জল (Water) সমস্ত প্রকৃতির চালিকা শক্তি।—লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। অথবা যদি বলি ‘এক ফোঁটা জল, যদি এটি তার নিজস্ব ইতিহাস লিখতে পারে তবে মহাবিশ্ব আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করবে।’— লুসি লারকম। এই কথাগুলির বাস্তবতা কতটা তা কেবল তারাই বলতে পারবে যারা প্রতিনিয়ত একফোঁটা জলের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আমাদের শরীরে রক্তের ৯০ শতাংশের বেশি জল, কোষের প্রোটোপ্লাজমের শতকরা ৭০-৮০ ভাগই জল এছাড়া ওজনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাগ জল অধিগ্রহণ করে রেখেছে। পরিসংখ্যান বলছে, কৃষি ও পানীয়তে জলের ব্যবহার প্রায় ৮৫ শতাংশ, গৃহস্থালির কাজের জন্য প্রায় ১০ শতাংশ এবং শিল্প বা অনান্য ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের মতো। যত দিন যাচ্ছে মানুষের কিন্তু ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে এবং মাটির উপরিস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা কমছে। বিশেষত সবুজ বিপ্লবের পর থেকে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত-সহ বিশ্বের অনেক দেশে অতি দ্রুত ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার নিঃশেষিত হতে চলেছে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদক দেশগুলোতে জলের সঙ্কটে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে এবং ফলে বিশ্ব জুড়ে এক মহামারীর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের যে কাজ অতিসত্বর করতে হবে তা হল জলের সঞ্চয়, অপচয় থামানো, জলের ন্যায্য বণ্টন ও জল সৃজন। তবে জলের ভয়াবহ সঙ্কট রোধ করার দীর্ঘমেয়াদি উপায়ও আছে, সেটা হল বনসৃজন তবে সেটা একটা দুটো নয়, লক্ষ-কোটি গাছ লাগানো। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতো দেশে জল সংরক্ষণ ও জলের অপচয় বন্ধের কড়া ব্যবস্থার প্রয়োজন। এই মুহূর্তে আরও একটি চিন্তার বিষয় হল পর্যাপ্ত পানীয় জলের সরবরাহ। কারণ আমরা দেখেছি ভারতবর্ষের তাবড়-তাবড় শহরে ইতিমধ্যে জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং সেই সঙ্কটপ্রবণ এলাকার মানুষজন চড়া দামে জল কিনেছেন। বিশেষ করে ভারতবর্ষের এমন অনেক শহর ও গ্রাম আছে যেখানে এখনও পানীয় জলের কোনও সংযোগ নেই। সেখানকার মানুষজন দূরদূরান্তর থেকে পানীয় জল বয়ে নিয়ে আসেন। এইরকম নানান সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ‘জলজীবন মিশন’ চালু করে। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতিটি পরিবারের জন্য নিরাপদ পানীয় জল নিশ্চিত করা যায়। নিরাপদ পানীয় জলের সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে সমাজ জীবনের অগ্রগতি এবং সেই জলজীবন মিশন প্রকল্পটিতে সেই অগ্রগতির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। জলজীবন মিশনটিতে শুধু পানীয় জলের সরবরাহ নয়, এর সাথে অনেকগুলি ব্যবস্থা জড়িত করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে পানীয় জলের পরিকাঠামো তৈরি, বৃষ্টির জল সংগ্রহ, ভূগর্ভস্থ জলের সঠিক ব্যবহার, কৃষি পুনঃব্যবহার জলের সঠিক ব্যবহার এবং পরিবারের বর্জ্য জলের সঠিক কার্যকর করার ব্যবস্থাপনা। আদতে এই ঘোষণাগুলি তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন রাজ্য সরকারগুলি তার পাওনা সঠিক ভাবে পাবে। আমরা জানি, যে কোনও কেন্দ্রীয় মিশনে বরাদ্দের একটা অনুপাত থাকে। এই জলজীবন মিশনও তার ব্যতিক্রম নয়। এর তহবিল বিভাজন হল কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ ৫০ : ৫০ অনুপাত, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জন্য ৯০০ : ১০ অনুপাত এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির জন্য ১০০ শতাংশ, সুতরাং শুধু প্রকল্প প্রণয়ন নয়, তহবিল প্রদান করাও রাজ্য সরকারগুলির অন্যতম দায়িত্ব। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জলজীবন মিশনে বরাদ্দের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। যদি একটু পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের অধীনে ৮৩৩০টি জলাশয় তৈরির ব্যবস্থা ও সংস্কারের কাজ করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৪০৪৯৭৮টি জলাশয় তৈরি বা সংস্কার করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান রাজ্য। কৃষিজ সম্পদ উৎপাদনে দেশের মধ্যে কিন্তু অন্যতম সেরা। এখানে ৭৭৫৮৯ হেক্টর সেচসেবিত জমিতে প্রায় ৬৬৯৯টি ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প তৈরি হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলের সঠিক ব্যবহারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বদা সচেষ্ট। ডাইনামিক গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস আ্যসেসমেন্ট ২০১৭ অনুযায়ী জল উত্তোলন যেখানে ৫০.২৯ শতাংশ ছিল, ২০২৩-এ সেটা দাঁড়িয়েছে ৪৪.৮১ শতাংশ। ‘জলতীর্থ প্রকল্পে’ খরাপ্রবণ এলাকাগুলোকে সেচ ব্যবস্থার সুবিধা প্রদান করার জন্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে ২০২৩-২৪ সালে বনমহোৎসবের মাধ্যমে বনসৃজনে একদিনে প্রায় ৩২ লক্ষ চারা রোপণ করা হয়েছে যা কিন্তু নজির সৃষ্টি করেছিল। আর ‘সবুজশ্রী প্রকল্পের’ মাধ্যমে সারাবছর বনসৃজন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বদা সচেতন। প্রতিটি ঘরে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। ‘জলজীবন মিশন’-এর অধীনে ৯৪০৪টি প্রকল্পের আওতায় ১৭৪.৪২ লক্ষ জলের সংযোগ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৯১২১টি প্রকল্পে ১৬৬.১৫ লক্ষ পরিবারে কল বসানোর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ৯৫ লক্ষ পরিবার পানীয় জল পাচ্ছে। শুধু পরিবারে পানীয় জল সরবরাহ নয়, ৫৯৯১৬টি বিদ্যালয়, ৪৩৮৬৬টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র এবং ৮২৯৮টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নলবাহিত জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রাম পঞ্চায়েত, কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয়েও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। পুরুলিয়া জেলায় যেখানে জলকষ্ট প্রায় লেগেই থাকত, সেখানে জাপান ইন্টারন্যাশানাল কো-অপারেশন এজেন্সির (JICA) ১২৯৬ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তায় পানীয় জল সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের (ADB) ২৪৯৬ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তায় উত্তর ও দক্ষিণ পরগনা, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় জল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, এর ফলে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন। জল যেখানে জীবন সেখানে তার অপচয় বা অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এই প্রসঙ্গে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘Zero Tolarence’ নীতি নিয়েছেন। জলের গুণমান সুনিশ্চিতকরণের জন্য রাজ্যের ২১৭টি ল্যাবেরটরির মধ্যে ২১৬টি ল্যাবেরটরির এনএবিএল-এর স্বীকৃতি বা শংসাপত্র পেয়েছে। নাগরিক পরিষেবায় পশ্চিমবঙ্গ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। আর প্রশ্নটা যেখানে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের সেখানে প্রশাসনের ভূমিকা স্বচ্ছ হবে সেটাই স্বাভাবিক। আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি ঘরে ঘরে পরিশ্রুত পানীয় জল পৌঁছাবে তা হলফ করে বলে দেওয়া যায়।।
আরও পড়ুন- বিজেপির ওড়িশা! জামিন পেয়েই নির্যাতিতার গলার নলি কেটে খুন