অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, রাজ্য সরকারকে ঠেস দিয়ে, যা কিছু ‘নিষিদ্ধ’, মন্দারমণিতে সে-সব ‘প্রসিদ্ধ’।
পরিবেশ আদালতের নির্দেশে অনিশ্চয়তার মধ্যে মন্দারমণির ১৪০টি ‘অবৈধ’ হোটেল। দিঘা এবং কাঁথির অদূরে বেলাভূমিতে গড়ে ওঠা ওই হোটেলগুলির উপর ‘বুলডোজ়ার’ (Bulldozer) চলবে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মন্দারমণির সংকট ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা। উত্তরপ্রদেশে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বিশেষ জনগোষ্ঠীর অভিযুক্তদের বাড়ি নির্বিচারে ভাঙা আর জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে ‘উপকূল নিয়ন্ত্রণ বিধি’ মেনে পদক্ষেপ যে এক বিষয় নয়, এ-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেটা জানেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও জানেন, ১৪৪টি হোটেল বুলডোজারের কবলে পড়লে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটে পড়বে। তাই, আইন প্রয়োগে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বুলডোজারের প্রয়োগ নয়, সমাধান সূত্র বের করার আন্তরিক তাগিদে আরও একটু সময়, আরও অনেক আলাপ আলোচনা, এমনকী আদালতের রায়ের পুনর্মূল্যায়নের ওপর আস্থা জ্ঞাপন। শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ হাতে হাত ধরে কাগুজে আইন নয় মানবিকতাকে, বাস্তবতাকে মূলধন করে এগোনোর চেষ্টা করবে।
আসুন বুঝে নিই, কেন বুলডোজার (Bulldozer) সংস্কৃতি বাংলায় বর্জ্য।
বুলডোজার কবে আবিষ্কৃত হয়েছিল, নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে ১৯২৩-এর ১৮ ডিসেম্বর জেমস কামিংস ও আর্ল ম্যাকলয়েড যে বুলডোজারের নকশা পেটেন্ট করার নথিপত্র জমা দিয়েছিলেন এবং ৬ জানুয়ারি, ১৯২৫-এ সেই নকশা অনুমোদন পেয়েছিল, তা প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
এবং একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরবর্তী একশো বছরে বুলডোজার ধ্বংসের প্রতীক হয়ে উঠলেও কখনও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠেনি। কৃষিক্ষেত্রের ট্রাক্টরের বিবর্তিত রূপ হিসেবে যে যন্ত্রের যাত্রা শুরু সেটাকে ন্যায় বিচারের উঠোনে টেনে হিঁচড়ে নামানোর কৃতিত্ব মেরুকরণে মেতে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনীতির।
গত তিন বছর ধরে ‘বুলডোজার ন্যায়’ আর ‘বুলডোজার বাবা’দের ঘিরে জয়ধ্বনি ভারতের রাজনীতিক সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছে তারা। প্রায় অপ্রতিহত গতিতে সেসব ছড়িয়ে পড়ছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশে, উত্তরাখণ্ড থেকে রাজস্থানে, সাধারণভাবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে। সুপ্রিম কোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছে ‘বুলডোজার ন্যায়’ কেবল বাড়িঘর গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিল না, ভেঙে ফেলছিল কতকগুলো মৌলিক বিষয়ও, ন্যায়ের শাসনের সংজ্ঞা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতি এবং সেইসঙ্গে নাগরিকের মৌলিক অধিকারও।
মঁতেস্কু প্রবর্তিত এবং ভারতীয় সংবিধানে অনুসৃত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে তিন রকমের কাজ করার জন্যই তো সরকারের তিনটি বিভাগ— বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগ। আইন বিভাগ, মানে সংসদ বা বিধানসভার সদস্যরা, এমএলএ আর এমপিরা আইন প্রণয়ন করবেন। শাসন বিভাগ, মানে পুলিশ-প্রশাসন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সেই আইন কার্যকর করবেন। আর প্রণীত আইনের প্রয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, নির্দোষ শাস্তি পাচ্ছে না দোষীরা ছাড় পাচ্ছে, সেটা দেখবে বিচার বিভাগ। কেউ দোষী না নির্দোষ, সেটা নির্ধারণ করা একান্তভাবে বিচার বিভাগের কাজ। ‘বুলডোজার ন্যায়’-এর ক্ষেত্রে সেই কাজটাই করছিল শাসনবিভাগ। সরকারি আমলা, মন্ত্রী, বিধায়ক, পুর প্রতিনিধিরাই কে দোষী তা ঠিক করে দিয়ে দোষীর কী শাস্তি হবে সেটাও ঠিক করে দিচ্ছিলেন। এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তা করা হচ্ছিল। সেখানেই বাদ সেধেছে শীর্ষ আদালত।
বুলডোজার ন্যায়ের সুবাদে বাসস্থানের অধিকারও ধূলিসাৎ হচ্ছিল। সংবিধানের ২১ নং ধারা বলছে, সম্ভ্রমের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা। সেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল কারণ, যে বাড়িতে অভিযুক্ত বাস করে, সেই বাড়িতে অনভিযুক্ত এবং সর্বতোভাবে নির্দোষ মানুষজনও বাস করে। অভিযুক্তের অপরাধের কারণে বাড়িটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে তার পাশাপাশি নির্দোষ নিরপরাধীরাও আশ্রয়চ্যুত হয়ে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার হারাচ্ছে। এটা অনভিপ্রেত। এটা বেআইনি।
এবং সরকারি আধিকারিকরা জনসাধারণের আস্থা ও সরকারি কাজে স্বচ্ছতার মতো বিষয়গুলোকে পাত্তাই দেননি। তাঁরা কানুন নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন, বাড়ি ধূলিসাৎ করার আদেশ জারি করেছেন এবং এসব অপকর্মের জন্য তাঁদের কোথাও কোনওরকম জবাবদিহি করতে হয়নি। এই বেপরোয়া ছাড়পত্রটাই সমস্যার ও আপত্তির কারণ।
আরও পড়ুন- উচ্চমাধ্যমিকের প্র্যাকটিক্যালের দিন ঘোষণা
সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, এবার থেকে বাড়ি ভাঙতে হলে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। তাতে বাড়ির বাসিন্দারা অন্যত্র সরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন কিংবা সেই নোটিশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ লাভের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। এরপরেও যদি বাড়ি ভাঙা পড়ে, তবে সেই ভাঙনকার্যের ভিডিও রেকর্ডিং করে সেটাকে ‘ইনসপেকশন রিপোর্ট’ ও ‘ডিমোলিশন রিপোর্ট’-এর অঙ্গীভূত করতে হবে।
যে বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে, সেটা সত্যিই বেআইনি নির্মাণ নাকি ভাঙার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ব্যবস্থাও রয়েছে সুপ্রিম-নির্দেশে। আশপাশের অন্যান্য বাড়ির গায়ে হাত না দিয়ে কেন একটা বিশেষ বাড়িকেই ভাঙার জন্য বেছে নেওয়া হল, তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হওয়ার নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
এই রায়ে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, রেলপথ বা রাস্তা নির্মাণ ও প্রসারণের স্বার্থে কোনও অধিগৃহীত সরকারি জমির ওপর গড়ে ওঠা নির্মাণের ক্ষেত্রে এই রায় কার্যকর হবে না। ফলত, এই রায়ের রক্ষা-পরিধির বাইরে রায় গেল বহু বস্তি, অনেক অস্থায়ী বাসস্থান, যেগুলো প্রান্তিক মানুষজনের মাথা গোঁজার জায়গা এবং রাষ্ট্রের মাতব্বরির সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গাও বটে। দীর্ঘদিন ধরে এরকম জায়গায় বাস করে আসা লোকজন তো এই সুপ্রিম রায় থেকে কোনও সুবিধা বা স্বস্তি পাবেন না। তাঁরাও তো ভোট দেন। তাঁরাও তো নাগরিক। তবে তাঁদের সম্ভ্রমের সঙ্গে বাঁচার অধিকারের কী হবে?
আমরা এনকাউন্টারের ইতিহাস জানি। ভুয়ো এনকাউন্টারে নিরপরাধ ব্যক্তিকে মেরে ফেলার ঘটনাও আমাদের অজানা নয়। যাঁরা গণতন্ত্রকে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলে মানেন তাঁদের সৌজন্যে এবং যাঁরা সব সময় একটা কঠোর শক্তিশালী সরকার গড়ে তোলার পক্ষে দাঁড়িয়ে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতাকে সদা ব্যঙ্গ করেন তাঁদের কারণে ‘খাপ পঞ্চায়েত’-এর মতো নির্দেশিকা জনমানসে অনেক সময়ই শিকড় গাড়ে। সেকথাও আমাদের অজানা নয়।
সেই সঙ্গে এটাও দেখেছি ঘৃণা ভাষণ কীভাবে রাজনৈতিক আদর্শের বুলডোজার হয়ে আমাদের সকল নৈতিক ও যৌক্তিক বিচার ভাবনাকে ঘুলিয়ে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় কিন্তু তাতে দাঁড়ি দিতে পারেনি।
সুতরাং, দিকে দিকে মানবতার পক্ষে স্লোগান তুলুন।
বুলডোজার ডোজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন।