মহারাষ্ট্রের মতো বড় রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয় একদিনে। অথচ সাঁওতাল, মুন্ডা-সহ বিভিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা ভোট হচ্ছে দু’দফায়। নির্বাচন কমিশনের এই একচোখা বৈষম্য দেখে পশ্চিমবঙ্গবাসী ইতিমধ্যে অভ্যস্ত। কিন্তু ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনের দফা বাড়ানোর পিছনে অন্য কৌশল দেখছে রাজনৈতিক মহল এবং সমগ্র দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর যোদ্ধা বিরসা মুন্ডার ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনে হঠাৎ রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দিল্লির জমিদাররা। ক’দিন আগে ঘটা করে দিল্লিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিরসা মুন্ডার মূর্তি উন্মোচন করলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তারপরই সরায়কাল-এর খান চক হয়ে গেল বিরসা মুন্ডা চক। দেশবাসীকে গিনিপিগ বানিয়ে চমক দেওয়ার খেলায় বিজেপি যে সিদ্ধহস্ত তা আবারও প্রমাণ হল এই পদক্ষেপে।
আরও পড়ুন-হকিতে মেয়েদের টানা পঞ্চম জয়
গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নোটবন্দি থেকে কালা কৃষি কানুন, মানুষ মারা সিএএ-এনআরসি কায়েম, লাফিয়ে লাফিয়ে পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশচুম্বী দাম এই তো বিজেপি সরকারের (অধুনা এনডিএ) এক এবং অভিন্ন এজেন্ডা। সঙ্গে বন্ধু শিল্পপতিদের হাতে দেশটা তুলে দেওয়া। এয়ারপোর্ট হোক আর সমুদ্রবন্দর, সড়ক হোক কিংবা জঙ্গল, পরিকাঠামো উন্নয়নের মোড়কে সবকিছু বিক্রি-বাট্টা করে দেওয়াই কেন্দ্রের বেচুবাবুদের ধ্যানজ্ঞান।
আর ভোট এলেই নজর ঘোরাতে ধর্মের আগুন জ্বালানো নয়তো বিরসা মুন্ডার মতো মহান দেশপ্রেমিককে নিয়ে সস্তার গিমিক তৈরি করা। কাগজ জুড়ে বিরসা মুন্ডার ছবি সম্বলিত বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢক্কানিনাদ করা। একেই হয়তো বলে,
‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
মহানুভবতা দেখাচ্ছে সেই বিজেপি যারা মূলত মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত। একটা সময়ে জাতপাতের রাজনীতি দীর্ণ বিহারে এই বৈষম্য দূর করতে লালুপ্রসাদ যাদব আহ্বান জানিয়েছিলেন, ভুরাবাল (ভূমিহার, রাজপুত, ব্রাহ্মণ, লালা) সাফ করো। এর মানে এই নয় যে উচ্চবর্ণের মানুষ মাত্রই অত্যাচারী বা খারাপ।
আরও পড়ুন-জগন্নাথ মন্দিরের সামনের বনাঞ্চলে নেচার পার্ক গড়বে দিঘা উন্নয়ন পর্ষদ
বরং, উল্টোটাই। অধিকাংশ ভাল মানুষ বিচরণ করেন সব বর্ণে, সব ধর্মে, সকল জাতির মাঝারে। কিন্তু আজকের দিল্লির শাসকদের পূর্বসূরিরা তৎকালীন গোবলয়ের রাজ্যগুলি জুড়ে এমন অত্যাচার চালাত যাতে লালুপ্রসাদের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ এই ধরনের আওয়াজ তুলতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন। মূল লক্ষ্য ছিল শোষকদের হাত থেকে নিপীড়িত জনজাতি তথা নিম্নবর্গের মানুষকে রক্ষা করা। পরবর্তীতে অবশ্য লালু জমানায় বিহার আবার জিসকা লাঠি উসকা ভইস (মোষ)-এর আবরণে যাদব বা গোয়ালা সম্প্রদায়ের হাতে চলে গিয়েছিল। সে অন্য প্রশ্ন এবং প্রসঙ্গ।
সুখের কথা এই যে সারল্যে ভরপুর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ বিজেপির এই কুমিরছানা দেখানোর ভবিতে আর ভুলছে না। বিগত লোকসভা নির্বাচন, তার আগের বিধানসভাতে ঝাড়খণ্ডে বিজেপির পর্যুদস্ত হওয়া এর সবথেকে বড় উদাহরণ। গণতান্ত্রিকভাবে না পেরে বশংবদ এজেন্সিকে মাঠ নামিয়ে ঝাড়খণ্ডের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে নিশানাও করেছে বিজেপি। তাতেও সুবিধা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আদিবাসী তাস খেলতে বিরসা মুন্ডার ভক্তিতে একেবারে গদগদ গৈরিক গোয়েবলসরা। এতকিছু সত্ত্বেও ঝাড়খণ্ড জেতা যে মুশকিল তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বিজেপি।
ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে এলে ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। সুদীর্ঘ বাম জমানার নিপীড়িত আমলাশোলের জায়গায় এখন আপামর উন্নয়নযজ্ঞ চলছে। জঙ্গলমহল সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার বলেছেন, জঙ্গলের অধিকার আদিবাসীদের। শিশুর সারল্যে তিনি নিমেষে মিশেও যান জঙ্গলবাসীর সঙ্গে। কখনও চা-মুড়ি খাচ্ছেন, আবার কখনও আদিবাসীদের পরম্পরা মেনে নৃত্যের তালে মেতে উঠছেন। এই সারল্যের জন্যই মুখ্যমন্ত্রী বরাবর কাছে পেয়েছেন আদিবাসীদের নিয়ে রীতিমতো ফিল্ডওয়ার্ক করা ম্যাগসেসে পুরস্কার জয়ী প্রয়াত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীদের। পেয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের আশীর্বাদ। যদিও সারল্য আর বিজেপি পুরোপুরি বিপরীত। গেরুয়া ধ্বজাধারীদের সঙ্গে মিলে যায় অত্যাচারী ঠাকুরদের ডিএনএ।
একটা সময়ে হিন্দি সিনেমায় খলনায়ক মানেই দেখা যেত পেল্লাই গোঁফওয়ালা অমুক ঠাকুর, তমুক চৌধুরীদের। এঁদের মূলত সমাজের উচ্চবর্ণের রাজপুত, ভূমিহার সম্প্রদায়ের প্রতিভূ হিসেবে দেখানো হত।
প্রেম চোপড়া, অমরীশ পুরী, সদাশিব অম্রপুরকারদের খল-চেহারায় জব্বর ফুটে উঠত চরিত্রগুলির নিষ্ঠুর অবয়ব।
আরও পড়ুন-পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ পেঁয়াজের দাম, নির্লজ্জ সাফাই কেন্দ্রের সরকারের
বাণিজ্যিক মশালা মার্কা হিন্দি সিনেমার এই ভিলেনরা যথারীতি ভীষণ অত্যাচারী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। প্রভূত অর্থশালী এই ঠাকুর, চৌধুরীদের অত্যাচারে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠত সাধারণ প্রজাদের। জাতের নামে বজ্জাতি যাদের এক এবং অদ্বিতীয়ম কাজ। এমনিতে নিচু জাতের ছায়া মারাবে না। কিন্তু, রাত হলেই ছুঁকছুঁক করা হরিজন বস্তিতে। অমানুষ সিনেমার মহিম প্রেসিডেন্ট ওরফে উৎপল দত্তের চরিত্রটা একটু ভেবে দেখুন। কিংবা অন্যায় অবিচারের উৎপল দত্ত। বস্তুত, জাত্যাভিমানের জাঁতাকলে পিষে যেত পিছড়ে বর্গের মানুষ। সব ঠাকুর কি তাবলে খারাপ হত? না তাঁদের মধ্যে শোলে সিনেমার ঠাকুররূপী সঞ্জীব কুমাররাও থাকতেন। যাঁরা কার্যত পিছড়ে বর্গের হয়ে লড়াই করতেন।
লুঠেরা ডাকাত গব্বর সিংয়ের হাত থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষকে রক্ষা করতেন। আমাদের ভারতবর্ষের বড় দুর্ভাগ্য কোনও দয়াল ঠাকুর এই মুহূর্তে নেই। যত্তসব ঠগবাজ ঠাকুরদের কব্জায় চলে গিয়েছে দেশ। একদল কোটি কোটি টাকা চৌপাট করে বিদেশে দিব্যি রয়েছে। মাঝেমধ্যে খবর হচ্ছে তাদের নাকি ফেরাচ্ছে সরকার। কিন্তু, কোথায় কী! বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছে সরকারি বদান্যতা প্রাপ্ত শয়তানরা। গব্বর সিং, মোকাম্বোদের মতো খলনায়করা দিল্লির গদি দখল করেছে। শুধু তাই নয়, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা করায়ত্ত করে রাখতে মরিয়া বিজেপি। সেজন্যই ঢাক পিটিয়ে সাঁওতাল, মুন্ডাদের মনোরঞ্জনের প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে এই চালিয়াতরা।
আরও পড়ুন-পুলিশি নিরাপত্তায় শান্তিপুরের ভাঙা রাসে উপচে পড়া ভিড়
নব্বইয়ের দশকের একদম গোড়ার দিকে মণ্ডল এবং কমণ্ডল নিয়ে উত্তাল হয়েছিল দেশ। একদিকে পিছড়ে বর্গের সংরক্ষণের দাবিতে তৎকালীন জনতা দল নেতা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর মণ্ডল অন্যদিকে ধর্মের জিগির তোলা কমণ্ডল ভারতীয় জনতা পার্টি। মণ্ডল-কমণ্ডলে স্যান্ডউইচ অবস্থা হয়েছিল জনতা জনার্দনের। আরও একবার ধর্ম আর জাতপাতের ভিত্তিতে সেই পুরনো খেলায় মেতেছে বিজেপি। তৎকালীন মণ্ডল-কমণ্ডলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে গলি গলি মে শোর হ্যায় রাজীব গান্ধী চোর হ্যায় স্লোগান তোলা সিপিএমও ক্ষেত্রবিশেষে সেই তালে সঙ্গত করছে। রামের নোট, বামের ভোটের যুগলবন্দিতে।