নিজেরাই একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে প্রদর্শনীর এই অংশে। প্রসঙ্গত, ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইলেকট্রিশিয়ান’ পত্রিকায় জগদীশচন্দ্র বসুর ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর বক্তব্য ছিল, আবিষ্কর্তার থেকেও আবিষ্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উপেক্ষা করায় নোবেল শিরোপা ছিনিয়ে নিয়ে যান মার্কনি। এই সেকশনের সবচেয়ে আকর্ষক বিষয়টি হল নোবেল পুরস্কারের কাল্পনিক শংসাপত্র। জগদীশচন্দ্র বসুই হোন বা অসীমা চট্টোপাধ্যায় — যদি তাঁরা নোবেল পুরস্কার পেতেন, তা হলে নোবেল কমিটি কী লিখতেন তাঁদের শংসাপত্রে? তাঁদের কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শংসাপত্রে কোন ছবিই বা ব্যবহার করা হত, রয়েছে সেটাও।
লঞ্চ হয়েছিল সায়েন্স সিটিতে
সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি প্রদর্শনী। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অধিকর্তা শুভব্রত চৌধুরীর সঙ্গে কথা হল। তিনি বললেন, ‘‘প্রদর্শনীটা দ্বিতীয় স্তর হিসেবে উদ্বোধন হয়েছে ৯ নভেম্বর। এর আগে ২০২৪-এর ১৮ মে ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম এক্সপো-র অংশ হিসেবে সায়েন্স সিটিতে এটা লঞ্চ করা হয়েছিল। পরে ২০২৪-এর নোবেল পুরস্কারকে যুক্ত করে নতুন কলেবরে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। আপাতত দু’সপ্তাহ থাকবে। প্রদর্শনীটার খুব ডিমান্ড হয়েছে। আইআইটি গুয়াহাটিতে হতে চলেছে একটা বিজ্ঞান মেলা। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ইসরো, সিএসআইআর, বিআরডিও। তাদের কাছ থেকেও একটা বিশেষ অনুরোধ এসেছে, এই প্রদর্শনীটা যাতে ওখানে ডিসপ্লে করা হয়। সুতরাং ওখানে সপ্তাহখানেক দেখানো হবে। তারপর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাস দুয়েকের জন্য আবার এখানে থাকবে।’’
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কোর কমিটির বৈঠকে অনুব্রত
নেপথ্যে থেকে কাজ করে গেছেন
তিনি আরও বলেন,‘‘নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে বাঙালির সখ্য হয়েছিল ১৯১৩ সালে। যখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পুরস্কার পেলেন, তখন থেকে। আমাদের এই প্রদর্শনীটা শুধুমাত্র নোবেল প্রাপকদের নিয়ে নয়। আরও অনেক কুশীলব আছেন, যাঁরা নেপথ্যে থেকে কাজ করে গেছেন। তাঁদের অনেকেই নোবেল পেতে পারতেন। আমরা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ওপর বেশি কাজ করি। তাই বিজ্ঞানে যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বা পেতে পারতেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করেছি। নোবেল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের প্রবল আগ্রহ। রয়েছে জিজ্ঞাসাও। অনেকেই জানতে চান, নোবেল ব্যাপারটা কী? কারা পেতে পারেন? কীরকম হয়? কখন নমিনেশন নেওয়া হয়? কবে হয় ঘোষণা? এই প্রশ্নের উত্তর যাতে সহজেই সাধারণ মানুষ পেতে পারেন, তার জন্য রয়েছে একটি বিশেষ বিভাগ। এছাড়াও একটি সুন্দর ইনফোগ্রাফিসের মাধ্যমে অনেক কিছুই দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানে যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কেও জানানো হয়েছে বিস্তারিতভাবে। সেইসঙ্গে দেখানো হয়েছে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের ট্রেন্ডটা কী। কারা পান এই পুরস্কার? আরও অনেক কিছু কিছু বিষয় রয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রতিদিন ভিড় হচ্ছে ভালই। শিশুদিবস উপলক্ষে ১৩ এবং ১৪ নভেম্বর বিআইটিএম-এ বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। অংশ নিয়েছে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। তারাও ঘুরে দেখেছে প্রদর্শনীটি। আশা করি আগামী দিনে আরও অনেক মানুষ আসবেন। দেখবেন।’’
আরও পড়ুন-১ ডিসেম্বর থেকে শুক্রবার পর্যটকদের জন্য বন্ধ সুন্দরবন, বসছে ক্যামেরা, শুরু বাঘ শুমারি
• ১৯০১ থেকে ২০২৪— এই ১২৪ বছর ধরে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনের তিন বিভাগ মিলিয়ে ৩৪৯ বার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সম্মানিত হয়েছেন ৬৫৩ জন। তবে এই তালিকায় ভারতীয় বিজ্ঞানীর সংখ্যা মাত্র পাঁচ।
• চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রমন বা সিভি রমন পুরোপুরি ভারতীয়। ১৯৩০ সালে পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। বিজ্ঞানের যে-কোনও শাখায় নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম এশিয়ান এবং প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ তিনি।
• ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইলেকট্রিশিয়ান’ পত্রিকায় জগদীশচন্দ্র বসুর ওয়ারলেস কমিউনিকেশন আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসুর বক্তব্য ছিল, আবিষ্কর্তার থেকেও আবিষ্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উপেক্ষা করায় নোবেল শিরোপা ছিনিয়ে নিয়ে যান মার্কনি।
• ২০২৪-এর ১৮ মে ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম এক্সপো-র অংশ হিসেবে সায়েন্স সিটিতে প্রদর্শনীটা লঞ্চ করা হয়েছিল। পরে ২০২৪-এর নোবেল পুরস্কারকে যুক্ত করে নতুন কলেবরে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। আপাতত দুই সপ্তাহ থাকবে।
• নোবেল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের প্রবল আগ্রহ। রয়েছে জিজ্ঞাসাও। অনেকেই জানতে চান, নোবেল ব্যাপারটা কী? কারা পেতে পারেন? কীরকম হয়? কখন নমিনেশন নেওয়া হয়? কবে হয় ঘোষণা? এই প্রশ্নের উত্তর যাতে সহজেই সাধারণ মানুষ পেতে পারেন, তার জন্য রয়েছে একটি বিশেষ বিভাগ।