শীতে চুলের যত্ন

শীতকাল মানেই আবহাওয়ার উড়ু-উড়ু মন আর চুলেরও। এই ঋতুতে চুল মানে শুষ্ক, রুক্ষ এবং নিষ্প্রাণ। তাই আজ থেকেই শুরু করুন চুলের দেখভাল। শীতকালে ঘরোয়া উপায়ে কীভাবে চুল ভাল রাখবেন তার গাইডলাইন দিলেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

অঘ্রান মাস পড়ে গেছে । সকাল-সন্ধ্যা একটা হিমেল বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, জানান দিচ্ছে শীতকাল এসে গেছে। আর এই শীতকাল মানেই অফুরন্ত ঘোরাফেরা, পার্টি, পিকনিক, হুল্লোড় আর তার সঙ্গে চুলের সমস্যা। আর এই চুলের সমস্যাটাই শীতকালে মারাত্মক আকার ধারণ করে। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে চুল নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও এই সময়ে বাতাসে ধুলোবালি ও দূষণের প্রভাব অপেক্ষাকৃতভাবে অনেকটাই বেশি থাকে আর তার ফলে মাথার ত্বক ও চুল প্রাকৃতিক আর্দ্রতা হারিয়ে নিষ্প্রাণ ও রুক্ষ সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। এছাড়াও এই সময় প্রচুর চুল ঝরে যায়। চুল যাতে তার স্বাভাবিকতা না হারায় এবং নিষ্প্রাণ হয়ে না পড়ে তার জন্য শীতকালে চুলের সঠিক যত্নের প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-শিশু-শ্রমিক শূন্য বাংলা

তেলে চুলে
চুলে তেল লাগানো একটি প্রাচীন পদ্ধতি। শীতকালে সপ্তাহে অন্তত দু’বার চুলে তেল লাগানো খুবই প্রয়োজন। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নারকেল তেল অথবা আমন্ড অয়েল মাথার ত্বকে লাগিয়ে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে নারকেল তেলটা যদি সামান্য গরম করে নেওয়া যায় তাহলে উপকার বেশি পাওয়া যাবে। এরপরে গরম জলে টাওয়াল ভিজিয়ে তারপর সেই টাওয়েলটা ভাল করে নিংড়ে নিয়ে সেটা দিয়ে চুলটা ১০ মিনিট মুড়িয়ে রাখতে হবে। এরপর চিরুনি দিয়ে চুলটা ভাল করে আঁচড়ে নিতে হবে। ঘণ্টাখানেক পরে শ্যাম্পু দিয়ে মাথার চুলটা ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। চুলে তেল লাগালে চুল রুক্ষ হওয়া থেকে বাঁচে এবং উজ্জ্বলও হয়।
চুলের যত্নে শ্যাম্পু
শীতকালে অনেকেই পুরো চুল ভেজাতে চান না বিশেষ করে যাঁদের বড় চুল তাঁরা। কিন্তু মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখতে শ্যাম্পুও জরুরি। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন শ্যাম্পু করা অবশ্যই দরকার। বাজার থেকে কেনা পছন্দমতো শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুতে পারেন। প্যারাবেন ফ্রি শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। এছাড়াও ঘরোয়া শ্যাম্পু তৈরি করে নিতে পারেন। যেমন, সারা রাত একটি লোহার পাত্রে চারটে রিঠে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরের দিন সেই রিঠেটাকে ভালভাবে চটকে নিতে হবে। এবার সেটা মাথায় মেখে জল দিয়ে ভাল করে চুলটা ধুয়ে নিতে হবে। এছাড়াও রোজকার ব্যবহারে শ্যাম্পুর সঙ্গে পুদিনা পাতা মেশানো জল মিশিয়ে সেটা দিয়ে শ্যাম্পু করলে চুলটা খুব ভাল থাকবে।

আরও পড়ুন-মোদিরাজ্যে বিজেপি নেতার ৬,০০০ কোটির পনজি স্কিম, পর্দাফাঁস সিআইডি তদন্তে

শ্যাম্পুর পরে
শ্যাম্পু করার পর চুলটা ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে। আর এরপরে বাইরের দূষণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে চুলে কন্ডিশনার দিন অবশ্যই। সবসময় আপনার চুলের লেন্থটুকুতেই কন্ডিশনার দেবেন, স্ক্যালপে নয়। বাজারে যে-সমস্ত কন্ডিশনার পাওয়া যায় সেগুলো বাদ দিয়েও ঘরোয়া উপায়ে চুলের কন্ডিশনার করতে পারেন। চায়ের লিকার তৈরি করে, সেটাকে ঠান্ডা করার পর তাতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে নিতে হবে। শ্যাম্পু করার পর ওই মিশ্রণটি দিয়ে চুল ভাল করে ধুয়ে নিলে চুলটা খুব চকচক করবে এবং চুল পড়া বন্ধ হবে। এছাড়াও একমগ জলে দু’চামচ ভিনিগার মিশিয়ে মিশ্রণটি শ্যাম্পু করার পরে মাথায় ঢেলে নিতে হবে। এতে চুল উজ্জ্বল ও মসৃণ হবে।
খুশকি দূর করতে
শীতকালে মাথার ত্বক শুষ্ক হয় যায়। আর তাই চুলে খুশকি হওয়া এই সময়ের একটি সাধারণ সমস্যার মধ্যেই পড়ে। শীতকালে খুশকি হলে চুল পড়ার সমস্যাও দেখা যায়। এবং তার সঙ্গে চুল রুক্ষ সূক্ষ্মও হয়ে পড়ে। তবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় আছে। এই সময় খুশকি কমানোর সবথেকে সহজ উপায় হচ্ছে নারকেল তেল। সপ্তাহে এক-দু’বার নারকেল তেলটা উষ্ণ গরম করে নিয়ে তার সঙ্গে লেবু মিশিয়ে সেই মিশ্রণটা ভালভাবে মাথায় চুলে লাগিয়ে নিতে হবে। এরপর দু-তিন ঘণ্টা সেটা রেখে ভাল করে শ্যাম্পু করে নিতে হবে। এছাড়াও খুশকির জন্য অ্যালোভেরা অত্যন্ত উপকারী— খুশকি হলে যদি অ্যালোভেরার জেল মাথায় লাগানো যায়। অ্যালোভেরার জেলে আছে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও আন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান। আর সেই কারণেই এটি লাগালে খুশকির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও খুশকি হলে লেমনগ্রাস তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এই তেলের মধ্যে উপস্থিত জীবাণুনাশক ও অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি গুণ খুশকি কম করতে সাহায্য করে। এছাড়াও দই দিয়ে চুলের খুশকি মুক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে কিছুটা দই হাতে করে পুরো মাথার ত্বকে লাগিয়ে নেওয়ার পরে কিছুক্ষণ পরে চুলটা ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে।
তবে শুধুমাত্র বাহ্যিক উপাদান ব্যবহার করলেই চলবে না। খুশকি যাতে না হয় তার জন্য শীতকালে পরিমাণ মতো জল খেতে হবে, নাহলে শরীরের ডিহাইড্রেশনের স্তর বৃদ্ধি পাবে এবং খুশকি দেখা দেবে। এছাড়াও নিজের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ডিম, কাজু, আমলকী— এই সমস্ত উপাদান রাখতে হবে। এই খাদ্য উপাদানগুলো চুলকে মজবুত যেমন করে ঠিক তেমনি উজ্জ্বল করতেও সাহায্য করে।

আরও পড়ুন-সুহানির স্বপ্নের সৌরযান

ঘরোয়া হেয়ার প্যাক
আমাদের সুস্থ থাকতে গেলে যেমন খাদ্যর প্রয়োজন হয় ঠিক তেমনি চুল সুস্থ রাখতে তার খাবারের প্রয়োজন হয়ে থাকে। বিশেষ করে শীতকালে। আর সেই কারণে শীতকালে সপ্তাহে অন্তত একদিন প্রোটিন হেয়ার প্যাক লাগানো দরকার। বাজার চলতি একাধিক হেয়ার প্যাক পাওয়া গেলেও ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি হেয়ার প্যাক লাগানো বেশি ভাল। কারণ ঘরোয়া হেয়ার প্যাকে কোনও কেমিক্যাল থাকে না। এখানে কয়েকটি হেয়ার প্যাকের কথা বলা হল।
দুই চামচ টক দইয়ের সঙ্গে একটি ডিম, এক চামচ ভিনিগার, দুই চামচ নারিকেল তেল মিশিয়ে নিতে হবে। এবার এই মিশ্রণটি ভাল করে চুলে লাগাতে হবে। এক ঘণ্টা রাখার পর ভালভাবে শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে। এই প্যাকটি ব্যবহারের ফলে চুলের গোড়া শক্ত ও মজবুত হবে।
একটি ডিমের সাদা অংশর সঙ্গে পরিমাণমতো মধু এবং টক দই মিশিয়ে মিশ্রণটি ভাল করে চুলে লাগাতে হবে। কিছুক্ষণ রাখার পর চুলটা ভাল করে শ্যাম্পু করে নিতে হবে। এতে চুলটা নরম ও মসৃণ হবে।
পরিমাণমতো নারকেল তেল ও ক্যাস্টর অয়েলের সঙ্গে ভিটামিন সি ক্যাপসুল এবং ডিমের কুসুম মিশিয়ে মিশ্রণটি ভাল করে চুলে লাগাতে হবে। কিছুক্ষণ রাখার পর শ্যাম্পু দিয়ে ভাল করে চুলটা ধুয়ে নিতে হবে। এই একটি ব্যবহারের ফলে চুল পড়া বন্ধ হবে।
এক চামচ নারকেল তেল অথবা অলিভ অয়েলের সঙ্গে এক চামচ মধু এবং আধকাপ পালংশাক বাটা মিশিয়ে সেই মিশ্রণটিকে ভালভাবে চুলে লাগিয়ে নিতে হবে। ৩০ মিনিট পর ভাল করে শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে নিতে হবে। এই প্যাকটি ব্যবহারের ফলে চুল হয়ে উঠবে মসৃণ ও প্রাণবন্ত।
একটি পাকা কলা নিয়ে সেটি ভালভাবে চটকে নিতে হবে। এবার এই চটকানো পাকা কলার সঙ্গে এক চামচ মধু এবং এক চামচ নারকেল তেল মিশিয়ে মিশ্রণটিকে ভালভাবে মাথায় লাগাতে হবে। কিছু সময় রাখার পর ভাল করে শ্যাম্পু করে নিতে হবে। এই প্যাকটি ব্যবহার করলে চুল হয়ে উঠবে ঝলমলে।
চুল পড়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে
সাধারণত আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে যাওয়ার দরুন শীতকালে চুল পড়ার সমস্যা অত্যধিক হারে বেড়ে যায়। এই সময় মাথার ত্বক আর্দ্রতা হারিয়ে শুষ্ক হয়ে যায়। ফলে শ্যাম্পু করার পর, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর সময় অনেক চুল ওঠে। তাই চুল পড়া রোধ করতে কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত।
সপ্তাহে একদিন নারকেল তেল অথবা অলিভ অয়েল অথবা বাদাম তেল উষ্ণ গরম করে মাথার ত্বকে মালিশ করা উচিত। স্নানের সময় খুব গরম জল মাথায় না ঢেলে হালকা গরম জল মাথায় ঢালতে হবে। এই সময় চুল শুকানোর জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা উচিত না। চুল শুকানোর ক্ষেত্রে সুতির টাওয়েল বা গামছা চুলের মধ্যে কিছুক্ষণ পেঁচিয়ে রাখলে চুল তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে। এছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ রোদ, হাওয়া বা পাখার হাওয়া চুল শুকানোর জন্য ব্যবহার করুন। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে শুকনো হাতে মাথার ত্বক মালিশ করতে হবে। এতে চুলের গোড়ার রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং চুলের গোড়া মজবুত হয়। চুল আঁচড়ানোর ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের চিরুনির বদলে কাঠের দাঁড়াযুক্ত চিরুনি ব্যবহার করুন। এতে চুল পড়ার সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।
এছাড়াও শীতকালে চুলের ডগা ফাটার সমস্যা থাকে। উপরোক্ত নিয়মগুলো মেনে চললে চুলের ডগা ফাটার সমস্যারও সমাধান হবে। এছাড়াও চুল পড়া রোধে একটি ঘরোয়া মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিমাণমতো মধুর সঙ্গে সামান্য নারকেলের দুধ মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর ওই মিশ্রণটি মাথার ত্বকে ভালভাবে লাগিয়ে নিতে হবে। ৩০ মিনিট পরে হালকা গরম জলে চুলটা ভাল করে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই প্রাকৃতিক উপায়টি অবলম্বন করলে চুল পড়ার সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে।
এছাড়াও চুলের বৃদ্ধিতে ভিটামিন ডি সহায়তা করে। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন চুলে সূর্যের আলো লাগানো বিশেষ প্রয়োজন। এছাড়াও প্রাণবন্ত ও স্বাস্থ্যকর চুলের জন্য ভিটামিন ই, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-সমৃদ্ধ পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় চর্বিবিহীন মাংস, মাছ, দই— এছাড়াও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ইত্যাদি রাখা উচিত। এছাড়াও শীতকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।

আরও পড়ুন-হোম ম্যানেজমেন্ট

শীতকালে চুলের যত্নের কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা
ভিজে চুল আঁচড়াবেন না
অতিরিক্ত রাসায়নিক পণ্য চুলে ব্যবহার করবেন না
নিয়মিত চুলের ডগা ছাঁটুন, এতে চুলের ডগাফাটা-সমস্যা রোধ হয়।
শীতকালীন শুষ্ক বাতাস যাতে মাথার ত্বকের আর্দ্রতা নষ্ট করতে না পারে তার জন্য মাথায় টুপি বা স্কার্ফ ব্যবহার করতে হবে।
চুলের অতিরিক্ত সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Latest article