আমরা ছাত্রদল

যে কোনও গণবিপ্লব সবসময় সংঘটিত হয়েছে ছাত্রদের হাত ধরেই। সদ্য পেরিয়ে এলাম ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্টস ডে বা ‘শিক্ষার্থী দিবস’। আন্তর্জাতিক স্তরে শিক্ষার্থীদের একত্রিত করতে প্রতিবছর পালিত হয় দিনটি। এই দিনটির উদযাপনের পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। লিখছেন সোহিনী মাশ্চারক

Must read

আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব বরাবরই সংগঠিত হয়েছে ছাত্রদের হাত ধরে। আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করে গণতন্ত্র নির্বাসিত করে মানবাধিকার যখন বিপন্ন হয়, এই ধরনের স্বৈরাচারকে সমূলে উৎখাত করার জন্য বারবার ছাত্ররাই এগিয়ে আসে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে ছাত্রদের লড়াইয়ে নামার ইতিহাস আমরা বহু দেখেছি। এ-নিয়ে কলমও ধরেছেন বহু কবি ও লেখক— বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে গেলে—
আমরা ধরি মৃত্যু রাজার
যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
হাসির দেশে আমরা আনি
সর্বনাশী চোখের জল
আমরা ছাত্রদল।।

আরও পড়ুন-দাম নিয়ন্ত্রণে টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে বৈঠক মেয়রের সমাধানে ব্যবস্থা, আজ থেকেই ন্যায্য মূল্যে মিলবে আলু

সমাজমানসের প্রতিভূ ছাত্রদের ওপর দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রগতি অনেকখানি নির্ভরশীল। ছাত্ররা তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে অসীম ধৈর্য, মেহনতের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে পারে একটা সুশৃঙ্খল সমাজ তথা সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। এই ছাত্ররাই যখন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, গর্জে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখন গড়ে ওঠে সক্রিয় আন্দোলন— বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তাই নিজের দেশেই তারা তথাকথিত শাসক শ্রেণির দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছে বারবার। তাই ছাত্র আন্দোলন ছিল আছে থাকবে। যুগ যুগ ধরে চলা দুর্নীতি-অপশাসন আর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের স্বীকৃতি হিসেবে ও তাদের এই প্রতিবাদী সত্তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে বিশ্বব্যাপী ১৭ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস উপলক্ষে পালন করা হয়।
এই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবসের নেপথ্যে থাকা সমস্ত কাহিনি জানতেই চোখ রাখব ইতিহাসের পাতায়, ফিরে যাব ৮৫ বছর আগে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশপাশের সময়ে।

আরও পড়ুন-ভোটের ময়দানে ‘আনাড়ি’ পিকে, ৪ আসনেই হারল জন সুরজ দল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, ১৯৩৯ সালের ১৫ মার্চ নাৎসি বাহিনী অর্থাৎ নাজি-জার্মানরা তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ায় (যা বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) আগ্রাসন চালায় ও দখল করে নেয় পুরো দেশটি কিন্তু এইভাবে চেকোস্লোভাকিয়াকে দখল করে নেওয়ার ঘটনাটি কিছুতেই প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়, চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মেনে নিতে পারেনি এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। ১৯৩৯ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় ছাত্ররা স্বাধীন চেকোস্লোভাকিয়া প্রজাতন্ত্রের দাবিতে এক বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করে, যাকে তখন ‘বোহেমিয়া ও মোরাভিয়ার প্রতিবাদ’ (the protectorate of Bohemia and Moravia) বলে অভিহিত করা হয়েছিল আর এই আন্দোলন তারা ছড়িয়ে দিতে থাকে দেশব্যাপী বিস্তৃত সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই সময় জন অপলেটাল নামে এক নেতৃস্থানীয় শিক্ষার্থী, ১৫ নভেম্বর প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রাগ থেকে মোরাভিয়ায় নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন, এমন সময় জার্মান সেনারা তাঁকে হত্যা করে। তাঁর এই মৃত্যু যেন ওই আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সমগ্র ছাত্রসমাজ, শুরু হয় নাজি-বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু হত্যার নেশায় উন্মত্ত নাজিরা কঠোর হস্তে দমন-পীড়ন শুরু করে, ছাত্রদের ওপর অত্যাচার শুরু করে এবং ছাত্রসমাজকে রুদ্ধ করে রাখতে চেয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় তারা, বারোশোর বেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে সংশোধন কেন্দ্র বা concentration camps-এ পাঠানো এমনকী বিনা বিচারে ৯ জন ছাত্র ও শিক্ষককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, ছাত্রসমাজের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয় ঠিক এতটাই নিষ্ঠুর ভাবে।

আরও পড়ুন-ছুটি-বৈষম্য নিয়ে সিআইএসএফের জওয়ানরা কোর্টে

এই ঘটনার বছর ৩৪ পর গ্রিসে অনুরূপ ঘটনা ঘটে। তৎকালীন গ্রিসে ক্ষমতায় ছিল সামরিক জান্তা— তাদের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে আর গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে ১৯৭৩ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে দেশ-জুড়ে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিল গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে অবস্থিত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা, আর তারা চালু করে জান্তা-বিরোধী এক রেডিও প্রচারণা যার যন্ত্রপাতি তারা তাদের ব্যবহারিক পরীক্ষাগার থেকেই সংগ্রহ করে আনে। এই সম্প্রচার চলাকালীন ১৭ নভেম্বর তারিখে সকালে অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের তরফে এএমএক্স ৩০ ট্যাঙ্ক পাঠানো হয়েছিল যা এথেন্স পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রধান গেটের দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে যদিও হতাহতের বিষয়টি আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি তবে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। সামরিক জান্তার এই আগ্রাসন আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে; বিক্ষোভে উত্তল হয়ে ওঠে সারা দেশ, জায়গায় জায়গায় ছাত্রদের সঙ্গে শুরু হয় জান্তা সমর্থক ও সেনাদের সংঘর্ষ। এর ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা থেকে শেষমেশ বিদায় নিতে হয় জান্তাকে।
১৯৪১ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক ছাত্র সংস্থার এক সম্মেলনে উদ্বাস্তু শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সর্বপ্রথম এই ১৭ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ঠিকই কিন্তু তখনই এই দিবসটির স্বীকৃতি মেলেনি তা মিলেছে বহু বছর পর। পরবর্তিকালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের তরফে স্বীকৃতি পাওয়ায় ২০০০ সাল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দিবসটিকে বিশেষ দিবসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে এই দিবসটি চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া এবং গ্রিসে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

আরও পড়ুন-বড় মার্জিনে ওয়েনাড় জয়ী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী

সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছাত্ররা এই দিনটিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিভিন্ন সভা-সম্মেলন থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় ও সর্বোপরি দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরা হয় জনসাধারণের সচেতনতার সুবাদে এবং যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশেষ দিনের সূচনা তা যাতে মানুষ মনে রাখতে পারে তার জন্য এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখালেখিও করা হয়, বিভিন্ন ছবি পোস্ট করা হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের সংকটকালে ছাত্ররা যে আত্মাহুতি দিয়েছন বারংবার তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট দিনকে কেন্দ্র করে তাঁদের স্মরণে এনে তাঁদের বলিদানের সঠিক মূল্যায়ন কতটা যে হচ্ছে তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

Latest article