কানপুর : ভারতীয় বাবা-মা ১৯৯০-এ দেশ ছেড়ে পা রেখেছিলেন সুদূর নিউজিল্যান্ডে। বাবা রবি কৃষ্ণমূর্তি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তবে ক্রিকেটের পোকা। রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন তেন্ডুলকরের ভক্ত রবি ওদেশে গিয়ে আস্ত একটা ক্লাব তৈরি করে ফেলেছিলেন হাট হকস ক্লাব নাম দিয়ে। ১৯৯৯-এ ছেলে হওয়ার পর রাহুল ও শচীনের সঙ্গে মিল রেখে বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন রচিন। সেই রচিন রবীন্দ্রই সোমবার বাবা-মায়ের আদি দেশে অধুনা কোচ রাহুলের সামনে তাঁর দলের জয় আটকে দিয়ে সোজা শিরোনামে চলে এলেন। এদিকে পিচের নো নরনচরন মুডে অবাক রাহুল দ্রাবিড়।
স্কোরবোর্ড বলছে ৯১ বলে ১৮ রচিন। সঙ্গী আজাজ ২৩ বলে ২। দু’জনেই নট আউট। কিন্তু ঠিক স্কোর দিয়ে পরিস্থিতির মূল্যায়ন হবে না। পাশাপাশি ছবিটাও বুঝতে হবে। ঘাড়ের উপর এগারোজন ভারতীয়। কয়েকজন এত কাছে যে ঘাড়ের উপর গরম নিশ্বাস এসে পড়ছে। এর উপর গ্রিন পার্কের আলো দ্রুত কমে আসছে। বল কিছু ক্ষেত্রে নিচু হয়ে যাচ্ছে, স্কোয়ার টার্ন করছে। এতসব প্রতিকূলতা সামলে অশ্বিন-অক্ষর-জাদেজার হাত থেকে নয় নয় করে ৫২টি বল সামলে কানপুর টেস্ট অমীমাংসিত রেখে দিলেন দুই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বলা হয়নি, রচিনের জন্ম না হয় ওয়েলিংটনে, বছর তেত্রিশের আজাজ জন্মেছেন বম্বেতে (এখন মুম্বই)। আর রচিনের জন্য আরও এক জরুরি তথ্য, ২০২১-এ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে দুই ইনিংসে শূন্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু এদিন গ্রিন পার্ক তাঁকে পুনর্জন্ম দিয়ে গেল। ৮৯.২ ওভারে টিম সাউদি যখন আউট হলেন, নিউজিল্যান্ড ১৫৫-৯। তখনও ন্যূনতম নয় ওভার খেলা বাকি এবং জয় প্রায় নিশ্চিত দেখাচ্ছিল রাহানেদের। কিন্তু শেষবেলায় অবিশ্বাস্য লড়াই দিলেন রচিন ও আজাজ। একটা একটা করে বল যাচ্ছে আর একটু একটু করে নিজেদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলেন এই দুই তরুণ। শেষপর্যন্ত কিউয়িরা যখন ১৬৫-৯, আম্পায়ারদের হাতের লাইট মিটার আর খেলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। কিউয়িদের জয়ের টার্গেট ছিল ২৮৪ রানের। তখন কে আর এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে! তবে প্রাক্তনদের অনেকে বলছেন, ড্র নয়, এটা আসলে নিউজিল্যান্ডেরই জয়।
আরও পড়ুন : ইস্টবেঙ্গলের দল নামাতে চাই সঠিক স্ট্র্যাটেজিও
কিউয়িদের এই ফাইট ব্যাকে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন ওপেনার টম লাথাম। প্রথম ইনিংসে ৯৫-এর পর দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন ৫২ রান। এদিন জাদেজা ৪০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে গেলেন। অশ্বিন ৩৫ রানে তিন। আর এই সুবাদে তিনি হরভজন সিংকে পিছনে ফেলে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রহকারী হয়ে গেলেন। কিন্তু শেষ নয় ওভারে নিউজিল্যান্ডের শেষ জুটির অবিচ্ছেদ্য থেকে যাওয়া ভারতীয় বোলিংয়ের জন্য বেশ বড় ধাক্কা। মুম্বই টেস্টের আগে এটাই মানসিক শক্তি টেস্ট বিশ্বকাপের সেরা দলকে।
এদিকে , শেষ দিনের পিচের চরিত্র অবাক করেছে দ্রাবিড়কে ম্যাচের পর মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে দ্রাবিড় বলেন, ‘‘লাঞ্চের পর নিউজিল্যান্ডের আট উইকেট ফেলে দেওয়া যথেষ্ট কৃতিত্বের। আমাদের বোলাররা দুর্দান্ত বোলিং করল। বিশেষ করে, এমন পিচে যেখানে পঞ্চম দিনেও খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি।’’ টিম ইন্ডিয়ার কোচের বাড়তি সংযোজন, ‘‘ভাগ্যের সামান্য সাহায্য পেলে হয়তো টেস্ট ম্যাচটা জিততেও পারতাম।’’
দ্রাবিড় আরও বলেন, ‘‘পিচে পড়ে নীচু হলেও বল ধীর গতিতে ব্যাটে আসছিল। তেমন টার্ন বা বাউন্স ছিল না। যা আমাকে অবাক করেছে। কারণ ভারতীয় উইকেটে সাধারণ পঞ্চম দিনে বল অনেকটা ঘুরে থাকে। কিন্তু এই পিচে তেমন কিছু ঘটেনি।’’ অজিঙ্ক রাহানেদের কোচ আরও যোগ করেছেন, ‘‘টেস্টের শেষ দিনেও বল ব্যাটের কানায় লেগে ফিল্ডারদের হাতে পৌঁছয়নি। অন্তত আমি তো তেমন কোনও ঘটনা মনে করতে পারছি না। তাই ব্যাটসম্যানদের আউট করার দুটো উপায় ছিল, এক বোল্ড। দুই লেগ বিফোর উইকেট। শেষ সেশনে আমরা এভাবেই কয়েকটা উইকেট তুলতে পেরেছি।’’
আরও পড়ুন : মনোনয়নে উন্নয়নের শপথ
তবে অভিষেক টেস্টেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়ে খুশি শ্রেয়স আইয়ার। তবে ডানহাতি মুম্বইকর কোনও রাখঢাক না করেই জানাচ্ছেন, দল কানপুর টেস্ট জিতলে, সেটা হত তাঁর বাড়তি পাওনা। গ্রিন পার্কে দু’ইনিংসেই চাপ মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে হয়েছে তাঁকে। প্রথম ইনিংসে ১০৫ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫। শ্রেয়স বলছেন, ‘‘জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচেই সেরা হতে পেরে দারুণ লাগছে। তবে ম্যাচটা জিততে পারলে আরও খুশি হতাম। সেটা হত ‘আইসিং অন দ্য কেক’।’’ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ব্যাট হাতে দারুণ সফল হলেও, এতদিন শ্রেয়সকে গোটা দেশ চিনত সাদা বলের ফরম্যাটের বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এমনকী, টেস্ট স্কোয়াডে তিনি সুযোগ পাওয়ার পর, মৃদুভাবে হলেও, বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। লাল বলের ক্রিকেটে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরে তাই তৃপ্ত শ্রেয়স। তিনি বলেন, ‘‘সবাই বলত আমি নাকি চালিয়ে খেলি। নিজের সহজাত ব্যাটিং স্টাইল বদলানো উচিত নয়। তবে এই টেস্টে আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাট করেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিচ্ছে। লক্ষ্যই ছিল সেশন টু সেশন ব্যাট করা। যতটা বেশি সম্ভব বল খেলতে চেয়েছিলাম।’’ পিচ সম্পর্কে শ্রেয়সের বক্তব্য, ‘‘পঞ্চম দিনেও উইকেট খুব ভাল ছিল। এই পিচে আমাদের স্পিনাররা দুর্দান্ত বল করেছে। নিউজিল্যান্ড দিনের শুরুটা খুব ভাল করেছিল। তাই আমরা কিছুটা চাপে পড়ে যাই। তবে যখন পরপর উইকেট পড়তে শুরু করল, তখন কিউয়িরা পাল্টা চাপে পড়ে গিয়েছিল।’’