নরেন্দ্র মোদির সাধের প্রজেক্ট ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ (One nation One Election)! অথচ, লোকসভায় সেই সংক্রান্ত বিল পেশের দিন প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভো কাট্টা। হুইপ জারির পরও বিজেপির ২০ জন এমপি সংসদে অনুপস্থিত। উল্টো দিকে বিল পেশের দিন শক্তি প্রদর্শন করল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’।
‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিল পেশ করতেই মঙ্গলবার কালঘাম ছুটে গেছিল মোদির বিজেপির। এই পদক্ষেপ কার্যকর করতে প্রয়োজন সংবিধান সংশোধনের। আর দুই কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা না পেলে সেই উদ্যোগ মাঠে মারা যাবে। সংশোধন তো অনেক দূর, বিল পেশ করতে গিয়েই রীতিমতো হোঁচট খেতে হল মোদি সরকারকে। ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ অমিত শাহকে নরম সুরে বলতে হল, ‘এই সংবিধান সংশোধন বিল পেশে বিতর্কের কিছু নেই। বিলটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আলোচনার সময়ই প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, এটিকে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো দরকার।’ অর্থাৎ, শুরু থেকেই ব্যাকফুটে চলে গেল কেন্দ্র। বিল পেশে সময় লাগল ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। আর তারপর বিল চলে গেল জেপিসিতেও। সৌজন্যে? বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’র হুঙ্কার। প্রথম ভোটাভুটি (ডিভিশন) চাইলেন তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তিতে বিল পেশের পক্ষে ভোট পড়ল ২২০। বিপক্ষে ১৪৯। অনেকেই ঠিকমতো ভোট দিতে পারেননি। পরে কাগজের স্লিপে মত দিলেন তাঁরা। ফাইনাল রেজাল্ট— বিল পেশের পক্ষে ২৬৩। বিপক্ষে ১৯৮। অর্থাৎ, বিরোধীদের শক্তিতে ২৭২ অঙ্কও পেরোতে পারল না শাসক এনডিএ। মোদি সরকার বুঝে গেল, গরিষ্ঠতার দাপট দেখিয়ে এই সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হবে না। সেই অবস্থাতেই নেই নরেন্দ্র মোদি। প্রশ্ন হল, বিজেপি সাংসদরাও এ নিয়ে কতটা সিরিয়াস? মোদি অনুপস্থিত, নীতিন গাডকারিও। আর বঙ্গ বিজেপির চার এমপি। বিরোধী বেঞ্চে রাহুল গান্ধী, কে সি বেণুগোপাল বা তৃণমূলের মালা রায়, দীপক অধিকারী (দেব), শত্রঘ্ন সিনহা, শতাব্দী রায় ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু এই বিল তো তাঁদের স্বপ্নের প্রজেক্ট নয়! চাপ তাই কেন্দ্রের। দিল্লির দরবারে প্রশ্ন দানা বাঁধছে, আদৌ এই বিল পাশ হবে তো?
লোকসভায় সংবিধান সংশোধন বিল পাশ করাতে গেলে ওই দিন উপস্থিত সাংসদদের দুই-তৃতীয়াংশকে পক্ষে ভোট দিতেই হবে। তারপর রাজ্যসভা। এদিন বিল পেশের সময় লোকসভায় উপস্থিত ছিলেন ৪৬১ জন সাংসদ। তর্কের খাতিরে এদিনই যদি বিলটি পাশ করতে হত, সরকারের প্রয়োজন ছিল অন্তত ৩০৭টি ভোট। তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি বিজেপি শিবির। বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল। ১২৯তম সংবিধান সংশোধন বিল। সঙ্গে ‘দ্য ইউনিয়ন টেরিটরিজ লজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল ২০২৪’। বিল পেশের সময়ই প্রবল আপত্তি তোলে তৃণমূল, কংগ্রেস, ডিএমকে, উদ্ধবপন্থী শিবসেনা, শারদ পাওয়ারের এনসিপি, সিপিএমের মতো বিরোধীরা। বিরোধিতার কারণ, সংবিধানের ভিত্তি নষ্ট হবে। আহত হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হবে অত্যধিক ক্ষমতা। গোটাটাই আঞ্চলিক দলের কোমর ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। দলত্যাগ বিরোধী আইন শক্তপোক্ত না করে এই বিল পাশ হলে গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ। ক্ষমতাসীন পার্টি চাইলে যে কোনও দল ভেঙে রাজ্যের সরকার ফেলে দেবে। তাই মোদির এই ষড়যন্ত্র মোটেই সফল হতে দেবে না তৃণমূল কংগ্রেস। যৌথ সংসদীয় কমিটি। লোকসভা। রাজ্যসভা। তারপর রাষ্ট্রপতির সই। দিল্লি কিন্তু ক্রমেই মোদির থেকে দূরে সরছে। এমনিতেই আগামী এক-দু’বছরের মধ্যে পাশ হলে ২০৩৪ সালের আগে এই সংশোধন কার্যকরের সম্ভাবনা নেই। ততদিন ক্ষমতা থাকবে তো?
অন্যদিকে, মোদি সরকার কথা রাখেনি। তাও বাংলার ১১ লক্ষ প্রান্তিক মানুষকে পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু বিগত তিন বছরে নানা অজুহাতে একটি টাকাও ছাড়েনি। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হয়েই রেড রোডের ধরনা মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি ছিল— ‘ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্র অর্থবরাদ্দ না করলে, রাজ্যের কোষাগার থেকেই গরিব মানুষকে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়া হবে।’ সেই প্রতিশ্রুতি পালন করলেন বাংলার অগ্নিকন্যা। ডিসেম্বরের ‘ডেডলাইন’ শেষ হওয়ার ১৩ দিন আগেই। মঙ্গলবার রাজ্যের ১২ লক্ষ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আবাস যোজনার বাড়ি তৈরির প্রথম কিস্তির টাকা প্রদানের সূচনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্পূর্ণটাই রাজ্যের কোষাগার থেকে। তাই এই প্রকল্পের নামও তিনি রেখেছেন ‘বাংলার বাড়ি’।
আরও পড়ুন- প্রয়োজনে রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করতে পারে
মঙ্গলবার নবান্ন সভাঘর থেকে প্রতীকীভাবে ৪২ জনের হাতে এই প্রকল্পের সুবিধা তুলে দেন মমতা। তারপরই জেলায় জেলায় উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো শুরু হয়ে যায়। এই পর্বে কেন্দ্রের আবাস তালিকার বঞ্চিতদের পাশাপাশি রয়েছে রেমাল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় বাড়ি ক্ষতিগ্রস্তদের নামও। তবে ১২ লক্ষেই থেমে থাকবে না নবান্ন। যাচাই পর্বের শেষে পঞ্চায়েত দপ্তর যোগ্য প্রাপকদের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে মোট ২৮ লক্ষের নাম রয়েছে। তাই বাকি ১৬ লক্ষ উপভোক্তাকেও রাজ্যই টাকা দেবে বলে এদিন ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, দু’টি পর্যায়ে এঁদের টাকা দেওয়া হবে। আগামী বছরে ২৮ লক্ষ উপভোক্তাই টাকা পাবেন। এবার যাঁদের টাকা দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের বাদ দিলে বাকি থাকবে আর ১৬ লক্ষ। তাঁদের মধ্যে আট লক্ষ উপভোক্তা টাকা পাবেন আগামী মে-জুন মাসে। আর বাকি আট লক্ষ ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। আর বাংলার মানুষ জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা দিলে কথা রাখেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা পূরণ করেন।
আবাস নিয়ে রাজ্যে ৬৯টি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েও, কোনও অনিয়ম পায়নি কেন্দ্র। তাও আবাসের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। মোট ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকার বকেয়া নিয়ে নিশ্চুপ মোদি সরকার। উল্টে সেসের অঙ্ক বাড়িয়েই চলেছে। নিজের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাজ্য।
এ-সবের জবাব পাবেন মোদি পক্ষ ২০২৬-এ, ইভিএম-এ। তখন বুঝবেন হাড়ে হাড়ে…