প্রস্তাবনা
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে শিশুদের ভূমিকা সর্বদাই প্রাধান্য পেয়েছে যা বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মনে রাখার মতো ঘটনাই বটে। সত্যজিৎ রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ পথের পাঁচালী থেকে শুরু করে অপুর সংসার, তিন কন্যা, সোনার কেল্লা, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক-সহ প্রায় সব ছবিতেই শিশুদের দিয়ে যে কাজ করিয়ে নিয়েছেন, তা যে কোনও চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে শিক্ষণীয় বিষয়। শিশুদের সাথে চমৎকার রসায়ন ছিল পরিচালকের। শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারতেন। ফলে সেই কাজটাও হয়ে যেত অনায়াসে।
আবিষ্কার পর্ব
যে প্রসঙ্গে এই প্রস্তাবনা তা হল— সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র প্রধান দুই শিশু শিল্পীকে আবিষ্কার এবং তাদের দিয়ে অভূতপূর্ব কাজ করিয়ে নেওয়ার বিষয়টি। চরিত্র দুটির নাম দুর্গা ও অপু, দিদি ও ভাই। এই দুই ভূমিকায় উমা দাশগুপ্ত ও সুবীর চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় এই দুই শিশুশিল্পীকে আবিষ্কারের ঘটনাকে নিয়ে খুব সুন্দর করে লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমাদের কথা’ গ্রন্থে। অপু ও দুর্গাকে খোঁজা নিয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে প্রায় ইতিহাস হয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার। হাজার বাচ্চাকে ইন্টারভিউ করে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও দুই শিশুশিল্পী খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত বিজয়া রায় পাশের বাড়ি থেকে অপুকে (সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়) আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। আর দুর্গাকে খুঁজে বার করেছিলেন সত্যজিৎবাবুর ‘পথের পাঁচালী’র সহকারী পরিচালক এবং লেখক আশিস বর্মন। উনি একটা কাজে বেলতলা হাইস্কুলে গিয়েছিলেন একজন শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে উমা দাশগুপ্তকে দেখে আশিস বর্মনের খুব পছন্দ হয়ে যায়। উনি তখনই মেয়েটির নামধাম, ঠিকানা ইত্যাদি নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের কাছে এসে সব জানালেন। সত্যজিৎ রায় সময় নষ্ট না করে যোগাযোগ করে ওর বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে উমাকে তাঁদের বাড়িতে আসতে বললেন। যথা সময়ে উমা এল। বয়স তখন ১১/১২ বছর হবে। বেশ সেজেগুজে গলায় মুক্তার মালা পরে যখন বালিকা উমা ঢুকেছে, তখন তাকে দেখে কোনও রকমেই দুর্গা বলে মনে হয়নি বিজয়া রায়ের। সত্যজিৎ রায় উমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। বেশ চটপটে মেয়ে। বিজয়া রায়ের উপর আদেশ হল ওকে গাছকোমর শাড়ি পরিয়ে টেনে চুল বেঁধে ওদের কাছে হাজির করানোর জন্য। উমাকে সাজাতে সাজাতে বিজয়া বুঝতে পেরেছিলেন এত ভাল দুর্গা আর পাওয়া যাবে না। তাই তাঁর মন্তব্য ‘বড় সুন্দর চোখ, নাক, আর ঠৌঁট। তাছাড়া চেহারাও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত।’ সাজগোজ করে বিজয়া রায় যখন বসবার ঘরে নিয়ে এলেন উমাকে, তখন সত্যজিৎ হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন ‘এই তো দুর্গা।’ পরে বিজয়া রায় মন্তব্য করছেন, ‘সত্যিই তাই। রংটা ফর্সা নয়, কিন্তু মুখের মধ্যে এমন একটা ভাব আছে মনে হল যে, একেবারে গ্রামের মেয়ে। শহরের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই।’
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
উমা দাশগুপ্ত (সেন) জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাবনায়। তিনি তাঁর স্কুলে পড়াকালীন অনেকগুলো নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে সিনেমায় নামার ব্যাপারে যে একটা প্রশ্ন থাকে সেই হিসেবেই বাবা পল্টু দাশগুপ্ত প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না মেয়েকে চলচ্চিত্রে নামানোর ব্যাপারে। অবশেষে তাঁর বাবা রাজি হয়েছিলেন, শর্ত ছিল যে তিনি মেয়ের জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেবেন না ছবিটি থেকে। তবে উমাকে রবীন্দ্র রচনাবলীর এক সেট তুলে দেওয়া হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের তরফ থেকে।
আরও পড়ুন-জলাভূমি এলাকায় নির্মাণ নিয়ে নয়া নির্দেশিকা, চাই মৎস্য দফতরের আগাম অনুমতি
আরও কিছু কথা
এই ছবির যে দুই মুখ্য শিশুশিল্পী সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও উমা দাশগুপ্ত দু’জনেরই জন্ম হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে। দু’জনেই আর কোনও ছবিতে অভিনয় করেননি। ‘পথের পাঁচালী’ তাঁদের প্রথম এবং শেষ অভিনীত ছবি। এঁরা দু’জনে মিলে এই ছবি দেখেছিলেন ১৯৫৫ সালের ২৬ অগাস্ট বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে। সত্যজিৎ রায় এই ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা পাশাপাশি দু’জনে বসে যখন ছবিটি দেখছেন তখন ছবির শেষের দিকে (দুর্গার মৃত্যু হচ্ছে) উমা এবং সুবীর দু’জনেই কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পথের পাঁচালীতে অপু-দুর্গার মা সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটি তাঁরও প্রথম অভিনীত ছবি। সেখানে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উমা দাশগুপ্তের মুখের যথেষ্ট সাদৃশ্য দর্শকরা দেখতে পেয়েছিলেন।
নিশ্চিন্দিপুরের দুর্গা
নিশ্চিন্দিপুরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেলগাড়ি আর দেখা হয়নি দুর্গার বা বাবার নিয়ে আসা নতুন সেই শাড়ি আজও হয়তো রাখা আছে আলমারিতে। নস্টালজিয়াপ্রবণ বাঙালি এসবের মধ্যেই বাঁচতে ভালবাসে। আজও বাঙালি সেই স্মৃতিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। যে স্মৃতিতে আজও দুর্গা-অপু তরুণ হয়েই আছে। তবে সময় তো আর এক জায়গায় থেমে থাকে না! ১৯৫৫ সালের দুর্গা আর আজকের উমা দাশগুপ্ত (সেন) একই বয়সে নেই। বয়সের ভার তাঁকে গ্রাস করেছিল নিয়ম মেনে। যদিও মন ছিল বরাবরই সজীব সতেজ। ছবির জগৎকে জানিয়েছিলেন বিদায়। তিনি এই প্রথম ছবিতেই অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলেন এবং তাঁর চিত্রগ্রহণের সময় খুব কম রিটেক হয়েছিল, এটি মুখে মুখে ফিরছিল ফলে অনেক ডাক পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেই ডাকে কখনওই সাড়া দেননি। এমনকী নিজের পরিচয়টাকেও তিনি রেখেছিলেন ছবির জগতের বাইরে। তিনি যাদবপুর বিদ্যাপীঠে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। যখন তাঁর ৬০ বছর বয়স তখন তিনি সেখান থেকে অবসর নিয়েছিলেন। অনেকদিন আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে এক অতিথি আরেক অতিথিকে চেনাচ্ছেন, বলছেন ইনি হচ্ছেন দুর্গার বাবা। কিন্তু সত্যিকারের দুর্গার বাবা অর্থাৎ পল্টু দাশগুপ্ত তাঁকে সঠিক করে দিয়ে বললেন, ‘না এ হল মোহনবাগানের ফুটবলার পল্টু দাশগুপ্তর মেয়ে!’
আরও পড়ুন-আদানি গোষ্ঠীর সব চুক্তি বাতিল করলেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট
স্মৃতিটুকু থাক
সারা ছবি জুড়ে এই দুই ভাই-বোনের যে কাণ্ডকারখানা আমরা দেখি, সেটা মাথায় আজীবন গেঁথে থাকে। দুর্গার আমড়া খেয়ে দাঁত টকে যাওয়া, ভাইকে পরম মমতায় চুল আঁচড়ে দেওয়া, বুড়ি ঠাকুরমাকে ডেকে অনুনয় করা আর ঝড়-জলের রাতে সবাইকে শূন্য করে চলে যাওয়া— সব স্মৃতিতে থেকে যায়। আর থেকে যায় নিশ্চিন্দিপুরের সেই রেললাইনের নুড়ি-পাথরের স্মৃতি আর সঙ্গে থেকে যায় একরাশ কাশফুল। আসলে দুর্গা আর অপু দুই ভাই-বোনের এই স্নেহবন্ধন বাঙালি কোনওদিন ভুলতে পারবে না। দুর্গার নিষ্পাপ চোখ আর কোমল মুখে আনন্দ-দুঃখের অভিব্যক্তি বারবার ছুঁয়ে গিয়েছে দর্শকদের হৃদয়। রেলের বাঁশি শুনে কাশবনের মধ্য দিয়ে দুই ভাইবোনের উদ্দাম দৌড়, মিঠাইওয়ালা দেখে আনন্দ কিংবা ফলচুরি ও পুঁতির মালা চুরির মধ্যে অসাধারণ ভাব দুর্গা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা কোনওদিন ভোলা যাবে না। বৃষ্টিতে স্নানের সেই দৃশ্য, আর মৃত্যুদৃশ্য দেখে বাঙালি দর্শকরা কেঁদে আকুল হয়েছেন। আর আজ জীবন থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। শুধু সেলুলয়েডে বেঁচে থাকবেন দুর্গা তার করুণ দুটি চোখ নিয়ে।