তিন মাসেও আর জি কর কাণ্ডে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দিতে পারল না সিবিআই। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনে তথ্য-প্রমাণ লোপাট ও ষড়যন্ত্রের মামলায় শিয়ালদহ আদালতে ব্রেআব্রু কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের ব্যর্থতা। ফলে শুক্রবার সহজেই জামিন পেয়ে গেলেন হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। সেটাও মাত্র দু’হাজার টাকার বন্ডে। শর্ত একটাই, জামিন পর্বে তলব করামাত্র হাজিরা দিতে হবে দু’জনকেই। তবে সন্দীপ মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই। তাই এখনও জেলে থাকতে হবে তাঁকে। অভিজিৎ অবশ্য সন্ধ্যায় আদালত থেকে সোজা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।
আরও পড়ুন-বোকারোতে পথ দুর্ঘটনায় মৃত ৫, আহত ৩
দু’দিন আগেই আর জি কর মামলা ছেড়ে দেন ‘অভয়া’র পরিবারের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার। তারপরই এদিন সন্দীপ-অভিজিতের জামিনে ভেঙে পড়েছেন ‘জাস্টিস চাই’ আন্দোলনকারীরা। হতাশ ‘অভয়া’র মা-বাবাও। সিবিআইয়ের তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে উঠেছে বড়সড় প্রশ্ন। অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন, তাহলে কি কলকাতা পুলিসের তদন্তই সঠিক ছিল? সন্দীপ ঘোষের জামিনের খবর শুনে ‘অভয়া’র মা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বলার মতো কোনও কথা নেই। ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিতে না পারায় ওঁদের জামিন হয়ে গেল। আর কী করার আছে! আমি তো আর সিবিআই নই, তাহলে কাজটা করে দিতাম।’
পাঁচদিনের জেল হেফাজত শেষে এদিন শিয়ালদহ আদালতে হাজির করানো হয় সন্দীপ-অভিজিৎকে। সওয়ালের শুরুতেই সিবিআইয়ের আইনজীবী দীপক পোরিয়া বলেন, দু’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। তবে তাঁরা চার্জশিট জমা দিচ্ছেন না। হেফাজতেরও আবেদন করছেন না। এক্ষেত্রে আদালতই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। তদন্তকারী অফিসারও আদালতে জানান, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তাই তাঁরা চার্জশিট জমা দিচ্ছেন না। অভিযুক্তদের আইনজীবীরা তখন বলেন, দু’জনের বিরুদ্ধে এখনও কোনও তথ্যপ্রমাণ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারের পর ৯০ দিন পেরিয়েছে। এখনও সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দেয়নি সিবিআই। শুধু বার বার বলছে, এখনও তদন্ত চলছে। এর অর্থ মক্কেলদের বিরুদ্ধে কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। তাই জামিনের আর্জি জানানো হচ্ছে। সেই আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।
আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে দুর্গামন্দিরের ভিতরে কিশোরীকে গণ.ধর্ষণ, নিন্দায় সরব তৃণমূল কংগ্রেস
যদিও তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সিবিআইয়ের এক কর্তা জানিয়েছেন, জামিন হয়ে গিয়েছে বলে তদন্ত শেষ, এমনটা নয়। দ্রুত গতিতে তদন্ত চলছে। সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেওয়া হবে। এখনও প্রয়োজনীয় নথিপত্র হাতে আসেনি বলে এদিন তা দেওয়া যায়নি। অথচ সুপ্রিম কোর্টে তদন্ত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি তুলে ধরতেই দুই অভিযুক্তকে তড়িঘড়ি হেফাজতে নিয়েছিল সিবিআই। চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় সন্দীপ-অভিজিৎকে। তাঁদের জামিনের বিরোধিতায় সিবিআইয়ের যুক্তি ছিল একটাই, ঘটনার পর দু’জনের একাধিকবার কথা হয়েছে। কীভাবে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হবে তাই নিয়ে কথাবার্তা চলেছে। সে-ব্যাপারে মোবাইলের ফরেন্সিক রিপোর্ট রয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এমনকী হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিকৃত করা, দেরিতে এফআইআর দায়েরের অভিযোগও তোলেন এজেন্সির অফিসাররা। কিন্তু ৯০ দিন ধরে তার কোনও প্রমাণ জোগাড় করে উঠে পারেননি। তাতেই সামনে চলে এল সিবিআইয়ের ব্যর্থতা।
উল্টোদিকে জয়নগরের পর ফরাক্কা। ধর্ষণ-খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধের তদন্তে রাজ্য পুলিসের দক্ষতার প্রমাণ মিলল আরও একবার। গত সপ্তাহে বারুইপুরের বিশেষ পকসো আদালত জয়নগর-কাণ্ডে দোষী সাব্যস্তকে ফাঁসির সাজা দেয়। আর শুক্রবার মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আদালত ফরাক্কায় ন’বছরের নাবালিকা ধর্ষণ-খুনের মূল অভিযুক্তকে ফাঁসির সাজা শোনাল। এক্ষেত্রেও অপরাধীদের কঠোরতম সাজা ঘোষণা হল ঘটনার ৬২ দিনের মাথায়। অপর এক দোষী সাব্যস্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
একই দিনে রাজ্য পুলিসের এহেন ‘সাফল্য’ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সদিচ্ছা ও দক্ষতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ফরাক্কার ঘটনায় রায় ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘আমি আবার বলছি, প্রত্যেক ধর্ষণকারীর কঠোরতম শাস্তি (ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট) পাওয়া উচিত। সমাজ থেকে এই ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধির মূল উৎপাটন করতে দ্রুত বিচার ও শাস্তিপ্রদান গুরুত্বপূর্ণ।’
আরও পড়ুন-শিক্ষাব্যবস্থার মুকুটে আরও এক পালক! NAAC-এর সেরা তকমা রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়কে, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী
মূল অভিযুক্ত দীনবন্ধু হালদারকে ফাঁসি এবং তার সহযোগী শুভজিৎ হালদারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন জঙ্গিপুরের অতিরিক্ত দায়রা আদালতের বিচারক অমিতাভ মুখোপাধ্যায়। ঘটনার ২১ দিনের মধ্যে ফরাক্কা থানার পুলিস চার্জশিট জমা দিয়েছিল। রায় শুনে এদিন আদালত চত্বরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নির্যাতিতা শিশুর মা ও পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে মেয়ে সুবিচার পাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশও করেছেন তাঁরা। সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘এটা যে একটা নৃশংসতম ঘটনা, তা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে পেরেছি।’ এদিন দুই আসামিকে কড়া পুলিসি নিরাপত্তায় আদালতে নিয়ে আসা হয়। নাবালিকাকে অপহরণ, গণধর্ষণ করে খুন ও খুনের পর তথ্যপ্রমাণ লোপাটের একাধিক ধারায় তাদের বৃহস্পতিবার দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।
বিজয়া দশমীর সকালে নাবালিকা যখন বাড়ির বাইরে খেলছিল, তখন দীনবন্ধু তাকে ফুল দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে আসে শুভজিৎ। দু’জনে মিলে তাকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করে। শুভজিৎ ধর্ষণকারী হলেও অপহরণ ও অপরাধের পরিকল্পনায় সে যুক্ত ছিল না বলেই ফাঁসির সাজা থেকে রেহাই মিলেছে।
আরও পড়ুন-গল্ফগ্রিনকাণ্ডে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একজন আটক, তড়িঘড়ি সিট গঠন
চিত্রটা পরিষ্কার। আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তে নেমে সিবিআইয়ের কার্যত ল্যাজেগোবরে অবস্থা। জয়নগর আর ফরাক্কায় রাজ্য পুলিশের ন্যায় বিচার প্রদানে সফল। সিবিআই ব্যর্থ। কলকাতা পুলিসের তদন্তই সঠিক ছিল। বোঝাই যাচ্ছে আরজি কর কাণ্ডের তদন্তভার রাজ্যের পুলিসের হাতে থাকলে তদন্ত দ্রুততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গেই হত। ‘সিট’ এই ঘটনার তদন্ত করলে দোষীর এতদিনে ফাঁসির সাজা হয়ে যেত। সিটে অনেক দক্ষ অফিসার আছেন। তাঁদের হাতে তদন্তভার থাকলে কাজটা তাড়াতাড়িই হত।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।