গত অর্থবর্ষের প্রথম তিনটি ত্রৈমাসিকে দেশের জিডিপি বেড়েছিল ৮ শতাংশের বেশি। শেষটিতে ছিল ৮ শতাংশের কাছাকাছি। তার পরেই চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে অর্থাৎ গত এপ্রিল-মে-জুনে বৃদ্ধির হার নেমে আসে ৬.৭ শতাংশে। আশঙ্কা, জুলাই-অগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা আরও শ্লথ হতে পারে। এই দিনই সমীক্ষা রিপোর্টে মূল্যায়ন সংস্থা ইক্রার পূর্বাভাস, ওই তিন মাসে বৃদ্ধির হার নামতে পারে ৬.৫ শতাংশে। আশঙ্কা যে অমূলক নয়। কারণ, চলতি অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে তার আগের দুই ত্রৈমাসিক কিংবা আগের বছরের জায়গায় নেই কিছু পণ্য এবং পরিষেবার হাল। কেন্দ্রীয় আর্থিক বিষয়ক সচিব অজয় শেঠের বক্তব্য, খাদ্যপণ্য বাদে মূল্যবৃদ্ধি আর ভারতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে না। আর এখানেই গোল বেঁধেছে।
আরও পড়ুন-মেয়েদের মন মেয়েদের দাবি
এখন আর আড়াল-আবডাল নয়। মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্যেই তীব্রতর হচ্ছে। সরকার দাবি করছে, মূল্যবৃদ্ধি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এবং এর সঙ্গে আর্থিক গতি বা রেপো রেটের সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই ফর্মুলা মানতে নারাজ আরবিআই। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরকারের দাবির বিরোধিতা করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস জানিয়ে দিলেন, মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করাই অর্থনীতির গতিবৃদ্ধির প্রধান দাওয়াই। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এলে মানুষ সঞ্চয় করতে পারবে। আর হাতে টাকার জোগান থাকলে বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা। একমাত্র তা হলেই অর্থনীতি এবং বাজার গতি পাবে। সরল অঙ্ক। মূল্যবৃদ্ধির হার স্থিতিশীল থাকা সবথেকে বেশি প্রয়োজন। অর্থাৎ, কেন্দ্রের সম্পূর্ণ উল্টো মেরুতে অবস্থানই পাকাপোক্ত করছে আরবিআই। ঠিক এই কারণেই শক্তিকান্ত দাস বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সম্মেলনের একটি অনুষ্ঠানে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, তাদের কাছে পাখির চোখ একটাই— মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরানো।
মোদি সরকারের অস্বস্তির কারণ অবশ্যই রেপো রেট। কারণ, মূল্যবৃদ্ধির জন্য আরবিআই কিছুতেই রেপো রেট কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আর এতেই চটছে কেন্দ্র। তাদের ক্ষোভ, মূল্যবৃদ্ধির (বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি) কারণকে অজুহাত দেখিয়ে আর কতদিন রেপো রেট আকাশছোঁয়া থেকে যাবে? গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এই যুক্তিতেই তোপ দেগেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। তাঁর দাবি ছিল, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অতিরিক্ত হইচই হচ্ছে। এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজনই নেই। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন। তাই রেপো রেট এখনই কমানো উচিত। সেবারও জবাব দিয়েছিলেন গভর্নর। কিন্তু এভাবে মূল্যবৃদ্ধিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরের তকমা দিয়ে কেন্দ্রের বিরোধিতা করেননি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মন্তব্য সরাসরি অগ্রাহ্য করা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তার জন্য প্রোটোকল বহির্ভূত। তাই তিনি শুধু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, রেপো রেট সাড়ে ৬ শতাংশে রেখে দেওয়ার জন্যই কিছুটা হলেও সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরানো গিয়েছে। তার পরও কিন্তু খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রয়েছে উদ্বেগের চরম সীমাতেই। এদিন কিন্তু শক্তিকান্ত দাস সরাসরি বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধিকে স্থিতিশীল রাখতেই হবে। তাহলেই গরিবের বোঝা কমবে।
মূল্যবৃদ্ধির হার অগ্রাহ্য করলে আবার সব হিসেবে গোলমাল হয়ে যাবে। আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে গভর্নর সন্তুষ্ট হলেও বর্তমানে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাঁকে উদ্বেগেই রেখেছে। আরবিআই গভর্নরের বক্তব্য, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দ্রুত ৫ শতাংশের নিচে নামাতেই হবে। এখানেই বিরোধ বাড়ছে দু’পক্ষের। কারণ এখন কেন্দ্রের লক্ষ্য, উৎপাদনের হার বাড়ানো। তাহলে বাণিজ্যিক সক্রিয়তা বাড়বে। কিন্তু ব্যাঙ্ক ঋণের উপর সুদের হার, অর্থাৎ রেপো রেট না কমালে সরকারের এই মরিয়া প্রচেষ্টা অধরাই থেকে যাবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নীতি নির্ধারণ কমিটির কমবেশি ছ’জন সদস্যই কিন্তু একজোট— আগে খাদ্য-মূল্যবৃদ্ধির রাশ টানতে হবে।
আরবিআই বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বরের সব ঝুঁকি এবং উদ্বেগকে পিছনে ফেলে নতুন করে মাথা তুলছে আর্থিক কর্মকাণ্ড। দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা বাড়ছে।
আরও পড়ুন-দুর্গা বিদায়
কিন্তু সত্যিটা হল, সরকারি ব্যয় এবং খরিফ শস্য বপন বাড়লেও, খনন এবং বিদ্যুতের মতো ক্ষেত্রে উৎপাদন কমার আশঙ্কা। চিন্তার কারণ খুচরো বাজারে ক্রেতার আনাগোনা এবং রফতানি কমও। সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যক্তিগত ঋণবৃদ্ধির হার ধাক্কা খাওয়া, ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা এবং পণ্যের চড়া দামের ঝুঁকি। ভাল বর্ষা, পোক্ত মজুত এবং উন্নত খরিফ উৎপাদন ছবিটা বদলাতে পারে কি না, সেটাই দেখার।
তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সরকার বনাম কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এই ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’র ফল আর তার জাঁতাকলে আম আদমি।