লোকে বলে নারীর নাকি হয় না কোন ঘর
নারী ছাড়া একলা কভু ঘর বাঁধে না নর
––ফিরদৌস আহমেদ
মেয়েদের হয় না কোন ঘর
এ এক প্রশ্নাতীত প্রশ্ন। সত্যি কি নারীর পায়ের তলায় মাটি আছে, সত্যি কি ঘর হয় তাঁদের? ভার্জিনিয়া উলফ, তাঁর ‘আ রুম অব ওয়ান’স ওন’ বইয়ে লিখেছিলেন, নিজের টাকা আর সম্পূর্ণ নিজের একটা ঘর, এ দুটো জিনিস না থাকলে কোনও নারীর পক্ষে সৃষ্টিমূলক রচনা সম্ভব নয়। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। ভার্জিনিয়া উলফ আসলে নারীর একান্ত নিজের অধিকারের একটি কামরার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কেটে গেছে প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময়। মেয়েরা কিন্তু আজও বাস্তুহারা। বাপের ঘর আর শ্বশুরঘর নিদেনপক্ষে গর্ব করে বলার স্বামীর ঘর। এই তিনঘরের তিনপদ জমিতেই একটা মেয়ের জীবনকাল অতিবাহিত হয় আজও। সমাজ বদলেছে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজও বদল হয়নি মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের।
বাড়ির ঠিকে কাজের মাসি হোন বা উচ্চশিক্ষিতা কর্পোরেট লেডি, এই জায়গায় সব মেয়েই এক। পিতৃসম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার তো অনেক আগেই আইনত স্বীকৃত, কিন্তু আজও বহু মেয়ে বাপের বাড়ির সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দিয়েই খুশি থাকেন। তাঁদের বোঝানো হয়, বাবা-মা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি তো তোমারই। এমনকী যে মেয়েরা, ভাই বা দাদা থাকা সত্ত্বেও পৈতৃক সম্পত্তি দাবি করেন, সমাজে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থপর বলে চিহ্নিত হন। মেয়েদের আবার দাবি কী? কে বুঝেছে মেয়েদের দাবিদাওয়া!
আরও পড়ুন-আদানি গোষ্ঠীর সব চুক্তি বাতিল করলেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট
কে বুঝেছে মনকেমনের ঝড়
কল্যাণী সকালে মিউনিসিপ্যালিটিতে পার্ট টাইম কাজ করে আর দুপুরের পরে বিউটিপার্লারে থাকে রাত অবধি। মাঝখানে খাবারটুকু খেতে বাড়ি আসে। দুই ভাই এক বোন। মা একার সংসারে কল্যাণীই অন্ধের যষ্টি। সবটা করে একা হাতে অথচ ভাতের পাতে ওর ভাগ্যে পড়ে শুধু নিরামিষ ডাল আর সবজিটুকুই। মা-ও তাই খায়। আসলে ভাইগুলো বড় হচ্ছে ওদেরই বেশি পুষ্টির দরকার তাই মাছটা ওদের পাতে। যেদিন সবার মাছ হয় সেদিন শেষটুকরো জুটে যায় কল্যাণীর। ভাগের মা কথাটা শোনা যায় কিন্তু ভাগের মেয়ে শব্দটা অনেকের কাছেই অজানা। যতই বলি না কেন মেয়েদের অধিকার ছেলেদের সমান, বাস্তবে তা নয়। আসলে মেয়েরা তো ভাগেরই হয়। তাঁর মনটা প্রথম ভাঙে, বুকটা ফাটে কিন্তু মুখ ফোটে না। বাবার বাড়িতে মা যখন নিজে হাতে মাছের সবচেয়ে বড় পিসটা তাঁর স্বামী বা পুত্রের পাতে তুলে দেন। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি যখন তার সামনেই মাছ-মাংসের বড় পিসটা ছেলের পাতে তুলে দেয়। তখন মনটা হু-হু করে ওঠে নিশ্চুপে। আসলে খুব ছোট থেকেই এমন ছোট ছোট স্যাক্রিফাইজে গড়ে ওঠে এক নারী জীবন। সেই নারী কখনও মা হয়ে, বোন হয়ে, বউমা হয়ে একটু একটু করে ছাড়তে থাকে সবটা। সংসারের উচ্ছিষ্টে অধিকারী হয়ে রয়ে যায়। শৈশবের সব পাওনাগন্ডার হিসেব এক নিমেষে চুকিয়ে অন্য পরিবারে সর্বংসহা হয়ে লড়াইয়ে নামে। কে কবে বুঝেছে সেই মেয়েটির মন!
আরও পড়ুন-দুর্গা বিদায়
বোকা হয়েই থাকল একা মেয়ে
বধূনির্যাতনের আইন নিয়ে লোকে এত মাতামাতি করে এটা ভেবে যে ঝটপট অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কেউ কি কখনও এটা ভেবেছেন যে একজন মহিলা তো শুধু বউ নন, তিনি মেয়ে, মা, বোন-মাসি-পিসি বা কাকি, জেঠি তাঁর অন্য নানা সম্পর্কে রয়েছেন। তিনি স্বামী, শ্বশুর ছাড়াও বাবা-ভাই, ছেলে বা অন্য কোনও আত্মীয়ের হাতে পাড়াপড়শি, পথচারীরা নির্যাতিত হতে পারেন। পাশের বাড়ির কাকু কেন নিজের কাকু, নিজের জেঠুর কাছেও তো সে মেয়েই। সমীক্ষা বলছে প্রতিটা মেয়ে কোনও না কোনও সময় তার পরিবারের আপনজনের কাছেই মোলেস্ট হয়েছে। তাঁদের অধিকার রক্ষার আইনের এখন ছড়াছড়ি। গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধ আইন ছাড়াও বলবৎ হয়েছে আরও অনেক আইন। যা একজন মহিলাকে সুরক্ষা দিতে পারেই। কিন্তু কোনও মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে বা অন্য কোনও ভাবে মোলেস্টেশনের শিকার হলে কোথায়, কীভাবে অভিযোগ জানাবেন, সেটা নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা তাঁদের একেবারেই নেই। মেয়েরা যে সর্বত্র অসহায়। মাথার উপর একজন পুরুষের হাতই আজও তাঁদের সহায় সম্বল। একা মেয়ে যে বোকা মেয়ে এটাই তো সমাজের কথা। ছোট্ট থেকে পেয়ে আসা হিউমিলিয়েশন চাপে বড় হয়ে ওঠা এক নারীর মনের কষ্ট কে জেনেছে?
আরও পড়ুন-জলাভূমি এলাকায় নির্মাণ নিয়ে নয়া নির্দেশিকা, চাই মৎস্য দফতরের আগাম অনুমতি
সফল নারীই বিফল বেশি
সৌমেন আর পায়েল একসঙ্গে ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিল। একসঙ্গে ডেইলি ভ্লগ করত তারা। দু’জনেই কর্পোরেটে কর্মরত। সাবস্ক্রাইবার বাড়ছিল হু-হু করে। হাজার সাবস্ক্রাইবার হল এক বছরেই। হঠাৎ সব যেন কেমন বদলে গেল। আসলে পায়েল যে বেশি সফল। এখানেই তো যত গোলমাল সফল নারী আসলে জীবনের খাতায় অসফলই। তাকে কেউ মেনে নিতে পারে না। সৌমেনের সঙ্গে খুঁটিনাটি নিয়ে অসম্ভব ঝগড়া, ইগোর লড়াই, তিক্ততা বাড়তে থাকল। বিষয়টা এমন পর্যায়ে গেল যে আর একছাদের নিচে থাকা গেল না। না পায়েল ছাড়েনি, সৌমেনই ছেড়ে চলে গেল পায়েলকে। ইগোর লড়াই এমন যে সৌমেন নিজে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে। এরপর আর কী? মেয়ে হওয়ার ক্ষতিপূরণ যে তাকে দিতেই হবে। পায়েলের চ্যানেলে ক্রমাগত কুমন্তব্য, ট্রোলিং। নানান প্রশ্ন। দাদা কোথায়? দেখা যাচ্ছে না কেন? দিদিভাই কি দাদাকে তাড়িয়ে দিয়েছে? সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে আর তাতেই এত দেমাক? একা ফ্ল্যাটে এখন কি ফুর্তি হবে? পায়েলের পরিবারই যে ছিছিক্কার করছে। এক ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর লাইফ কাটানো বিবাহবিচ্ছিন্না যে বড়ই সস্তা। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। মেয়েদের চেহারা কালো হলে ট্রোলিং-এর শিকার, চেহারা রোগা হলে ট্রোলিং-এর শিকার, স্বামী নেই ট্রোলিং, বয়ফ্রেন্ডের আছে ট্রোলিং। একলা মেয়ে সেও ট্রোলিং-এর শিকার আর যে একলা নয়, সেও। এমন হিউমিলিয়েশন তো মেয়েদের জীবনের ছত্রে ছত্রে লেখা। মেয়েদের দাবি-দাওয়া। মেয়েদের চাওয়া-পাওয়া সবকিছুই যে সোনার পাথরবাটি। মেয়েদের মন বলে আসলে কিছু হয় না।
শরীরের আর দোষ কী
গোটা জীবন জুড়ে পিরিয়ড হওয়া এবং না হওয়ার ঝক্কি সামাল দিতে দিতে মেয়েরা ক্লান্ত। পিরিয়ড আজও এক ট্যাবু। শরীরের এই জেহাদি মনোভাব তাদের মনকেও একলা করতে থাকে প্রতিমুহূর্তে। স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার অনুসর্গ উপসর্গের ভিড়ে নাটাঝামটা খেয়ে বড় হতে থাকে নারী। সেও যে অচ্ছুত এবার সেটা বুঝতে পারে। আর এই অনুভূতি আসে পরিবার থেকেই। সমাজ পরিবার বিচ্ছিন্না অচ্ছুত মেয়েটি তখন মুড স্যুইং, অবসাদ, অ্যাংজাইটি, বিরক্তি, রাগ, কান্না, অস্থিরতা— এই সব ভারী ভারী যন্ত্রণাদায়ক ইমোশনগুলোকে বোঝার মতো কাঁধে, পিঠে, সারা শরীরে নীরবেই বয়ে চলেছে। কেউ জানতেই পারছে না। এরই মাঝে পড়াশুনো, স্কুল, কলেজের, পরীক্ষা, অফিসের টার্গেট পূরণ, দায়িত্ব সবটাই চলে নিয়মমতে। প্রবল যন্ত্রণায় কাতরেও মাসের ওই দু’একটা দিন তাঁরা ম্যানেজ করে নেয়। এতদিন পর মুম্বইয়ের দুটি সংস্থা মহিলা কর্মীদের জন্য পিরিয়ডের প্রথম দিনটিতে সবেতন ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাকিরা? তারা তো ওই দিনগুলোতেই মুখ বুজে ঘরকন্না থেকে ট্রামে বাসে মাঠে ঘাটে অফিসে দোকানে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যায়। আর জায়গা ছাড়ার তো প্রশ্নই উঠছে না। কারণ এত বছর ধরে এই সমানাধিকারের লড়াই-ই তো করে এসেছে মেয়েরা।
পুরুষদের সমান হতে গিয়ে সবাই এটা ভুলে যায় যে, শুধুমাত্র পুরুষ কর্মীদের কথা ভেবেই সাজানো কর্মক্ষেত্রটি সাজানো হয়। মহিলা কর্মীরা এসে শুধুমাত্র যোগ দেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে পরিকাঠামো, কথাবার্তা, চলাফেরা, সুযোগ-সুবিধা সমস্তটাই মূলত পুরুষ কর্মীদের শর্তে নির্ধারিত হয়। মেয়েরা অ্যাডজাস্ট করে নেয় মাসের ওইদিনগুলোর কষ্ট আর অসুবিধেকে। ওই প্রতিকূলতা নিয়ে বাঁচাটাই যে তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে কখন তা নারী নিজেও আর মনে রাখেনি।
আরও পড়ুন-বাচ্চাদের মাথায় হেলমেট না পরালেই জরিমানা! কড়া পদক্ষেপ কলকাতা পুলিশের
মন আর হরমোন
সেঁজুতির ৪৫ বছর বয়সে ইদানীং প্রায়ই অনেক বিষয় ভুলে যাচ্ছে সে। প্রায়শই ক্লান্তি বোধ করে। ডাক্তারের নির্ধারিত ঘুমের ওষুধ ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারে না। অহেতুক দুশ্চিন্তা করে। দুশ্চিন্তার প্রভাব এতই বেশি যে হঠাৎ করে তার বুক ধড়ফড় শুরু। মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তবে বিশেষ কোনও রোগ ধরা পড়ে না। অনিয়মিত হয়ে গেছে পিরিয়ড। ডাক্তার হেসে বলেন, ‘এই সময় একটু এমন হয়েই থাকে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।’ সময়টাই যে বড় বালাই।
শরীরে মনে এক অসম্ভবের লড়াই শুরু হয়েছে তার। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। ভাল থাকার আর না-থাকার লড়াই বলাটাই ভাল। সেঁজুতির মতো হাল ঋতুবন্ধে সব মহিলার কম বেশি হয়। এই অসহায়তা সহন করতে করতেই সংসারের হাল ধরে থাকে লক্ষ লক্ষ মেয়ে। কাজের লোক কামাই দিলে বাসনটি তাকেই মাজতে হয়। পিছনে পড়ে থাকা বয়সের ধাপগুলো পেরিয়ে মনে জমা হয় একগাদা অবসাদ। আমার জীবন শেষ, স্বামী হয়তো আর আমার দিকে ফিরেই তাকাবেন না বা আমি আমার সন্তানদের কাছ থেকে খুব দূরে সরে গেলাম। মনে হয় সারা জীবনের জন্য অক্ষম হয়ে গেলাম। এইরকম হাজার দুশ্চিন্তার ভিড়ে রোজনামচা কাটাতে কাটাতে লড়াই চলে তার নিজের সঙ্গেই প্রতিনিয়ত।
নারী তো একলাই
একটা দুর্ঘটনায় মারা যায় শোভাদির বর। ছেলেকে একাই মানুষ করেছেন তিনি। স্বামীর চাকরিটা পেয়েছিলেন ভাগ্যচক্রে, এখন সরকারি পেনশনভোগী। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আজ তিনি একা। ছেলে বিয়ে করে সংসার পেতেছে আলাদা। ফোন আসে ছেলের যখন ওর টাকার প্রয়োজন পড়ে। তার বাইরে খোঁজও নেয় না। বৃদ্ধ বয়সে ছেলের সংসারের প্রয়োজনটাও তাঁকেই মেটাতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে সন্তান লালনপালন করে, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে একটা সময় মায়েরা ভুলেই যায় যে মাতৃত্বের বাইরে তাদের কোনও আলাদা অস্তিত্বও রয়েছে। হঠাৎ করেই ঘোর কাটে। মায়েদের মেনোপজের সময় আর সন্তানের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার সময়টা বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এক হয়। ফলে শরীরে মনে যখন প্রবল দোলাচলতা তখনই এক এক করে সম্পর্কের সুতোগুলো আলগা হতে থাকে। মেনোপজের হরমোনের গড়বড় আর জীবনের বড়-বড় রদবদলগুলো এক জায়গায় এসে মেলে। সন্তান পড়াশোনা করে সফল হয়, বিয়ে হয়ে যায়। নারী আবার তুমি একা। স্বামী এবং সন্তানের স্বাধীন জীবনের ফাঁকে ব্রাত্য নারীর আরও এক লড়াই শুরু হয় অস্তিত্ব রক্ষার। নারীর মনের এমন অসংখ্য দাবিদাওয়াগুলো কোথায় যেন একটু একটু করে হারিয়ে যায়।