যৌবন বাউল অলোকরঞ্জন

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কবি, অধ্যাপক, অনুবাদক। স্বতন্ত্র্য ছিল তাঁর কাব্যভাষা। বাংলা-জার্মান সাহিত্যের মেলবন্ধনে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ২০২০-র আজকের দিনে প্রয়াত হন। চার বছর হল তিনি নেই। তবে এখনও আগের মতোই চর্চিত, পঠিত। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি
পাঁচের দশকে একদল তরুণ কবি যখন মধ্যরাতের কলকাতা শাসন করে বেড়াচ্ছেন, তখন কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নিভৃত উচ্চারণের অক্ষর যাপনে মগ্ন ছিলেন কয়েকজন কবি। তাঁরাও তরুণ। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছিলেন সেই ধারার অন্যতম। তাঁর প্রতিটি পঙক্তি থেকে বিচ্ছুরিত হত বৈদগ্ধ্য, মেধার ঝলকানি। ‘কৃত্তিবাস’-এর হইহল্লা থেকে কিছুটা দূরে থেকে অভিন্নহৃদয় বন্ধু আলোক সরকারের সঙ্গে করেছিলেন ‘শতভিষা’র সাধনা। যদিও তাঁর কবিতা ‘শতভিষা’র পাশাপাশি নিয়মিত প্রকাশিত হত ‘কৃত্তিবাস’-এ। দুটি পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অলোকরঞ্জনের কবিতা প্রকাশে কোনওরকম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। লিখেছেন আরও অনেক উল্লেখযোগ্য পত্রিকায়।
অধ্যাপনাতেও খ্যাতি
১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর, কলকাতায় জন্ম। শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষা। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ভারতীয় কবিতার শব্দমালা নিয়ে পিএইচডি। ১৯৫৭ সালে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে শুরু করেন কর্মজীবন। এখানেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি শঙ্খ ঘোষকে। বৈদগ্ধ্য, জ্ঞানান্বেষণ, সাহিত্য বিশ্লেষণ ও অন্বেষা অলোকরঞ্জনকে অধ্যাপনাতেও খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-সাড়া জাগিয়েছে ব্রিলিয়ান্স বিয়ন্ড বর্ডারস

তরুণদের অনুপ্রেরণা
এরপর জার্মানির হামবোল্ট ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে জার্মানিতে গবেষণার কাজে যান। ১৯৭২ সালে যোগ দেন হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারততত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রেই পাঁচ দশক ধরে হাইডেলবার্গের বাসিন্দা ছিলেন অলোকরঞ্জন।
সূচনাপর্ব থেকেই তাঁর কবিতায়, এমনকী, ব্যক্তিগত কথোপকথনেও স্বাতন্ত্র্য ছিল। তাঁর ছন্দনৈপুণ্য ও ভাষার কারুকার্য তাঁর কবিতাকে দিয়েছে স্বকীয়তা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবন বাউল’। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত। দিয়েছিল বিশেষ খ্যাতি। জীবদ্দশায় প্রায় ২০টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। সমাজ সচেতন এই কবির কাব্যচেতনা তরুণদের বরাবর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
সেতুর ভূমিকায়
বাংলা-জার্মান সাহিত্যের মেলবন্ধনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁকে দেখা গেছে সেতুর ভূমিকায়। বহু জার্মান কবিতা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। জার্মানিতে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাংলা কবিতার একের পর এক অনুবাদ। এই কর্মকাণ্ডের জন্য জার্মান সরকার ১৯৮৫ সালে তাঁকে ‘গ্যেটে’ পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল। বিদেশের সঙ্গে দেশের বন্ধন ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি হয়তো এত অনুবাদ কর্মে হাত দিয়েছিলেন। কলকাতায় থাকতেই, ১৯৫৭ সালে, বন্ধু আলোক সরকারের সঙ্গে যুগ্মভাবে ‘ভিনদেশী ফুল’ নামে ফরাসি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন তিনি। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’ নামে নানা দেশের কবিতার বাংলা অনুবাদ। বহু পরে জার্মান ভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন ‘প্রেমে পরবাসে’ (১৯৯০) নামে। অনুবাদ করেছেন হাইনের কবিতাও। আবার বাংলা কবিতাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন জার্মান পাঠকদের ঘরে। এই সবেরই প্রণোদনা এসেছিল দেশ-বিদেশকে মেলানোর ভাবনা থেকে।

আরও পড়ুন-ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা রাজধানী, স্কুল-কলেজে ফিরছে মাস্ক

পুরস্কার ও সম্মাননা
নিজস্ব কাব্যভাষা যেমন তাঁকে স্বকীয়তা দিয়েছে ও বাড়িয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্য, তেমনই বৈদগ্ধ্য ও বিশ্বমনস্কতা তাঁর কাব্যজগৎকে দিয়েছে ব্যাপ্তি। ‘শিল্পিত স্বভাব’, ‘দ্বিতীয় ভুবন’ , ‘ঘূর্ণিস্রোতে সৃজনী সংরাগে’, ‘শেষ কথা কে বলবে’ ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থে তাঁর অসীম বৈদগ্ধ্য ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে মিশেছে সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা। বাঙালি মনীষা ও মননচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কোনওদিন বিস্মৃত হওয়ার নয়। বিদেশের পাশাপাশি এই দেশেও বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন অলোকরঞ্জন। কবি হিসেবে তাঁর স্বকীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সাহিত্য অকাদেমি, তাঁর ‘মরমী করাত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য (১৯৯২)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানিত করেছে সুধা বসু পুরস্কারে (১৯৮৩)। এ ছাড়া পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৫) ও রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৮৭)।
নাড়ির টান ছিন্ন হয়নি
পাকাপাকিভাবে শেষ কয়েক দশক জার্মানির বাসিন্দা ছিলেন তবে বাংলার সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান শেষ দিন পর্যন্ত ছিন্ন হয়নি। কলকাতা ও বাংলার সাহিত্যজগৎ থেকে দূরে সরে থাকেননি। বারবার ছুটে এসেছেন মাতৃভূমিতে। বছরে অন্তত একটিবার। অংশ নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা, কলকাতা বইমেলা-সহ বিভিন্ন সারস্বত উৎসব, সভা সমাবেশে। সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য রেখেছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায়। ভালবাসতেন অনর্গল কথা বলতে। জমিয়ে দিতেন মেধাবী আড্ডার আসর। ছিলেন তুমুল রসিক। নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘আমি এক জন্ম বাচাল’। ২০২০-র ১৭ নভেম্বর প্রয়াত হন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। আজ তাঁর চলে যাওয়ার দিন। চার বছর হল তিনি নেই। তবে এখনও তিনি আগের মতোই চর্চিত, পঠিত।

Latest article