ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয়, ওয়াকফ আইনের ইতিহাস, স্বাধীনতা-উত্তর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ‘‘ওয়াকফ” একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ, ঈশ্বরের নামে দান করা সম্পত্তি, যা পরবর্তীতে হতদরিদ্র আর্ত মানুষের সেবার কাজে ব্যবহৃত। স্বয়ং নবিজির উপস্থিতিতে ওয়াকফ সম্পত্তির প্রসঙ্গ আছে। যিনি দান করছেন তাঁর বা তাঁর উত্তরাধিকারীর ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর আর কোনও অধিকার থাকে না। ভারতবর্ষীয় ধর্ম সমন্বয়ের ধারাটিকে অগ্রাধিকার দিলে, ত্যাগ শব্দটির যে বহুধা গতি, তাতে ওয়াকফ একটি অন্যতম সিলমোহর।
আরও পড়ুন-ফাইনালে ভারতের সামনে আজ চিন
১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালের ইতিহাস বলছে, দেশভাগের পর, পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্পত্তি, দান ও সেবাকার্যে ব্যবহারের কারণেই ওয়াকফ আইন। সে-সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। নেহরুজির সে-সময়ের সিদ্ধান্তের পিছনে যে গভীর ভারতবোধ কাজ করেছিল তা বুঝতে, আবারও ইতিহাসের দিকেই তাকাতে হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, ফিরে তাকাতে হয়, মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব অনুভবের দিকে। ‘‘ওয়াকফ”-এ ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পদ সর্বজনীন। আর সেই সার্বিক উন্নয়নের গলায় এবারে ফাঁস টানছে অধুনা কেন্দ্রীয় নীতি। ভারতবর্ষে ওয়াকফ সম্পত্তির প্রথম পর্বটিকে নিরীক্ষণ করতে হলে, আমাদের পৌঁছতে হয় প্রায় ১১৭৩ সাল নাগাদ। দিল্লির সুলতান মসজিদের জন্য জমি দান করলে, ওয়াকফ সম্পত্তির সূচনা হয়। তবে, ব্রিটিশ রাজশক্তির ভোগ দখলের সামনে ওয়াকফ সম্পত্তির বলে বলীয়ান সেবাকার্য থমকে যায় অচিরেই। এরপর স্বাধীন ভারতবর্ষে ওয়াকফ আইন বলবৎ হলে, আবার তা প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই দরকার হয়ে পড়ে শক্তপোক্ত পরিকাঠামোর। ১৯৫৫ সালে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হলে যাবতীয় ওয়াকফ সম্পত্তির দেখভালের একটি বলিষ্ঠ অবয়ব সূচিত হয়। মূলত ওয়াকফ সম্পত্তির অর্থ মসজিদ, এতিমখানা, হাসপাতাল নির্মাণ ছাড়াও আতুর মানুষের সেবাকার্যে ব্যবহৃত। সেই সময় থেকে লাগাতার নিজস্বতা অক্ষুণ্ন রেখেও স্থানিক বিবেচনার ভিত্তিতে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে ওয়াকফ বোর্ডের সদর্থক ভূমিকা কোনও দিনই অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিটি রাজ্যে গঠিত ওয়াকফ বোর্ডের মাথার ওপর কেন্দ্রীয় বোর্ডটি রক্ষিত। ফলে, যে কোনও অভিযোগ কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পেশ করার সুযোগটিও এত বছর ধরে লাগু। ১৯৯৫ সালের সংশোধন এ-আইনকে আরও শক্তিশালী করে।
২০২৪ সালের আজকের ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ আইনের সংশোধন চাইছেন। একটি সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বোর্ডের ক্ষমতা সম্পর্কিত বর্তমান আইনের ধারা থেকে চল্লিশটি ধারার পরিবর্তন চাওয়া হচ্ছে আশু। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওয়াকফ বোর্ড সারা ভারতে ৯.৪ লক্ষ একর জুড়ে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। ওয়াকফ বিধান অনুয়ায়ী, ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর ও বিক্রি নিষিদ্ধ। ওয়াকফ বোর্ড আইন ১৯৯৫ সালের অধীনে ওই বোর্ড ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে সমীক্ষা করে বা ক্রমাগত ব্যবহার করা হয়েছে কিনা এই তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আইন অনুযায়ী যদি কারও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে নথিভুক্ত করা নিয়ে আপত্তি ওঠে, তবে ওই সম্পত্তি ওয়াকফে অন্তর্ভুক্তির এক বছরের মধ্যে ওয়াকফ ট্রাইবুনালে জানানো যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে, ট্রাইবুনাল সিদ্ধান্ত নেবে ওই সম্পত্তি ওয়াকফ কিনা৷ যদিও, এ পুরো বিষয়টি নিয়েই নানান অভিযোগের তির বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে দানা বাঁধে।
আরও পড়ুন-১ কোটি ৭ লক্ষ উপভোক্তা, বরাদ্দ ২৯০০ কোটি, কৃষকবন্ধুদের দ্বিতীয় দফার টাকা শীঘ্রই
এ-প্রসঙ্গে অর্থ নয়ছয়, জমি দখলের পাশাপাশি অজস্র বেহিসাবি কাজের অভিযোগ আছে ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু, এই অস্বচ্ছতা রুখতে গিয়ে সার্বভৌম ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র কাঠামোর গভীরে যে বড়সড় আঘাতটি লুকিয়ে থাকছে, তা সাধারণের চোখ এড়াবে কেমন করে! সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ডের অধিগৃহীত জমি সরকার ইচ্ছে করলে পুনরায় গ্রহণ করতে পারে এবং জমি অধিগ্রহণের মতো কাজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন সাপেক্ষ। আপাতত দুর্নীতি দমনের নামে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র আধিপত্যে রাশ টানছেন কেন্দ্রীয় সরকার। আর, এখানেই দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নচিহ্নটি চলে আসে। ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ওয়াকফ বোর্ডের থেকে বেশি হওয়ার ফলস্বরূপ আরও নতুন কোনও অস্বচ্ছতার জন্ম দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়। ওয়াকফ বোর্ডের অস্বচ্ছতা রুখতে ব্রিটিশ শাসনের দখলি নীতির পুনরাবৃত্তি বুঝতেও খুব কষ্ট করতে হয় না সাধারণ মানুষকে। সর্বোপরি, এতদিন ওয়াকফ আইনে অমুসলমান যে কোনও ব্যক্তি সহজেই তাঁর সম্পত্তি দান করতে পারতেন ওয়াকফ বোর্ডে। ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারাটির সঙ্গে তাই এর বিরোধিতা ছিল না কোনও কালে৷ কিন্তু সংশোধিত আইনে, বলা হয়েছে, নিজ সম্পদ ওয়াকফ সম্পত্তি রূপে দান করতে চাইলে কমপক্ষে পাঁচ বছর আগে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। এ কেবল ধর্ম বিভাজনের মাপকাঠিকেই স্পষ্ট করে না, সেই সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারেরও সরাসরি বিরোধিতা করে৷
সাধারণ নাগরিকের স্বাধীন সেবাধর্মের মানসিক ইচ্ছের হাতে শিকল পরানোর এমন সুচারু কৌশল মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।