প্রাকৃতিক বৈচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনন্য। সেই সৌন্দর্যের অমূল্য সম্ভার হল জঙ্গল মহল। একদিকে কংসাবতী, সুবর্ণরেখা ও ডুলুং নদীর বয়ে চলা অন্যদিকে ঢেউ খেলানো লাল মাটি, শাল সেগুনের জঙ্গল যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশ। একসময় মাওবাদী কার্যকলাপের ক্ষতিগ্রস্ত এই জঙ্গলের ভূ-স্বর্গ আজ যেন পুরোটাই উজাড় করে দিয়েছে ভ্রমণার্থীদের সামনে। মাওবাদী সমস্যা সমাধানের অন্যতম কারিগর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গল মহলের উন্নয়ন যেন দু-হাত ভরে করেছেন। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের জন্য বিনা পয়সায় রেশন, কন্যাশ্রী প্রকল্প, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, জয় জোহার অথবা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান পুরো জঙ্গলমহলের চালচিত্র বদলে দিয়েছে। একসময় পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষজন উন্নত জীবনযাপন করছে তার মূলে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঢালাও উন্নয়ন।
আরও পড়ুন-চিন্ময়কৃষ্ণের জামিন, এপার বাংলায় এসে সরব আইনজীবী
যদি একটু ইতিহাসের পাতা উল্টাই তাহলে দেখতে পাব, একটা সময় সুবর্ণরেখা নদীর বয়ে চলা জলকেই বাংলা ও উড়িষ্যার সীমারেখা হিসেবে বর্ণনা করা হত, এবং এই সীমারেখার চুক্তি করেছিলেন তৎকালীন বাংলার নবাব আলিবর্দি খান ও মারাঠা সর্দার রঘুজি ভোসলে৷ ১৭৫৭ সালে ইংরেজ কোম্পানি প্রথম বাংলার এই পশ্চিম প্রান্তের সুবিস্তৃত অরণ্যভূমিকে জঙ্গলমহল নামে আ্যখা দিয়েছিলেন। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করার পর ইংরেজরা জঙ্গলমহলে রাজস্ব আদায়ের আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তারপর থেকে লালগড়, জামবনি, শিলদা অঞ্চলের রাজারা বিদ্রোহ শুরু করে। ১৭৬৫ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছর কৃষক বা চুয়াড় বিদ্রোহ চলার পর ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমাগত বিদ্রোহে কোনও অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তারা অন্য নীতি নিয়ে ১৮০৫ সালে ২৩টি পরগনা বা মহল নিয়ে গঠন করলেন জঙ্গলমহল জেলা৷ সুতরাং জঙ্গলমহল নামটি কিন্তু ২০০ বছরের ও বেশি প্রাচীন। জঙ্গলমহলের এক দীর্ঘ ইতিহাস তার সৌন্দর্যের ডালি যেন আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠন হওয়ার পর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ২৩টি ব্লককে জঙ্গলমহল বলে অভিহিত করে। পাহাড়, জঙ্গল, মালভূমি, নদী ঝনার এক অপরূপ মেলবন্ধন এই জঙ্গলমহল। পুরুলিয়া দিয়ে যদি শুরু করি তাহলে বলব গড় পঞ্চকোট, জয়চণ্ডী পাহাড়, পাঞ্চেত পাহাড় ও বাঁধ, টুরগা জলপ্রপাত, তেল্কুপি, রাকার অরণ্য, মুরাভি বাঁধ, সীতা কুন্ড, মুরগুমা নদী, দুর্গাবেরা জলাশয়, বামনি জলপ্রপাত, খাইরাবেড়া সেচ বাঁধ তাছাড়াও নানান পর্যটন কেন্দ্র সহজেই ভ্রমণার্থীদের মন জয় করে নেবে।
যদি বাঁকুড়ার কথা বলি তাহলে মুকুটমণিপুর, বিষ্ণুপুর, জয়রামবাটি, শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ পাহাড়, জোড়াবাংলা মন্দির, মদনমোহন মন্দির, ঝিলিমিলি যাকে ‘দক্ষিণের দার্জিলিং’ও বলা হয়। সকল চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য সমানভাবে পর্যটকদের বিস্মিত করেছে। ডাক বিভাগের বিশেষ খামে জায়গা করে নিয়েছে বাঁকুড়ার টেরাকোটা ও বালুচরি শাড়ি। এছাড়া পর্যটকদের আকর্ষণ করে রেখেছে ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি, জুলজিকাল পার্ক, কনক দুর্গা মন্দির, বাঁদরভুলা ইকো-ট্যুরিজম, ট্রাইবাল ইইন্টারপ্রিটেশান সেন্টার, সাবিত্রী মন্দির, লালগড় রাজবাড়ি, রামগড় রাজবাড়ি, চিল্কিগড় রাজবাড়ি, রামেশ্বর মন্দির ইত্যাদি। ভ্রমণ মানচিত্রে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক আলাদা ঐতিহ্য বহন করে।
আরও পড়ুন-জল অপচয় রুখতে ৯২৩ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
নয়াপোতার পটচিত্র গ্রাম দর্শকদের মুগ্ধ করবেই। এছাড়া ১৮৫১ সালে নির্মিত সেন্ট জনস চার্চ, ঔপনিবেশিক কারাগার হিজলিজেল, খড়গপুরের প্রত্যুষা পার্ক একটি ঘন মরূদ্যান যা নগরজীবন থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। সুবর্ণরেখা নদী যা মনকে প্রশান্ত আশ্রয় প্রদান করে। কংসাবতীর নদীর তীরে সূর্যাস্তের হাট পর্যটকদের জন্য প্রকৃতির প্রবেশদ্বার বলা হয়৷ এছাড়া আদিবাসী সংগ্রহশালা শিল্প ও সংস্কৃতির এক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার জঙ্গলমহলের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে যেমন, পর্যটন মানচিত্রের বিকাশ, আর্থিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন, নতুন বিমানবন্দর তৈরি ইত্যাদি। পর্যটন এলাকা ছাড়াও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সবজি চাষের বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য সরকার। সেখানকার গরিব মানুষদের বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সারের জোগান দিচ্ছে উদ্যানপালন দফতর, যাতে গরিব চাষিরা স্ব-নির্ভর ও আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হয়। সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চলের সাত জেলায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, রাস্তা নির্মাণ, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া কোটি টাকা খরচ করে সৌরবিদ্যুৎ-চালিত পানীয় জলের প্রকল্প হচ্ছে পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে।
আরও পড়ুন-দিনভর টালায় মেরামতি, আজ থেকে স্বাভাবিক জল সরবরাহ
পর্যটন বিভাগের জন্য ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে ৫১৯.৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, শুধু পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন বিষয়ক বিভাগের জন্য ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে ৭৫২.২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। নতুন নতুন ইকো-ট্যুরিজম পার্ক তৈরি করে পর্যটকদের জন্য হোমস্টে তৈরি করার এক ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। যার মধ্যে নতুন কিছু অঞ্চল যেমন, আউশগ্রামের জঙ্গলমহল এলাকার গ্রাম ‘হেদোগড়িয়া’ এখন ময়ূর-ময়ূরীর অবাধ বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যার টানে দূরদূরান্তের পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে সেই গ্রামে। বিশেষকরে জঙ্গলমহলে বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা যেন জঙ্গলমহলকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। শাল, সেগুন, পিয়াল বনের জঙ্গলে রাত্রিবাস এক আলাদাই অনুভূতি। রাজ্য সরকারের নেপথ্যে বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্পের যে রক্ষণাবেক্ষণ, যেমন কনকদুর্গা মন্দিরের আধুনিকীরণ, শতাব্দীপ্রাচীন মদনমোহন মন্দিরের সংস্কার ইত্যাদি পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলবে বইকি! চিল্কিগড়ের আদিবাসী সম্প্রদায়ের আতিথেয়তা পর্যটকদের আরও মন কাড়বে। শুধু ঝাড়গ্রাম জেলায় সরকারি সহায়তায় ১০০ টির বেশি হোমস্টে তৈরি করা হয়েছে। পাহাড় ঝরনা-ঘেরা ময়ূরঝরনা গ্রামটি পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ২০১১ থেকে ২০২২ (কোভিড-পরবর্তী) সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটকদের সংখ্যা ৮৯ মিলিয়নে পৌঁছেছে যা CAGR (Compound Annual Growth Rate) বৃদ্ধি প্রায় ১২.৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় ও দেশীয় পর্যটকদের সংখ্যায় অষ্টম। প্রতি বছর ‘জঙ্গলমহল উৎসব’-এর মাধ্যমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে যা আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে, এই সময় অনেক পর্যটকের আনাগোনা হয়। আর এই পর্যটকদের আনাগোনা জঙ্গলমহলের মানুষদের আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ করছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর জঙ্গলমহলে পর্যটনে আগামীদিনে যে বিপ্লব আসতে চলেছে তা বলাইবাহুল্য। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে জঙ্গলমহলের যে এক অদৃশ্য লড়াই পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তা ভ্রমণপিপাসু মানুষজন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।