বছরের পর বছর ধরে ক্রান্তিকারীদের লড়াই এবং অগুন্তি শহিদের আত্মত্যাগের পর ১৯৪৭-এ যখন ব্রিটিশ ভারতবর্ষ স্বাধীন হল সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে অনেক বড় মূল্য চোকাতে হয়েছিল দেশকে। ভারতের হৃদয়ে এঁকে দেওয়া হয়েছিল এক শেষ না-হওয়া বিভাজনের রেখা। স্বাধীনতার ৭৭ বছর অতিক্রান্ত দেশভাগের সেই বিভাজন রেখার রক্ত, সেই যন্ত্রণা আজও অন্তরে লালিত হয় সমগ্র ভারতবাসীর। কিন্তু সত্যি কি ধর্মের নামে এই বিভাজন জরুরি ছিল? তা আটকানো কী সম্ভব ছিল না? দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সেই নির্ণায়ক সিদ্ধান্তের সঙ্গে সেই সময় যাঁরা সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সেই পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং বিভেদকামী মহম্মদ আলি জিন্নার চিন্তা চেতনা, নীতি, রাজনৈতিক অবস্থান সেই মুহূর্তে ঠিক কী ছিল? স্বাধীনতার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, বিতর্কিত, চর্চিত দেশভাগ নিয়ে লুকিয়ে থাকা এমন বহু অজানা তথ্য উঠে এসেছে পরিচালক নিখিল আদবানির ওয়েব সিরিজ ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এ। সাহিত্যিক ল্যারি কলিন্স এবং ডমিনিক লেপিয়ারের বহুচর্চিত জনপ্রিয় বই ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে এই সিরিজটি। বইটির মূল উপজীব্য দেশভাগ এবং ইংরেজশাসন-মুক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষের তৎকালীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সেই সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলন, সংঘর্ষ সবকিছুর ঊর্ধ্বে সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নেতৃবর্গের অবস্থান, মনোভাব ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-সরকারি সাহায্য একমাত্র ভরসা বিলুপ্তপ্রায় ধিমাল জনজাতির
সিরিজের কাহিনি শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের কলকাতার পটভূমিকায় যেখানে এক জনসভায় মহাত্মা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করা হয় দেশভাগ হবে কি না। সেই প্রশ্নের উত্তরে বাপু জবাব দেন হিন্দুস্থানের বিভাজন হবার আগে আমার শরীর দুভাগ হবে। শুরুর দিকে দেশভাগ নিয়ে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জবাব যাঁর সেই মহাত্মা গান্ধীর পদচিহ্ন অনুসরণকারী, তাঁর অনুগামী পণ্ডিত নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁরা পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে অনড় ছিলেন— কী এমন ঘটেছিল বা কোন মানসিক পরিস্থিতিতে তাঁরা তাঁদের মত বদলাতে বাধ্য হন? কেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মনে হয়েছিল যে আঙুল কেটে বাদ দিলে যদি হাতটা বেঁচে যায় তবে আঙুলটা বাদ দেওয়া হোক। জিন্নাকে পাকিস্তান হস্তান্তর করা হলেই একমাত্র সব সমস্যার সমাধান হবে। বহুদিন ধরে সর্দার প্যাটেলের এই ভাবনার প্রতি বিরুদ্ধমত, অসম্মতি জানিয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত নেহেরু। তা সত্ত্বেও কেন তিনি শেষ পর্যন্ত গান্ধীজির বিরুদ্ধে গেলেন? কাহিনি যত এগিয়েছে ওয়েব সিরিজের পরতে পরতে উঠে এসছে এইসব অজানা তথ্য।
ক্ষমতা বিস্তারের দুরভিসন্ধি নিজেকে গান্ধীজির সমগোত্রীয় প্রমাণ করতে এবং গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে ওঠার লিপ্সা চরিতার্থ করতে মহম্মদ আলি জিন্না বাংলা থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত জ্বালিয়েছিলেন দাঙ্গার আগুন। সেই সত্য উদ্ঘাটনেও পিছপা হননি পরিচালক এই সিরিজে।
এই গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। যাকে সিরিজে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে দর্শক দেখবেন দেশ স্বাধীনতা হবার মুহূর্তে মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা। ভারত ছেড়ে যাবার আগে সমগ্র ভারতের ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার’ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টায় তাঁর বিস্তর কাঠখড় পোড়ানো। তিনি আরেক দিকে দেখবেন বাংলা থেকে নোয়াখালি এবং পাঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত দাঙ্গার এক মর্মান্তিক জলন্ত ছবি।
আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলের সবুজদ্বীপে ইকো পার্ক নয়া রূপে
এমন বহুচর্চিত, বিতর্কিত, সংবেদনশীল এবং জটিল একটা বিষয়কে বইয়ের পাতা থেকে পর্দায় তুলে আনা সহজ কাজ ছিল না। সেই কারণে পরিচালক পুরো গল্পটাকে চিত্ররূপ দিতে একটা গোটা টিম তৈরি করেছিলেন। এই টিমে ছিলেন অভিনন্দন গুপ্তা, অদ্বিতীয় কারেঙ্গ দাস, গুণদীপ কৌর, দিব্যনিধি শর্মা, রেভন্ত সারাভাই, ইথান টেলার প্রমুখ অভিজ্ঞ লেখকরা। ভারত-পাকিস্তান বিভাজন বা দেশভাগের প্রেক্ষাপটে বা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আগে প্রচুর ছবি হলেও তাতে আমরা শুধু পরাধীন ভারতের ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার, হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ইত্যাদি বিষয়ই বেশি দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এই প্রথম কোনও সিরিজ যার কাহিনি এই একই প্রেক্ষাপটে হলেও এর পিছনে লুকিয়ে থাকা গোপন, গূঢ় রাজনৈতিক কারণগুলোকে দেখিয়েছেন। পরিচালক খুব ডিটেলিং করেছেন। কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে গল্প এগিয়েছে। সিরিজটা দেখতে বসলে ডকুমেন্টরি ফিচারের মতো লাগবে অনেকটাই, ফলে একটু রিয়েল ফিলিং তৈরি হবে। একটা বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক।
এবার আসি ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর কথায়। জওহরলাল নেহরুর চরিত্রে সিদ্ধান্ত গুপ্তা অনবদ্য। তাঁর সংলাপ মনে থেকে যাবে। জিন্নার চরিত্রে আরিফ জাকারিয়া ভীষণ বাস্তবসম্মত এবং সাবলীল। সবচেয়ে বেশি যিনি নজর কেড়েছেন তিনি মহাত্মা গান্ধী। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিরাগ ভোরা। গান্ধীজির চরিত্রে অভিনয় একেবারেই সহজসাধ্য বিষয় নয়। রিস্ক রয়েছে একশো শতাংশ। সমালোচনার জায়গা রয়েছে কিন্তু সেই অভিনয়ে উতরে গেছেন চিরাগ। বল্লবভাই প্যাটেলের চরিত্রে রাজেন্দ্র চাওলাকে বেশ ভাল লাগবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন লুক ম্যাকগিবনি। বাদবাকি প্রত্যেকেই নিজের চরিত্রে উজ্জ্বল। এই সিরিজের নারীচরিত্রগুলোর কথা আলাদা করে বললে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি তাঁরা। ফতিমা জিন্নার চরিত্রে ইরা দুবে, সরোজিনী নাইডুর চরিত্রে মলিকশা, এডুউইনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন কর্ডেলিয়া বুগেজা। পুরুষ চরিত্রদের পাশে তাঁরা একটু ম্লান হলেও সঙ্গত করে গেছেন। এ ছাড়া পুরো সিরিজের সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, অরিজিনাল বেশ কিছু ফুটেজের ব্যবহার সিরিজটাকে প্রাণবন্ত, বাস্তবসম্মত এবং বলিষ্ঠ করে তুলেছে। ১৫ নভেম্বর সনি লিভের স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে সাত পর্বের ওয়েব সিরিজটির। এর দ্বিতীয় সিজনও আনবেন পরিচালক এমনটাই শোনা গেছে।