সকল প্রাণের পূর্বপুরুষ একটিমাত্র কোষ

পৃথিবী সৃষ্টির পর-পরই নাকি এই ধরিত্রীর সকল প্রাণের সাধারণ পূর্বজ কোষের জন্ম; তাই জীববিজ্ঞানীদের উৎসাহের শেষ নেই। সেই নিয়ে লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

লুকা দ্যা গ্রেট পূর্বজ!
লুকা…!
জি হাঁ— লুকা। এল ইউ সি এ। দ্যা লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর। এই পৃথিবীর সকল প্রাণের একমাত্র সার্বজনীন সাধারণ পূর্বপুরুষ; একটি আদিমতম কোষ; তাও আবার ৪২০ কোটি বছরের প্রবীণ; নিউক্লিয়াস বিহীন আদি ব্যাকটেরিয়া কিংবা আর্কিয়া এবং নিউক্লিয়াস-যুক্ত ইউক্যারিয়ার মধ্যবর্তী পর্যায়ের একটি কোষ; এর থেকেই নাকি এই ধরাধামের সকল প্রাণের উৎপত্তি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই সুপ্রাচীন কোষটি থেকেই ইহজীবনের সুবিশাল এবং সু-বৈচিত্র্যপূর্ণ ‘ট্রি অব লাইফ’ বা জীবনবৃক্ষের শুভারম্ভ।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল, ইউনিভার্সিটি অব এক্সটার, ইউনিভার্সিটি অব বেইথ ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন; নেদারল্যান্ডসের রয়েল নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব সি রিসার্চ, ও ইউনিভার্সিটি অব আমস্টারডাম; জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি গ্রাজুয়েট ইউনিভার্সিটি এবং হাঙ্গেরির এটভস ইউনিভার্সিটি, হান-রেন সেন্টার ফর ইকোলজিক্যাল রিসার্চ, এবং ইভোলিউশনারি জিনোমিক্স রিসার্চ গ্রুপের উনিশ জন বিজ্ঞানীর একটি সম্মিলিত গবেষণাপত্র সাম্প্রতিক সময়ে নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রে ওই বিজ্ঞানীদের দল এই পৃথিবীর সমস্ত জীবন্ত বস্তু বা লিভিং অর্গানিজমের শেষ সার্বজনীন সাধারণ পূর্বপুরুষের বয়স, প্রকৃতি এবং তা পৃথিবীর জীবজগৎকে কতটা কীভাবে প্রভাবিত করছে, তার একটি ধারণা দিয়েছেন।
গবেষণাপত্রটির মূল লেখক ব্রিস্টল প্যালিওবায়োলজি গ্রুপের জীবাশ্ম বিজ্ঞানী ড. এডমান্ড আর আর মুডি লিখেছেন, সমগ্র জীব তথা আমাদের পূর্বপুরুষ একটিমাত্র কোষ থেকে সৃষ্ট, যার বয়স প্রায় ৪.২ বিলিয়ন বছর। ওই একটিমাত্র কোষ থেকেই পুরো জীবজগতের উৎপাদন। দুঃখজনকভাবে এর আগে কোনও বিজ্ঞানীই এ-ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি, তবে জিনোমের মাধ্যমে জীবের বিবর্তনীয় ইতিহাস পুনর্গঠন বিদ্যা বা ফাইলোজিনোমিক্সের অধ্যাপক ড. ডেভিড পিসানি জানান, ওই প্রাচীনতম জননী কোষটিই যে আমাদের পূর্বজ তা প্রমাণিত এবং মজার বিষয় হল ওর মধ্যে জৈবিক প্রাথমিক অনাক্রম্যতা লক্ষণীয় এবং ওই সুদীর্ঘ ৪.২ বিলিয়ন বছর আগেও তাকে নানা ধরনের ভয়াবহ ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়েছে।

আরও পড়ুন- আন্তঃরাজ্য বাইক চুরিচক্রের ৩ পান্ডা ধৃত, উদ্ধার ২ গাড়ি

অনন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তন
নানা বিষয়, নানা বিশেষজ্ঞ, খুব স্বাভাবিক নানা মত, তবে সকলের লক্ষ্য একটি উত্তর খুঁজে পাওয়া, প্রাণের উৎস কোথা থেকে— এতদিন পর্যন্ত লুকা বা জীবের সার্বজনীন সাধারণ পূর্বপুরুষ শুধুমাত্র একটি অনুমান ছিল। তবে এর সপক্ষে এখনও পর্যন্ত কোনও জীবাশ্ম-প্রমাণ পাওয়া না গেলেও, এই ধরাধামে বিদ্যমান সমস্ত জীবনের জৈব রাসায়নিক সাদৃশ্যতার কারণে জৈবরসায়নবিদেরা লুকার অস্তিত্ব সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। মনে করা হয় এই পৃথিবীতে জীবন্ত বলতে সর্বপ্রথম নাকি ভাইরাস এসেছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির জন্য একটি ‘হোস্ট সেল’ বা কোষের প্রয়োজন; এখানেই লুকার অস্তিত্ব সত্য হয় এবং অরিজিন অব ভাইরাস নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
পৃথিবীর বুকে যে লিভিং অর্গানিজম রাজ করছে, বৈজ্ঞানিকভাবে তাদের তিনটে মাত্রায় ভাগ করা হয়, যথা— ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়া এবং ইউক্যারিয়া। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রয়েছে থার্মাটোগেলস, ল্যাভোব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাক্টেরিয়া, পার্পল ব্যাকটেরিয়া, গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া ও গ্রিন নন-সালফার ব্যাকটেরিয়া; আর্কিয়ার মধ্যে রয়েছে পাইরোডিক্টিকাম, থার্মোপ্রোটিয়াস, থার্মোকক্কাস, মিথেনোকক্কাস, ও হ্যালোআর্কিয়া; এবং ইউক্যারিয়ার অন্তর্ভুক্ত মাইক্রোস্পোরিডিয়া, ফ্ল্যাজেল্ল্যাস, ফানজাই, গ্রিন প্লান্টস, সিলিয়েটস, এবং অ্যানিম্যালস। জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় এইসব বিভাজনকে একত্রে জাতিগত বৃক্ষ বা ফাইলোজেনেটিক্স ট্রি বলা হয়ে থাকে।
এইপ্রকার বংশগতি বৃক্ষ সরাসরি লুকার অস্তিত্ব স্বীকার করে। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে জীববিজ্ঞানী ড. জাঁ বাপতিস্ত লেমার্ক তাঁর ‘ফিলোজফি জুলজিক’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘আর্লি ট্রি অব লাইফ’ স্কেচ করেছিলেন। এরপর বিবর্তনবাদের জনক বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘দ্য অরিজিন অব স্পেসিস’ বইয়ে এই সার্বজনীন সাধারণ বংশগতির ধারণা দেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ওই ধরনের জীবকোষের ধারণা হতেই লুকা বা লাস্ট ইউনিভার্সাল কমন অ্যানসেস্টর বিষয়টি বৈজ্ঞানিক মহলে প্রথম পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত এই ফাইলোজেনেটিক্স ট্রি-র উৎসমূল যা কিনা একটি গাছের গেঁজ বা অস্থিসন্ধিগত আবের মতো, যেখান থেকে শাখা-প্রশাখার জন্ম হয়। প্রমাণিত, লুকা একটি প্রোক্যারিওট কোষ, যেটা নিজের ক্ষমতায় ওই সূদূর অতীতে একটি জটিল ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের মধ্যে টিকে ছিল।

অনবদ্য বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান
তাত্ত্বিক মত-পার্থক্য-সহ জীবাশ্ম নমুনা এবং সমসাময়িক লিভিং অর্গানিজমের থেকে প্রাপ্ত নমুনা মার্কার জিন ও জিনোমের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যের পুনর্বিবেচনার নানাবিধ ত্রুটির কারণে লুকার সঠিক বয়স এবং প্রকৃতি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০০০ খ্রিস্টাব্দের একটি গবেষণায় উঠে আসে লুকা ৩.৮ বিলিয়ন বছর, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের গবেষণায় ৪.৫২ বিলিয়ন বছর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দের গবেষণায় ৩.৬—৪.২ বিলিয়ন বছরের পুরনো; কিন্তু ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রতিক গবেষণায় অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে লুকা পৃথিবী সৃষ্টির কয়েকশো মিলিয়ন বছর পর, আজ থেকে প্রায় ৪.২ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর দিকে এ-ধরিত্রী বাসযোগ্য ছিল না, কেননা তখন বায়ুমণ্ডলে ছিল না পর্যাপ্ত অক্সিজেন, চারিদিকে তখন উষ্ণ মহাসাগর! বিজ্ঞানীদের ধারণা ওইরকম প্রতিকূল পরিবেশে কোনওপ্রকার অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে ছিল ওই কোষ।

পূর্বপুরুষ নির্ধারিত ভবিষ্যৎ
প্রকৃতির ওই অদ্ভুত নিয়ম যা পৃথিবীর সমস্ত জীবন্ত বস্তু বা লিভিং অর্গানিজমের মধ্যস্থিত জেনেটিক ইনফরমেশনকে প্রোটিনে রূপান্তরিত করে, যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলে ইউনিভার্সাল জেনেটিক কোড; প্রাণীদেহের মধ্যে প্রোটিন সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া; কুড়িটি অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিডের অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এবং অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট কোষের শক্তির সাধারণ উৎস; এই চারটি গুণই লুকার অস্তিত্বকে সত্য বলে প্রমাণ করে। প্রায় ৭০০টি ব্যাকটেরিয়া ও আর্কিয়ার প্রজাতির ২,৬৫৭টি জিনের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে বর্তমানে পৃথিবীতে বিদ্যমান লিভিং অর্গানিজমের সঙ্গে লুকার কোষীয় জীবনের বৈশিষ্ট্য হুবহু একই— একই প্রোটিন বিল্ডিং ব্লকস, অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেটের শক্তি এবং তথ্য সঞ্চয়ের জন্য ডিএনএ-র ব্যবহার।
গবেষণায় প্রমাণিত লুকার জিনোমের সাইজ ২.৭৫ মেগাবেস যা আধুনিক প্রোক্যারিওটের সীমার মধ্যে। দৃষ্টান্তমূলকভাবে লুকার জিনোমের ফাইলোজেনেটিক্স রিকনসিলিয়েশন, কোর মেটাবোলিজম এবং মলিকিউলার ক্লক মেথোডলজির মধ্য দিয়ে বয়স এবং প্রকৃতির একটি সঠিক ধারণা মিললেও, ঠিক কোথা থেকে কীভাবে লুকার জন্ম এবং কীভাবেই বা তার বিবর্তন হয়ে আমাদের এই বর্তমান জীবজগৎ তৈরি হল তা আজও রহস্য! তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা লুকা হয়তো গভীর সমুদ্রের কোনও এক হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের উষ্ণ প্রস্রবণে জন্মেছে।

Latest article