অনেকেই মনে রাখেননি। সেইভাবে চর্চাও হয় না তাঁকে নিয়ে। অথচ একটা সময় বাঙালি পাঠকের টেবিলে শোভা পেত তাঁর বই। ছিলেন বহুজনের পছন্দের লেখক। তাঁর গল্প-উপন্যাস গোগ্রাসে গিলত কিশোর-কিশোরীরা। তিনি অদ্রীশ বর্ধন। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, মহীরুহ। ‘কল্পবিজ্ঞান’ শব্দটির জন্ম দিয়েছিলেন তিনিই। এর আগে বাংলা সাহিত্যে সাইন্স ফিকশন পরিচিত ছিল ‘বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনি’ নামে। পাশাপাশি অতিপ্রাকৃত কাহিনি, গোয়েন্দা কাহিনিতেও রেখেছিলেন বিশেষ অবদান।
অদ্রীশ বর্ধনের জন্ম ১৯৩২-এর ১ ডিসেম্বর, কলকাতায় এক শিক্ষক-পরিবারে। বাবা অনিল বর্ধন ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঠাকুরদা চণ্ডীচরণ বর্ধন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি বিদ্যালয়। অদ্রীশ বর্ধন প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন সেই বিদ্যালয়েই। ছোটবেলায় যুক্ত ছিলেন মণিমেলার ব্রতচারী দলের সঙ্গে। শিখেছেন নিয়মানুবর্তিতা। সেই সময় থেকেই মৌমাছি বা বিমল ঘোষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। বিএসসি পাস করেন ডিস্টিংশন নিয়ে। স্কটল্যান্ডে জুট টেকনোলজি পড়তে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। বাধ্য হয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। অনেক পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। চাকরির পাশাপাশি করেছেন ব্যবসাও। ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চার ছিল প্রিয়। অ্যাডভেঞ্চারের টানেই কুড়ি বছর বয়সে পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। চলে গিয়েছিলেন মায়ানগরী বোম্বাই। সেখানে করেছেন বিভিন্ন রকমের কাজ। শেষে যোগ দেন ক্যালকাটা কেমিক্যালে। পোস্টিং হয় ব্যাঙ্গালোরে। কাজের ফাঁকে ঘুরে বেড়াতেন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। অবসর সময়ে মন দেন সাহিত্যচর্চায়।
যদিও তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছিল শৈশবেই। দেওয়াল পত্রিকায় লিখেছিলেন ভূতের গল্প, ‘পোড়োবাড়ির খাঁড়া’। ১৯৬০ সালে বোম্বাইয়ে থাকার সময় উল্টোরথ পত্রিকার প্রতিযোগিতার জন্য লেখেন গোয়েন্দা গল্প ‘আমার বান্ধবী সুনন্দা’। গল্পটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এইভাবেই গোয়েন্দা গল্প দিয়ে পরিণত বয়সে তিনি নিজের সাহিত্যজীবন শুরু করেন।
আরও পড়ুন-অপরাজিতা বিলের সপক্ষে গর্জে উঠুন একসাথে
ছয়ের দশকেই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞান লিখে। কল্পবিজ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘মহাকাশ যুগের রূপকথা’। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৫০। মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি অনুবাদও করেছেন। জুলে ভার্ন, এডগার অ্যালান পো থেকে এইচ পি লাভক্র্যাফ্টদের মতো লেখকদের কল্পকাহিনি মাতৃভাষায় সাধারণ বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন রীতিমতো আন্দোলনের পর্যায়ে।
তাঁর কলমে একাধিকবার উঠে এসেছে বিজ্ঞানে বাংলার অবদানের কথা। কঠিনতম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও তাঁর লেখনীতে হয়ে উঠেছিল সাধারণের জন্য বোধগম্য। হাসি-কৌতুকের মোড়কে ‘প্রফেসর’ আর ‘দীননাথের কাহিনি’ শুধু খুদে পাঠককুলকেই আকৃষ্ট করেনি, করেছে বড়দেরও৷ ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ফাদার ঘনশ্যাম, প্রফেসর নাটবল্টু চক্র, রাজা কঙ্ক, জিরো গজানন, চাণক্য চাকলার মতো চরিত্রগুলো জায়গা পেয়েছিল পাঠকের মনের মণিকোঠায়।
সম্পাদনা করেছেন ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য’। এর পরে ‘ফ্যানটাসটিক’ পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন। বহু নামী সাহিত্যিক নিয়মিত লিখেছেন তাঁর সম্পাদিত এই দুই পত্রিকায়।
সত্যজিৎ রায়ের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব’। পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সত্যজিৎ রায়ের পাশাপাশি প্রেমেন্দ্র মিত্রের অশেষ স্নেহ এবং প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। ২০১৯-এর ২১ মে প্রয়াত হন অদ্রীশ বর্ধন। ৮৬ বছর বয়সে। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, সেটা বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। আক্ষেপ একটাই, সাধারণ পাঠকের মনের আড়ালে চলে গেছেন তিনি। তাঁকে আরও পড়া দরকার। তাঁকে নিয়ে চর্চা দরকার। ভুললে চলবে না, তিনি ছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের রাজা।