শ্রমণা কয়েকদিন আগেই তার পিসির ছেলের বিয়েতে গেছিল। ওর মায়ের বিয়ের বেনারসি পরে। ওটা পরার শখ শ্রমণার বহুদিনের। তারপর যা হল! বিয়ে বাড়িতে পা রাখা ইস্তক চেনা-পরিচিত যে দেখছে সেই এসে বলে যাচ্ছে, বাব্বা! চেনাই তো যাচ্ছে না। তোর তো বিয়ের ফুল ফুটল বলে। মায়ের কাকিমা মাকে বলে বসলেন, বাবা মেয়ে এত সুশ্রী আবার ভাল চাকুরে— ওর তো পাত্রের লম্বা লাইন লেগে যাবে এবার। তা কবে বিয়ে দিচ্ছ মেয়ের। আমার কাছে একটা ভাল ছেলে আছে— ইঞ্জিনিয়ার। বলো তো দেখতে পারি। বেশি দেরি কোরো না, লালিত্যি থাকতে থাকতে বিয়ে দিয়ে দাও। শ্রমণার সে এক ভীষণ অস্বস্তি, বিরক্তি। কী যে বিপদ হল ওর বেনারসি পরে, কহতব্য নয়। অথচ মায়ের মুখটা খুশিতে চকচক করছে।
আরও পড়ুন-২৩ ডিসেম্বর থেকে রাজ্য জুড়ে শুরু প্রক্রিয়া, পঞ্চায়েতেও অনলাইনে সম্পত্তি কর
ভারতীয় সমাজে ছেলেদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা ছোটবেলা থেকেই বলা হয়। কিন্তু কেন সেই কথা মেয়েদেরও বলা হয় না? কেন একটা মেয়ে জন্ম থেকে এটা শুনেই বড় হয় যে, সে ক্ষণিকের অতিথি। মেয়েরা কেরিয়ার নিয়ে মাতামাতি করুক বা নিজের স্বাধীনতা নিয়ে বাড়ি থেকে তাদেরকে একটাই বচন শুনতে হয়, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিয়ে দিয়ে দেব। এর পর মেয়ে একটু বড় হলে তার প্রতিটা ইচ্ছেকে প্রতিহত করতে বলা হয় ‘বিয়ের পর যা ইচ্ছে করিস’। কোন শৈশব থেকে একটি মেয়ের মধ্যে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই প্রোথিত করে দেওয়া হয় ‘একদিন তো বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হবে’। একটা পাশ সে দিল কি দিল না, একটা চাকরি পেল কি পেল না, বাবা-মায়ের কন্যা পাত্রস্থ করার চিন্তায় রাতের ঘুম বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে তো বাড়ির মেয়েটিকে এও অনায়াসে বলে ফেলেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির মত নিয়ে চাকরি করিস।
আরও পড়ুন-শাশুড়িদের বউমারা
খুব দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব সত্য যে আজও মেয়েদের বিয়ে হয় আর ছেলেরা বিয়েটা করে। বলতে বাধা নেই ভারতবর্ষ মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ খানিকটা অবসেসড বা মোহাচ্ছন্ন। সেই আচ্ছন্নতার পরিমাণ এতটাই যে বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে গেলে এই দেশের মেয়েদের যথেষ্টই সামাজিক চাপের মুখে পড়তে হয়। তাই এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই জীবনে বিয়েটাকেই অন্তিম লক্ষ্য হিসেবে মনে করেন।
গবেষণা অনুযায়ী ভারতবর্ষে বেশ ভাল সংখ্যক মেয়েদেরই গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিকে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিচয়পত্র হিসেবে মানা হয় না বরং তাঁদের সেই সব ডিগ্রি, ডিপ্লোমাগুলো থাকলে বিয়ের বাজারে তাঁরা ভাল পাত্রী হিসেবে বিবেচ্য হয়। ভাল ঘর, ভাল বর আর আর্থিক সাচ্ছল্য— এই তিন মন্ত্রেই ছোট থেকে তারা দীক্ষিত। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মনোবিদ শাল্মলী চট্টোপাধ্যায় বললেন— সেই কোন ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের গায়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী, মা দুর্গা ইত্যাদি দেবদেবীর তকমা এঁটে দেওয়া হয়। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা মেয়েদের জন্য বাজার চলতি তা হল দশভুজা। কিন্তু কেন? কেন একটি মেয়ে দশভুজা হবে। এখানেই কিন্তু আমাদের সব প্রশ্নের উওর লুকিয়ে রয়েছে। দশভুজা মানে সে দশ হাতে দশ রকম কাজে পটু হবে। এটাই তো সবচেয়ে বড় অলিখিত সামাজিক চাপ একটা মেয়ের উপর তাই না? কী বাঙালি, অবাঙালি পরিবার বাড়ির মেয়েটির কানে ছোট থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়াই হয় যে তোমাকে কিন্তু সবটা নিখুঁতভাবে শিখে নিতে হবে। তোমার মা, ঠাকুমার মতো করেই। যাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কোনও সমস্যায় পড়তে না হয় বা কিছু শেখায়নি বলে তাঁর বাবা-মার বদনাম না হয়। আমার তো মনে হয় এই কথা প্রায় সব মেয়েই কমবেশি শুনেছে পরিবার থেকে। আমার কাছে এমন ক্লায়েন্ট আসে যাঁদের অভিযোগ, তাঁদের স্ত্রীর মুড স্যুইং হয়, নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না, রেগে যায়। এটা তাঁরা বোঝেনই না যে একজন মেয়ে ঋতুস্রাব চলাকালীন বা ওই বয়ঃসীমায় মুড স্যুইং, ডিপ্রেশনটা খুব স্বাভাবিক কারণ হরমোনের এই টানাপোড়েন আবার মেনোপোজাল স্টেজেও ওটা স্বাভাবিক একই কারণে। আসলে মেয়েদের সমস্যা বা সুবিধে-অসুবিধেগুলো আজও কেউই বুঝে উঠতে পারেনি। বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটা মেয়ের উপর চাপ আসবেই। এটাই আমাদের সমাজ। এমনও দেখা গেছে উচ্চশিক্ষিত মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙছে তার কারণ সেই মেয়েটির চাকরি বা পেশা থেকে বাড়ি ফেরার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। সেই ক্রাইটেরিয়াতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। অর্থাৎ একটা মেয়েকে শুধু কেরিয়ার গড়লেই হবে না, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবটাই সামলাতেও হবে তাই চাকরিটাও যে সে করলে চলবে না। আমার কাছে পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের ক্লায়েন্ট খুব বেশি আসেন। নতুন মা হওয়ার পর যে ডিপ্রেশন হয় তাকেই পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন বলে। ছেলেরা কিন্তু এই ধরনের ডিপ্রেশনে ভোগে না। সন্তান ধারণ থেকে জন্ম এবং পরবর্তী সময়ের সন্তানের দেখভালের সবটা একজন মায়ের উপরেই বর্তায়। ফলে মা হওয়ার পর সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া একটা বন্দি-জীবনকে অনেক মেয়েই নিতে পারেন না। শরীরে হরমোনের ভারসাম্য থাকে না। এই ডিপ্রেশন হলে এখন তারা মনোবিদের শরণাপন্ন হয় কিন্তু আগে সেটা হত না। এমন কত পরিবার রয়েছে যেখানে নিঃশব্দে এই মানসিক যন্ত্রণা একটি মেয়ে বয়ে চলে। এই রকম মানসিক অবস্থায় সুইসাইডাল টেন্ডেসি ভীষণভাবেই দেখা যায়। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মেয়ের স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির সেই সদর্থক ভূমিকা দেখা যায় না। কাজেই যতই দশভুজা তকমা আঁটা হোক না কেন, মেয়েদের অবস্থান কিন্তু আজও বদল হয়নি।
আরও পড়ুন-মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সরকারি পরিকাঠামোয় নজরদারি নবান্নের
বিয়ের পরে একটি মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকল কি না তা ভেবে দেখার রেওয়াজ সত্যি আমাদের দেশে নেই। সেই জন্ম থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের নিজেকে প্রমাণ করা পালা। ঘরের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সেরে এবং বাইরে কর্মক্ষেত্র— এই দুয়ের ব্যালেন্সিং-এ আপাত সুনাম কুড়োলেও একটা সময় মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে তারা। মেয়েদের এই প্রবণতাকে বিশেষজ্ঞেরা বলেন সুপার উওমেন সিনড্রোম। সত্যি কি তারা তাই! এই নিয়ে সাহিত্যিক দেবারতি বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, আসলেই কোনও নারীই সুপার উওমেন নন। এটাই মেয়েদের নিজেদেরই সবার আগে বুঝতে হবে। সে মানুষ। আজ থেকে দেড়শো-দুশো বছর আগে সমাজে মেয়েদের যে অবস্থান ছিল তা আজ অনেকটাই নেই। দিনে দিনে মেয়েরা ছেলেদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারা পুরুষের মতোই কেরিয়ার গড়ছে, ফুটবল খেলছে, অটো চালাচ্ছে, চাকরি করছে, ব্যবসা করছে কিন্তু মজার বিষয় হল, তাদের যে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব তা থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না বরং আশা করা হচ্ছে যে তারা দুটোই একসঙ্গে দারুণ সামলাবে।
আমি একটি স্বনির্ভর প্রকল্প নিয়ে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। ওখানে মহিলাদের যখন স্বনির্ভর হতে বা এই প্রকল্পের মাধ্যমে রোজগার করার কথা বললাম, শুনেই ওঁরা বললেন, আমরা যদি রোজগার করা শুরু করি এখন তো ভোর চারটেই উঠি তখন রাত দুটোয় উঠতে হবে! অর্থাৎ ওদের যে হাউজহোল্ড ডিউটি তা থেকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের সমাজের এটা একটা অবধারিত বিষয়। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এটা হয় না। আমরা নারী আমরা সব পারি এটা সর্বৈব ভুল। সেই ঠেকা আমরা মেয়েরা নিয়ে রাখিনি। কেন আমরা সব পারব? একটা মানুষ যা পারে আমরা, মেয়েরা, ঠিক ততটাই পারি। মেয়েরা তো মানুষের ঊর্ধ্বে নয়। এটা মেয়েদেরই বুঝতে হবে।
কারণ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েও বহু মেয়েই পরাধীন। এখানেই যত সমস্যা। যেটার পরিবর্তন দরকার।
এখন বিয়ে করা বা না-করা কোনও বড় ইস্যু নয়। বিয়েটা আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটি অঙ্গ— সেটাই সম্পূর্ণ জীবন নয়, এটা বোঝা জরুরি।
আরও পড়ুন-৬ মাসে ৪২ হাজার কোটি মকুব, মোদি সরকার যেন দাতব্য চিকিৎসালয়
বেতনহীন গৃহপরিচারিকা এবং সবেতন পেশাদার— এই দুইয়ের সহাবস্থানে থাকা সুপার উইমেন পদকপ্রাপ্ত ভারতীয় নারী সংসারের জাঁতাকলে পিষে নিজের অজান্তে হয়ে পড়ে চরম অবসাদগ্রস্ত। পাশাপাশি অর্থের অভাবে খুব কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া এখানে আম-ঘটনা। শ্বশুরবাড়িতে সেই নাবালিকারা বিভিন্ন অত্যাচার, পণপ্রথার বলি হয়। ল্যানসেট পত্রিকার মেন্টাল হেল্থ সার্ভিসের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রায় ৭০% নারী মানসিক অবসাদের শিকার। যার মধ্যে ২০ থেকে ৪৫ বছরের বিবাহিত মহিলাই বেশি। গৃহহিংসার শিকার, অত্যাচারিত, নির্যাতিত— এইসব মেয়ের আত্মহত্যার প্রবণতাও অনেক বেশি। এনসিআরবির তথ্য অনুযায়ী ২০২০-তেই প্রায় ২২ হাজারের বেশি গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন ভারতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্রুত বিয়ে দেওয়া নিয়ে এত চাপাচাপি কেন? এই কেনর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশিষ্ট মনোবিদ প্রথমা গুহ বললেন, ‘এখন প্রত্যেকের একটি কি দুটি সন্তান। খুব যত্ন সহকারে বাবা-মা তাদের মানুষ করে তোলেন, স্বাধীনতা দেন কিন্তু বিয়ের বয়স হলেই কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে সব ভুলে গিয়ে উঠে-পড়ে লাগেন পাত্রস্থ করতে। বিয়ে করতেই হবে। এটা শুধু বাবা এবং মায়ের ইনসিকিওরিটি তা নয় এটা কিন্তু সেই মেয়েটিরও ইনসিকিওরিটির জায়গা। যে বিয়েটা হতেই হবে না হলে আমি একা হয়ে যাব। একা হয়ে যাওয়ার ভয়, অভিভাবকহীন হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই মেয়েদের এই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।
এখনকার দিনে কেরিয়ার গড়তে গিয়ে দেরি হয়ে যায় ফলে তাড়াহুড়োতে অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তাই বিচ্ছেদ বাড়ছে। একটা সাংঘাতিক চাপ থাকে যে এবার বিয়ে না করলে লোকে কী বলবে! যে চাপ ছেলেদের ক্ষেত্রে একেবারেই থাকে না। একা থাকা যে যায়, কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি বিয়ে করতেই হবে এই আত্মবিশ্বাসটা তৈরি হয়নি। আসলে আমরা বিয়ে করেও একা হয়ে যেতে পারি এটা কেউ ভাবেন না। আমি চাইলেই আমার শর্তে জীবনে বাঁচতে পারি— এইটা ভাবা দরকার বা আমার মেয়ে একা থাকলেও ভালই থাকবে— এই বিশ্বাসটা থাকা জরুরি। এছাড়া আর্থিক জায়গাটাও একটা বড় ফ্যাক্টর। মেয়েকে সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে কারও হাতে তুলে দিলে ভাল— এই মানসিকতাও কাজ করে।
একটা ছেলে যেভাবে রোজগার করতে সক্ষম, একটা মেয়েকেও সেইভাবে সক্ষম ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে কীসের অসুবিধে? যে মেয়েটিকে ছোটবেলা থেকে ‘পিরিয়ড’ মানে ‘শরীর খারাপ’ বলা হয় তার পক্ষে বিয়ে ছাড়া আর কি কোনও স্বপ্ন দেখা সম্ভব? কাজেই শিকড় থেকে এই ভাবনার বদল দরকার। পরিবারের, বাবা-মা-র কন্যাসন্তানকে বড় করে তোলার সময় তার মধ্যে এটা প্রোথিত করে দেওয়া দরকার যে বিয়েটাই জীবনের শেষ কথা নয়। বিয়েটা তাঁর সম্পূর্ণ জীবনের একটা সুন্দর অংশ। যে অংশটা উপভোগ্য হতেই পারে— কিন্তু সেই উপভোগ যেন নিজের শর্তসাপেক্ষেই হয়।