শীত-ভোরের কুয়াশা নিয়ে কাব্য-কথা কম নেই। নানাবিধ নস্ট্যালজিয়াও কমবেশি সবার সংগ্রহেই আছে। কিন্তু শহর কলকাতা গত কয়েক বছর যাবৎ কুয়াশার কারণে বেশ বিড়ম্বিত হয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটেছে, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাতিল হয়েছে উড়ান, বিলম্বিত হয়েছে ট্রেন। কিন্তু ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে কুয়াশা। পরিবেশে এর প্রভাব ও কারণ নিয়ে আবহাওয়াবিদ রামকৃষ্ণ দত্ত–র সঙ্গে বিস্তারিত কথা বললেন প্রীতিকণা পালরায়
আরও পড়ুন-কটাক্ষ ডেরেকের
শীতের সঙ্গে কুয়াশার সম্পর্ক কলকাতার সঙ্গে রসগোল্লার মতোই! কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা উপভোগ্য থাকছে না। ভোরের কুয়াশা থেকে যাচ্ছে বেলা অবধি কিংবা সূর্য ডোবা মাত্র ফিরে আসছে জাঁকিয়ে। চারপাশ অস্বচ্ছ। ফলস্বরূপ দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতার যেসব রাস্তাঘাট তুলনামূলক ফাঁকা, সেই সব অঞ্চলে কিংবা বাইপাস ও হাইওয়েতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কেন ঘটছে এটা?
এর কারণ বলতে গেলে এক কথায় বলা যাবে না। পরিবেশ বা পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গে আসব তবে তার আগে কলকাতার ভৌগোলিক অবস্থানটাও এর জন্য অনেকটা দায়ী, যা আমাদের কারও হাতে নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটারের চেয়েও কম উচ্চতায় কলকাতার অবস্থান। কিন্তু সমুদ্র অঞ্চল থেকে দূরত্ব অনেকটাই। সমুদ্রের কাছাকাছি যেসব শহরের অবস্থান তাদের কিছু অবস্থানগত সুবিধে থাকে, যেমন মুম্বই, চেন্নাই। কলকাতা সেসব সুবিধে থেকে বঞ্চিত।
আরও পড়ুন-দিল্লি দূষণ: আবার সুপ্রিম তোপে কেন্দ্র
এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলছি পরে। এছাড়া গঙ্গা নদী বাদ দিলেও এক সময় কলকাতার আশপাশে জলাভূমি বহুল পরিমাণে ছিল। বিশেষত কলকাতার পূর্বদিকে বারাসত থেকে বারুইপুর বিস্তীর্ণ এলাকা খাল-বিলে পরিপূর্ণ ছিল। একই কথা খাটে অধুনা সল্টলেক বা নিউটাউন অঞ্চলের জন্য। সেখানেও একসময় প্রচুর ওয়াটার বডি ছিল। ভেড়ি ছিল। গত কয়েক বছর যাবৎ যার সংখ্যা দ্রুত হারে কমেছে। নগরায়ণ এর কারণ। ফলে কলকাতার ভৌগোলিক চরিত্রের চেঞ্জ হচ্ছে। পরিবেশ, আবহাওয়ায় এর প্রভাব পড়বে সেটা খুবই স্বাভাবিক। কুয়াশা সংক্রান্ত যা ঘটছে তা এরই প্রতিফলন।
আরও পড়ুন-আজ মুম্বই সফরে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
একটু বিস্তারিত বলবেন?
দেখুন ওয়াটার বডিস থাকা ও না-থাকার মধ্যে তাপ বিকিরণের বিস্তর একটা ফারাক তৈরি হয়। সারাদিন সূর্যের যে তাপ বিকিরিত হয়, স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ তার দ্বারা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়, ধীরে ধীরে শীতল হয়। অর্থাৎ যাকে আমরা টেরেস্ট্রিয়াল রেডিয়েশন বলি, তার দ্বারা স্থলভাগ ও জলভাগ দু’ভাবে প্রভাবিত হয়। জলভাগের পরিমাণ যত কমবে তত স্থলভাগ দ্রুত গরম হবে, দ্রুত ঠান্ডা হবে। এর প্রভাব আবহাওয়ায় পড়বেই। ফলে এই যে গত কয়েক বছরে জলভাগ বুজিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি হওয়া বা রাস্তাঘাট তৈরি হওয়া এতে স্থলভাগের পরিমাণ কলকাতায় ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নগরায়ণের দায় তাই কলকাতাবাসীকে নিতে হবেই। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে দূষণ। যে হারে জনসংখ্যা ও গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে এ শহরে, তাতে প্রতিদিন পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড-এর পরিমাণ বাতাসে বাড়ছে। আর এসবের অনুপাত বেড়ে যাওয়া মানেই পুওর ভিসিবিলিটি বাড়তে থাকা।
আরও পড়ুন-BJP: বিজেপি নেত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৩ লক্ষ টাকা প্রতারণার অভিযোগ
‘পুওর ভিসিবিলিটি’ বলতে কী বলতে চাইছেন?
সাধারণভাবে যাকে ‘কুয়াশা’ বা ‘ফগ’ বলা হয়, আমরা আবহাওয়াবিদরা তাকে আমাদের ভাষায় ‘পুওর ভিসিবিলিটি’ই বলি। তাহলে যেটা দাঁড়াল, এই ‘পুওর ভিসিবিলিটি’র জন্য দায়ী, এক, হাইড্রোমেটিওর, যার ভেতর জলীয় কণা থাকছে ও দুই, লিথোমেটিওর, যার মধ্যে ধূলিকণা থাকে।
হাইড্রোমেটিওর যেভাবে ভিসিবিলিটি কমিয়ে দেয়, তার মধ্যে পড়ে ফগ, মিস্ট এগুলো। রাত ন’টা থেকে সকাল ন’টা পর্যন্ত এরা বিরাজ করে সাধারণত। ভিসিবিলিটি ১০০০-১৫০০ মিটারের মধ্যে হলে ‘মেটিরিওলজিক্যাল’ ভাষায় বলা হয় ‘মিস্ট’, বাংলায় যা ‘কুহেলিকা’। আর ভিসিবিলিটি যদি ১০০০ মিটারের থেকে কম হয়, তখন তাকে বলি ‘কুয়াশা’। আর এসবগুলো ঘটে ওই রাত ন’টা থেকে সকাল ন’টার মধ্যেই। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ‘লিথোমেটিওর’ যেটা, অর্থাৎ ‘স্মগ’ বা ‘ধোঁয়াশা’ বিকেল চারটে থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত থাকছে শীত পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ‘ওয়াটার পার্টিকেল, ডাস্ট পার্টিকেলের পাশাপাশি যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে আর বাতাস ‘কাম’ অর্থাৎ স্থির থাকে, এই চারটে কন্ডিশন একসঙ্গে ঘটে গেলে সেদিন মিস্ট বা ফগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন-টার্গেট ২০২৪
বাতাস স্থির থাকার ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
এতক্ষণ যে ফ্যাক্টরগুলোর কথা বললাম তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য আর যে বিষয়টি জড়িয়ে, সেটা ‘বাতাস’। কুয়াশার সঙ্গে বাতাস ও তার গতির সরাসরি সংযোগ। বাতাসের গতি বেশি থাকলে কুয়াশা দাঁড়াতে পারে না, ভেসে যায়। কলকাতায় এটাও একটা বিরাট অসুবিধের ব্যাপার, কারণ শীতে, অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কলকাতা শহরে বাতাসের পরিমাণ খুব কমে যায়।
আরও পড়ুন-মোদি সরকারের একটাই নীতি, আধিপত্যবাদ
লক্ষ করলে দেখা যায় যেসব মেগাসিটি সমুদ্রের পাড়ে অবস্থিত, সে লন্ডন, নিউইয়র্ক সিটি হোক কিংবা আমাদের মুম্বই, চেন্নাইয়েও, জনসংখ্যা বা তার দরুন পলিউশন কম হয়, কারণ সমুদ্রের বাতাস অনেক কার্যকরী ভূমিকা নেয় এসব জায়গায়, ফলে ফগ, মিস্ট, স্মগ এসব কোনওটাই তেমন বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছতে পারে না। কলকাতার অবস্থানও যদি সমুদ্রের কাছাকাছি হত তবে যে শীতের কুয়াশার ক্রমবর্ধমানতা নিয়ে আমরা এত চিন্তিত হচ্ছি, তা হতে হত না। কারণ সমুদ্র জলের একটা বিশাল ক্ষমতা থাকে তাপ ধরে রাখার আর তারপর ধীরে ধীরে ছাড়ার। এবং সামুদ্রিক বাতাস কুয়াশাকে জমে থাকতে দেয় না দীর্ঘক্ষণ। সব মিলিয়ে ‘মেজর ভেরিয়েশন’ও কম হয় তাপমাত্রার।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের দল নামাতে চাই সঠিক স্ট্র্যাটেজিও
কুয়াশারও কি রকমভেদ আছে?
হ্যাঁ, আছে তো। মূলত রেডিয়েশনের কারণে যেহেতু ফগ হয় তাকে আমরা বলি, রেডিয়েটিভ কুলিং ফগ। এছাড়া আর্থ সারফেস আর বাতাসের উচ্চতার মধ্যে একটা ‘ঠান্ডা-গরম’ সম্পর্ক আছে। যত ওপরে ওঠা যাবে তত বাতাস গরম হবে আর আর্থ সারফেসের কাছের বাতাসের তাপমাত্রা ঠান্ডা হবে। ফলে সূর্য ডোবার পর সারফেস ও সংলগ্ন বাতাস যত ঠান্ডা হবে যে সমস্ত ময়েশ্চার সে হোল্ড করে রাখছে তারা আরও বড়দানায় পরিণত হয়ে ভিসিবিলিটি কমিয়ে দেবে। প্রথমে হবে ‘হেজ’, এরপর ‘মিস্ট’, তারপর ‘ফগ’, এর সঙ্গে থাকছে ‘স্মগ’। ২-৫ কিলোমিটারের দৃশ্যমানতা থাকলে তা ‘হেজ’, প্রথম স্টেজ। এরপর দৃশ্যমানতা ১৫০০-১০০০ মিটারের মধ্যে থাকলে তা ‘মিস্ট’, দ্বিতীয় স্টেজ। রিলেটিভ হিউমিডিটি এক্ষত্রে ৮০% এর কাছে থাকে, এটাই যখন আরও কনডেন্সড হয়ে তৃতীয় স্টেজ ‘ফগ’-এ কনভার্ট করবে, তখন রিলেটিভ হিউমিডিটি হয়ে যাবে প্রায় ১০০%। আর দৃশ্যমানতা থাকে এক্ষেত্রে ০-১০০০ মিটারের মধ্যে। মাটি থেকে ২০০-৩০০ মিটারের মধ্যে ইনভারসান থাকে ‘ফগ’-এর ক্ষেত্রে। এই তিনটিই হল হাইড্রোমেটিওর পার্টিকল গ্রুপে।
আরও পড়ুন-বিধায়কের হাজার অনুরাগী তৃণমূলে
‘স্মগ’ কি তার মানে এই তিনটির থেকে আলাদা?
হ্যাঁ। স্মগে থাকে মূলত লিথোমেটিওর গ্রুপের উপাদান যার মধ্যে সালফার, কার্বন, নাইট্রোজেনের ডাস্ট পার্টিকল, গাড়ির ধোঁয়া, চিমনি বা উনুনের ধোঁয়া এসব থেকে যা বাতাসে মেশে। সঙ্গে খানিক হাইড্রোমেটিওর উপাদানও অবশ্যই থাকে। এই যে কলকাতায় বিকেল চারটের পর থেকেই শীতকালে ভিসিবিলিটি কমতে থাকে বা গাড়ির কাচ ঝাপসা হতে থাকে তার জন্য প্রাথমিক দায়ী ‘স্মগ’। এক্ষেত্রে রিলেটিভ হিউমিডিটি সব সময়েই ৮০-র থেকে কম থাকে। স্মগের সময় কলকাতা শহরে বিকেল চারটে থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত। হেজ, মিস্ট, ফগ-এর সঙ্গে এই স্মগ-এর পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাওয়াতেই কলকাতায় বিপদের সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই নাগরিক সচেতনতা ও প্রশাসনিক সতর্কতা না বাড়লে এর থেকে মুক্তির উপায় নেই।