সুহানির স্বপ্নের সৌরযান

দ্বাদশ শ্রেণির সুহানি চৌহানের স্বপ্ন ছিল কৃষকদের কষ্ট লাঘব করার। দীর্ঘ প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়ে তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন তিনি। তৈরি করেছেন এক সৌরচালিত কৃষিযান। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী স্বপ্নকার

Must read

বয়স সতেরো, নাম সুহানি চৌহান, অ্যামিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, পুষ্পবিহারের দ্বাদশ শ্রেণিতে পাঠরতা এই কিশোরী স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষকদের কষ্ট লাঘব করার আর এই নিরাকার স্বপ্নকেই সার্থক করতে তিনি নিজের চেষ্টায় তৈরি করে ফেলেন এমন এক কৃষিযন্ত্রের যা একাধারে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাবে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি করবে দ্বিগুণ হারে, আবার অন্যদিকে তাঁদের চাষাবাদ পদ্ধতিকেও করে তুলবে অধিক দক্ষ যা কৃষকদের লাভ অর্জনের সহায়ক হবে। সুহানির বানানো এই So-Apt নামক যন্ত্র হল একটি সৌরচালিত কৃষিযান যা ২ লক্ষ ৭২ হাজার মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ কমাতে সক্ষম।

আরও পড়ুন-মালা রায়ের প্রশ্নের উত্তরে হোঁচট খেলেন কেন্দ্রের মন্ত্রী

স্বপ্নের জন্ম
কৃষকদের সাহায্য করার ভূত অনেকদিন আগেই চেপে বসেছিল সুহানির মাথায়, সেই যখন তিনি মাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। একবার এই শ্রেণিতে পড়াকালীন তাঁদের মানেসারের খামার পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয় আর সেইবারই প্রথম চেপে বসে সেই ভূত, কৃষকদের সাহায্য করার তাগিদ। তপ্ত রোদে কৃষকদের পরিশ্রম বোধহয় সেই কচি হৃদয়কে নাড়া দেয়, আর তারই ফলস্বরূপ সুহানির এই যন্ত্রের সৃষ্টি। তিনি স্বীকার করেন যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় কৃষকদের আত্মহত্যার হৃদয়বিদারক পরিসংখ্যান। তাঁর এই প্রচেষ্টা ছিল সম্পূর্ণরূপেই সংগ্রামী কৃষি সম্প্রদায়ের জন্য, বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য।
সুহানির মতে, ‘ So-Apt অ্যাগ্রো’-র সঙ্গে মাত্র এক শতাংশ ট্রাক্টর অদলবদল করে, আমরা প্রতি বছর ডিজেল খরচের আনুমানিক ২১৭০ লক্ষ টাকা সাশ্রয় করতে পারি, এরই সঙ্গে বছরে ২ লক্ষ ৭২ হাজার মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণও কমাতে পারি আমরা, যা একাধারে অর্থনীতি ও অন্যদিকে সুস্থায়ী পরিবেশ গড়ে তুলতে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কল্পনা থেকে বাস্তবে পা
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক যন্ত্রের ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সুহানির। যেই ভাবা সেই কাজ, তৎক্ষণাৎ কাগজে নিজের ভাবনা এঁকে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যায় সে। পরবর্তীতে, সেই ধারণা বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করে এবং এক বছর পরে, একটি কপিরাইটের জন্য আবেদন করে শুরু হয় So-Apt যন্ত্র তৈরির কাজ। তাঁর কল্পনাগুলিই ধীরে ধীরে So-Apt এগ্রোকে আকার দিতে থাকে।
So-Apt যন্ত্র হল একটি বহু-কার্যক্ষম সৌরচালিত কৃষিযন্ত্র যা ফসলের জন্য মাটিকাটা, বীজবপন, সেচ এবং সার দেওয়ার মতো কাজ করতে সক্ষম। এটি কৃষকদের জন্য একাধিক যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা রাখে। বলাই বাহুল্য, যেখানে প্রচলিত ট্রাক্টরের দাম ৫ লক্ষ টাকার বেশি, সেখানে So-Apt যন্ত্রের দাম হল মাত্র ২ লক্ষ টাকা। এটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কৃষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক একটি পদ্ধতি। সুহানি বলেন, ‘‘মাস প্রোডাকশনের মাধ্যমে এই দাম আরও কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে এটি আরও বেশি সংখ্যক কৃষকের নাগালের মধ্যে আসে।” তা ছাড়া যন্ত্রটি সম্পূর্ণরূপে সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় এটি ডিজেলের ব্যয় কমাবে এবং পরিবেশবান্ধব হবে। এর সঙ্গে একটি ব্যাক-আপ ইঞ্জিনও রয়েছে, যা বর্ষাকালে বা রাতে যন্ত্রটিকে কার্যক্ষম রাখবে।

আরও পড়ুন-KIFF শুরু ৪ ডিসেম্বর থেকে, সিনে উৎসবের ফোকাস কান্ট্রি ফ্রান্স

চ্যালেঞ্জ ও সমর্থন
আর পাঁচটা আবিষ্কারের মতোই সুহানির এই আবিষ্কারের পথও কিন্তু খুব একটা সুগম ছিল না। নানা প্রযুক্তিগত সমস্যা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সুহানিকে। তবে এই যাত্রায় তাঁর পরিবার এবং স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং পূর্ণ সমর্থন ছিল।
দক্ষিণ দিল্লির পুষ্পবিহারের অ্যামিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং নয়ডার অ্যামিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি মিটিং করে তাঁদের প্রয়োজন এবং চাহিদা বুঝে যন্ত্রটির ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়। সুহানি বলেন, ‘‘কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁরা আমাকে জানান So-Apt যন্ত্রের টায়ার এবং উচ্চতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করছি।’’
So-Apt অ্যাগ্রো যন্ত্রটিতে রয়েছে কৃষিকাজকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন কৌশল। এটিতে রয়েছে পোর্টেবল টুল, যেমন একটি মাটি কোপানোর সরঞ্জাম, একটি বীজ বপনের সরঞ্জাম, একটি সেচ সরঞ্জাম এবং সার ও কীটনাশক স্প্রে করার সরঞ্জাম। ফলে এই যন্ত্র কৃষকদের একাধিক অন্যান্য যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কমায়। ফলস্বরূপ তাঁদের খরচও কমে।
So-Apt যন্ত্রের কৃষিতে প্রবেশ
সুহানি বলেন, ‘‘ভারত সৌরশক্তিতে সমৃদ্ধ একটি দেশ এবং আমি বিশ্বাস করি এই সম্পদের ব্যবহার কৃষকদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে৷’’ সাধারণত So-Apt যন্ত্রের সৌর প্যানেলগুলি বেশ কয়েক বছর ধরে চলার জন্য ডিজাইন করা হয় এবং যন্ত্রটিকে আরও দক্ষ করে তোলার জন্য শক্তির রিজার্ভ বাড়ানোর কাজ করছে সুহানি। সুহানির মতে, So-Apt-এর বিকাশ কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার দ্বারা ক্রমাগত উজ্জীবিত হয়েছে। সুহানি বলেন, ‘‘আমি ১০০০ জনেরও বেশি কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের So-Apt যন্ত্র দেখিয়েছি এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়া শুনেছি। অগণিত কথোপকথন এবং গবেষণার মাধ্যমে, তাঁদের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যন্ত্রটি কীভাবে সাহায্য করবে সে-সম্পর্কে গভীর পর্যালোচনা করেছি।’’ সুহানি আরও বলেন, ‘‘আমি তাঁদের মুখে যে আনন্দ এবং প্রশংসা দেখি, এটা জেনে যে আমার মতো তরুণরা তাঁদের সাহায্য করার জন্য কাজ করছে, আমাকে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করে।’’

আরও পড়ুন-কর্মসংস্থানের পথ দেখাচ্ছে রাজ্যের যাত্রীসাথী অ্যাপ

যন্ত্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
So-Apt-এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সুহানি বলেন, ‘‘আমি যন্ত্রটিতে একটি জিপিএস সিস্টেম যুক্ত করার জন্য কাজ করছি যাতে কৃষকেরা তাঁদের খেতের কোন অংশগুলি রোপণ, সেচ বা সার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং কোন কোন স্থানে অবিলম্বেই সেচ বা রোপণ করা হয়েছে তা ট্র্যাক করতে সহায়তা করে৷ এটি কৃষি প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ করে তুলবে বলে আশা করা যায়।’’
সুহানি বর্তমানে So-Apt যন্ত্রে জিপিএসের পাশাপাশি মাটি পরীক্ষা করার পিএইচ ক্যালকুলেটরও যুক্ত করার কাজ করছেন। তাঁর লক্ষ্য একটাই, যন্ত্রটি সারা ভারতের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং প্রযুক্তিটি বৃহৎ কোম্পানিগুলোর কাছে হস্তান্তর করা।
সুহানি চৌহানের So-Apt যন্ত্র যে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে তা বলাই বাহুল্য। এটি যে শুধু কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করবে তা না, বরং পরিবেশের সুরক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
স্বীকৃতি প্রাপ্তি
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সুহানি ভারতের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার’ পান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সুহানি তাঁর প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যতে সৌরশক্তি ব্যবহার বিষয়ে অনুপ্রেরণা পান।
সুহানি বলেন, ‘‘আমার মনে আছে আমার মা আমাকে ফোন করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমি পুরস্কার জিতেছি। সেই মুহূর্তে আমি কী অনুভব করছিলাম তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারি না।’’ সুহানির মা পূজা চৌহান বলেন, ‘‘আমার মেয়ের এই উদ্যোগ দেখতে পাওয়া আমাদের জন্য গর্বের। তার কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী ভাবনা সার্থক হয়েছে। প্রোটোটাইপ স্কেচ করা থেকে শুরু করে So-Apt অ্যাগ্রো যন্ত্রের জন্য স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা পর্যন্ত তার কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার তার সংকল্প ছিল অটুট। পিতামাতা হিসেবে, আমরা তার যাত্রা প্রত্যক্ষ করতে এবং তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সমর্থন করার সুযোগ পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার প্রাপ্তি ছিল একটি পরাবাস্তব মুহূর্ত, তার কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ।’’

আরও পড়ুন-বাল্মীকি প্রতিভা

তবে সুহানি কিন্তু থেমে নেই, আরও বেশি কৃষক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছনোর জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ সুহানি এখন মেতে রয়েছেন So-Apt অ্যাগ্রো যন্ত্রের স্কেলিং নিয়ে। তিনি বর্তমানে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং যন্ত্রটি বাজারে আনতে কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করছেন। তিনি বলেন, তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ভারত জুড়ে কৃষকদের জন্য So-Apt যন্ত্রকে উপলব্ধ করে তোলা৷ শুধু তাই-ই নয়, তিনি এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে এই প্রযুক্তি কৃষকদের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে।
So-Apt-এর সঙ্গে তাঁর যাত্রায় সুহানি অনেক কিছু শিখেছেন, জেনেছেন এবং বুঝেছেন। হেরেছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাই অন্যান্য উদ্ভাবকদের জন্য তাঁর বার্তা, ‘‘যে-কোনও ধারণাই একটি ভাল ধারণা’’, তিনি বলেন, ‘‘যখন আমি So-Apt-এর জন্য চিন্তাভাবনা করছিলাম, তখন আমার অনেক ধারণা ছিল। তাদের মধ্যে কিছু সফল হয়েছে আবার কিছু সফল হয়নি, কিন্তু এই সমস্ত সাফল্য ও অসফলতা আমাকে এই যন্ত্রের পরিমার্জন করতে সাহায্য করেছে। পরীক্ষা এবং অন্বেষণ করতে ভয় পাবে না। এমন অনেক মুহূর্ত ছিল যখন আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অনুভব করেছি, কিন্তু তুমি যা বিশ্বাস করো তার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তুমি বাধার মুখোমুখি হবে, কিন্তু অধ্যবসায়ই এর মূল হাতিয়ার।’’
আজকালকার যুগে যেখানে আমরা প্রায়শই চর্চা করি কিশোর-কিশোরীদের অতিরিক্ত মুঠোফোনপ্রীতি, অসামাজিক কাজকর্ম, যথেচ্ছাচার, উন্মুক্ত ভাবনার তথা মানসিকতার, স্বার্থপরতার সেই একই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা এমন এক কিশোরীর কথা জানছি যাঁর ভাবনা ছিল অনন্য। তাঁর এই ভাবনাকে, প্রচেষ্টাকে আমরা কুর্নিশ জানাই।

Latest article