বাবাসাহেবকে অপমান করাটা বিজেপির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি

রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাবাসাহেব আম্বেদকর-বিষয়ক মন্তব্য আর সেটা ঘিরে চাপান-উতরের মধ্যেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন অম্বেদকরের পৌত্র তথা প্রাক্তন সাংসদ প্রকাশ আম্বেদকর। শাহের বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের নোটিশ জারির ব্যাপারে উদ্যোগী তৃণমূল কংগ্রেস। সেজন্য প্রকাশ ধন্যবাদ জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। এই আবহে রাজনীতির আকচাআকচি শুধু নয়, আম্বেদকরের মত, পথ ও দর্শন যে সর্বতোভাবে বিজেপির বিপ্রতীপে, সেটা প্রকাশ্যে আনতে কলম ধরলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

* হিন্দু ধর্ম স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের জন্য হুমকি। সেক্ষেত্রে এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান।
* তিনি বিজেপি মার্কা হিন্দু হিসেবে মরতে চান না, এবং সেজন্যই শিখ দর্ম, এমনকি শেষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হন।

‘‘এখন এক ফ্যাশন হয়েছে— অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর। এত বার যদি ভগবানের নাম নিতেন তবে সাতজন্ম স্বর্গবাস হত।” বক্তা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
প্রথমেই একটা কথা ওঁকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, যেটাকে উনি ফ্যাশন বলছেন, সেই ফ্যাশন শোতে দরকার মতো শামিল হয়েছে গেরুয়া পক্ষও। নিজেদের ধান্দায়, সত্যিটা গুলিয়ে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য।
“বাবাসাহেব কখনই ব্রাহ্মণবিরোধী ছিলেন না। তিনি সব ধরনের জাতিভেদ ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন।” বক্তা মনমোহন বৈদ্য। ২৯১৬-তে তিনি যখন মন্তব্যটি করেছিলেন, তখন তিনি আরএসএস-এর প্রধান প্রচারক ছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেন।
আজ অমিত শাহ আম্বেদকর (Babasaheb Ambedkar) ফ্যাশনের কথা বলছেন। জানতে ইচ্ছে করে, ২০১৬-তে, যখন আম্বেদকরের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আরএসএস একের পর এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল আম্বেদকরের মতাদর্শে হিন্দুত্ববাদী ঝোঁক তুলে ধরা, তখন এই ফ্যাশনের কথাটি মনে হয়নি কেন? আম্বেদকর (Babasaheb Ambedkar) ব্রাহ্মণবাদী হিন্দুত্বের সমালোচক ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে ছিলেন। আর আরএসএস? সংঘ পরিবার? তাদের আদর্শ দুটি প্রধান স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে। একটি হল ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্ম এবং দ্বিতীয়টি হল হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা।

আরও পড়ুন- নতুন বছরে ফের ধনকড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা বিরোধীদের

তেলে আর জলে মিশ খায়? খেতে পারে?
হিন্দু ধর্মের প্রচলিত সংস্কারকে তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মতত্ত্ব বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, হিন্দুধধর্মে প্রচলিত সংস্কার মূলত একটি বর্ণপ্রথা, যেটাকে অস্পৃশ্য-দলিতদের পক্ষে সবচেয়ে বড় যন্ত্রণাদায়ক বলে মনে করতেন আম্বেদকর। প্রথমদিকে তিনি হিন্দু ধর্মে অন্তর্লীন জাতিভেদ প্রথার শৃঙ্খল ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। চাভাদর তালাব আন্দোলন, কালারাম মন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। মনুস্মৃতিও পোড়াতে গিয়েছিলেন কারণ এই গ্রন্থ তাঁর কাছে বর্ণ ও লিঙ্গ শ্রেণিবিন্যাসের প্রতীকস্বরূপ।
সেই মানুষটাকে হিন্দুত্ববাদী বলে চালাতে চায় বিজেপি! তাঁর মতাদর্শকে বিজেপির জাতীয়তাবাদী অস্মিতার সঙ্গে এক করে দেখাতে চাইছে ওরা। সেটা সম্ভব?
‘রিডলস অফ হিন্দুইজম’-এ যিনি লিখছেন, “আমি মানুষকে সচেতন করতে চাই যে হিন্দু ধর্ম সনাতন ধর্ম নয়’, যিনি চাইছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যাতে না তারা ব্রাহ্মণ্যবাদের ছলাকলার (devices) দ্বারা, প্রতারিত ও বিপথগামী না হয়, তাঁকে হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে রাখা হবে কোন বিবেচনায়?
এই হিন্দুত্ববাদীদের রকমসকম লক্ষ্য করে আম্বেদকর (Babasaheb Ambedkar) বলেছিলেন, “হিন্দু ধর্ম স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের জন্য হুমকি। সেক্ষেত্রে এটা গণতন্ত্রের সাথে বেমানান।” আর আজ অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদিরা বলছেন, আম্বেদকরের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা নেই, নেহরুর সমাজতন্ত্রী ধারণার সঙ্গে আছে। যে আম্বেদকর জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন, তিনি বিজেপিমার্কা হিন্দু হিসেবে মরতে চান না এবং সেজন্যই শিখ ধর্ম, এমনকী শেষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হন।
এ-বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “আমার ধর্মান্তরিত হওয়াটা কোনও বস্তুগত লাভের জন্য নয়। এমন কিছু নেই যা আমি অস্পৃশ্য থেকেও অর্জন করতে পারিনি। আমার ধর্মান্তরিত হওয়া সম্পূর্ণরূপে আমার আধ্যাত্মিক মনোভাবের বাইরের বিষয়।” প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্ম তাঁর বিবেকের কাছে কোনও আবেদন রাখেনি। তাই সংকীর্ণ হিন্দুত্বের পরিধির বাইরে নিজেকে বের করে আনতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। এক জাতি বনাম দ্বিজাতি তত্ত্বের ক্ষেত্রে আম্বেদকর জিন্না আর সাভারকরের মধ্যে কোনও পার্থক্য দেখেননি। আর তাই, আজ যাঁরা ভারতের সাম্প্রদায়িক সংহতি নাশ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করছেন, তাঁরা আর যাই হোন, আম্বেদকরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন।

যে রাম বিজেপির হিন্দুত্ববাদের হাতিয়ার সেই রামকে আম্বেদকর নিঃসংশয়ে মেনে নেননি। রামচন্দ্রকে বাঙালির মধু-কবি যেমন দোষে গুণে ভরা মানুষ হিসেবে দেখেছেন, আম্বেদকরও তেমনই সমালোচনার দৃষ্টিতে রামকে বিদ্ধ করেছেন। ‘জয় শ্রী রাম’ হুংকারে যাঁরা গগন কাঁপাতে চায়, তাঁদের দলে আম্বেদকরকে ফেলা যাবে না। যিনি লোকের কথায় কান দিয়ে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন এবং বারো বছরে একবারের জন্যও স্ত্রী-পুত্রের খবর নিতে পারেননি, তাঁকে আদর্শ পুরুষের আসনে বসাতে নারাজ আম্বেদকর। শম্বুক বধ যে দলিতদের প্রতি আর্য সংস্কৃতির মনোভাব সুস্পষ্ট, বলেছেন আম্বেদকর। আর তিনি কিনা বিজেপির পতাকা তলে?
আম্বেদকর বলতেন, যদি হিন্দুরাজ বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে এটি এই দেশের জন্য সেটা সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হবে। হিন্দুরা যাই বলুক না কেন, হিন্দুধর্ম স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের জন্য হুমকি। সে-কারণে এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান। যেকোনও মূল্যে হিন্দুরাজ প্রতিরোধ করতে হবে।
আর বিজেপি চাইছে হিন্দুরাজ। দুটোতে কোনও মিল আছে?
বিজেপি আম্বেদকরের আদর্শকে নিজের মতবাদের সঙ্গে এক করে দেখাতে আগ্রহী। তাদের এই প্রচেষ্টা মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার মতো। এটি তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের একটি পদক্ষেপ। আম্বেদকরের আদর্শগত মূল্যবোধের সঙ্গে তারা গভীরভাবে জড়িত, এটা লোকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, তারা একরকম রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করতে পারবে। সেটাই ওদের ধান্দা।

Latest article