সারদামণির জীবনদর্শন বাম-বিজেপি বোঝে না

সদ্য-অতিক্রান্ত তাঁর ১৭২তম জন্মতিথি। জন্মের সার্ধশতবর্ষ পরেও তাঁকে চেনা, বোঝা, পড়াটা কেন দরকার, তার আলোচনায় দেবু পণ্ডিত

Must read

কাশীর জ্ঞানবাপী, মথুরার শাহি ইদগা, মধ্যপ্রদেশের ভোজশালা থেকে হালে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে শাহি জামা মসজিদ কিংবা রাজস্থানের আজমির শরিফ— দেশ জুড়ে একের পর এক জায়গায় মসজিদের নিচে মন্দিরের খোঁজ শুরু হয়েছে। কখনও সমীক্ষা, কখনও সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছে। এরকম ভারতে দাঁড়িয়ে আরএসএস-এর সরসংঘচালক বলছেন, ‘যত্রতত্র রামমন্দির ধাঁচের আন্দোলন শুরু করা যায় না। …সবকিছুর মধ্যেই রামমন্দির ইস্যুকে খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা একেবারেই বরদাস্ত করা যায় না।’ বহুকাল আগে এই কথাটিই অন্য ভাবে বলেছিলেন সারদা দেবী (Saradamani)।

ইসলামি শাসনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে মন্দির ভাঙার ঘটনা ঘটেছিল, সেসব কথা তুলে একদা এক ভক্ত সারদাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এই যে এত অত্যাচার তার তিনি (ভগবান) কী করলেন?’ সারদা সহজ ভাবে বললেন, ‘তাঁর অনন্ত ধৈর্য। এই যে তাঁর মাথায় ঘটি ঘটি জল ঢালছে দিনরাত, তাতেই বা তাঁর কী? আর শুকনো কাপড় দিয়ে ঢেকে পূজা করো, তাতেই বা তাঁর কী? তাঁর অসীম ধৈর্য।’

সবকিছুর মধ্যে রামমন্দির ইস্যু ঢুকিয়ে না-দেওয়ার যে বার্তা, এখানেও সেই বার্তা। শুধু কিঞ্চিৎ অন্যভাবে। যুগের প্রয়োজন মেনে সহিষ্ণুতার উচ্চারণ। ভার্জিনিয়া উলফ বলতেন, সত্যের মধ্যে একটা সদ (Real অর্থে) গুণ থাকে, সেটা প্রায় অতীন্দ্রিয় শক্তি। রেডিয়ামের মতো তা যুগপৎ শক্তি ও আলোককণা বিচ্ছুরিত করে। যে কোনও সংবেদনশীল মনকে সেটা উদ্দীপ্ত করে। সারদামণির মধ্যে সেই রেডিয়াম-সুলভ গুণ ছিল। এসব কথা কি ওই হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডাধারীরা মনে রেখেছেন? না। রাখার কোনও তাগিদও কস্মিনকালে অনুভব করেননি।
হিন্দু বিধবা হয়েও মাথায় দিয়েছিলেন সিঁদুর। কিন্তু নিজেকে আড়াল করতে পারেননি ননীবালা। পেশোয়ার থেকে গ্রেফতার করা হল তাঁকে। নিয়ে আসা হল কাশীতে। চলল অকথ্য নির্যাতন। একটা কথাও তাঁর কাছ থেকে বের করতে পারল না ব্রিটিশ পুলিশ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হল ননীবালাকে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন তিনি। পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের শত কাকুতিমিনতিতেও অনশন ভাঙলেন না তিনি। তখন আসরে নামলেন গোয়েন্দা পুলিশের স্পেশ্যাল সুপারিনটেন্ডেন্ট গোল্ডি। বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেন, ননীবালা যদি খাবার মুখে তোলেন তবে গোল্ডি তাঁর যেকোনও ইচ্ছে মেটাতে রাজি। ননীবালাকে তাঁর ইচ্ছা জানানোর জন্য একটা দরখাস্ত লিখতে বলা হল। ননীবালা দরখাস্ত লিখলেন। তাঁর আর্জি, ‘আমাকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্ত্রীর কাছে রেখে দিন, তাহলে খাব।’ দরখাস্তটা নিয়ে গোল্ডি সেটাকে ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ছেঁড়া কাগজের টুকরিতে ফেলে দিল। অমনি স্পটে গোল্ডির গালে একটা চড় কষিয়ে দিলেন ননীবালা। দ্বিতীয় চড়টা মারতে যাবেন। ঠিক তখনই উপস্থিত বাঙালি গোয়েন্দা কর্মচারীরা তাঁর হাত চেপে ধরল। বিপ্লবী অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দূর সম্পর্কের পিসিমা ছিলেন ননীবালা। তাই গোয়েন্দারা বলে উঠল, ‘পিসিমা করেন কী? করেন কী?’ গর্জে উঠলেন ননীবালা, ‘ছিঁড়ে ফেলবে তো, আমায় দরখাস্ত লিখতে বলেছিল কেন?’ সরকারি নথি বলছে, ১৯১৮-র ৩ নং রেগুলেশনে ধৃত বাংলার একমাত্র মহিলা স্টেট প্রিজনার ননীবালা দেবী। রেডিয়াম তাঁর মধ্যে যুগপৎ শক্তি ও আলো সঞ্চারিত করেছিল।

যে রামচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে জেলে দেখা করতে গিয়েছিলেন ননীবালা সেই রামচন্দ্র মজুমদার অরবিন্দ আর তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে সারদা সকাশে গেছিলেন বাগবাজারে । সেখানে পৌঁছে সস্ত্রীক অরবিন্দ দোতলায় উঠে গেলেন। সারদাদেবীকে প্রণাম করলেন দুজনে। সারদা অরবিন্দকে দেখে বলে উঠলেন, ‘এইটুকু মানুষ, এঁকেই গভর্নমেন্টের এত ভয়!’ আদর করে বললেন, ‘আমার বীর ছেলে।’ ২ মে ১৯০৮- এ আলিপুর বোমার মামলায় গ্রেফতার হলেন অরবিন্দ। মৃণালিনী দেবীর মনে হল, ‘তাঁহার সঙ্গছিন্ন আমার জীবনে মৃত্যুই একমাত্র পথ।’ দেবব্রত বসুর বোন সুধীরা মৃণালিনীকে নিয়ে গেলন সারদামণির কাছে। সারদা তাঁকে বললেন, ‘চঞ্চল হোয়ো না মা, চাঞ্চল্যে কিছু লাভ নেই। তোমার স্বামী শ্রী ভগবানের আশ্রিত পুরুষ, ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি অতি সত্বর নিষ্পাপ প্রমাণে মুক্ত হয়ে আসবেন।’

দেশপ্রেমের এই অঙ্গীকারের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীরা কি কখনও একাত্মবোধ করেছেন? একেবারেই করেননি। করার কোনও দায় কস্মিনকালে তাঁদের ছিল না। এবং বামপন্থীরা? সারদা রামকৃষ্ণ অরবিন্দ, এসব তাঁদের কাছেও সদা ব্রাত্য বিষয়। ১৯৪২-এর অগ্নিক্ষরা প্রহরে এই দুপক্ষই ব্রিটিশদের পদলেহন করতে ব্যস্ত ছিল। দেশমাতার নামে শপথ নিয়ে শহিদত্ব অর্জনের ঝুঁকি নেয়নি কোনও পক্ষই।

আরও পড়ুন-নতুন করে তদন্ত মামলা নিতে অসম্মত হাইকোর্ট

সারদামণির (Saradamani) লেখাপড়ায় ঝোঁক ছিল। নিজের বাপের বাড়িতে কখনও বাধা পাননি। ভাই প্রসন্ন, তুতোভাই রামনাথ পাঠশালায় যেত। ওদের সঙ্গেই কখনওসখনও পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ হত। নিজেই বলেছেন, ‘তাতেই একটু শিখেছিলুম’। কিন্তু বিয়ের পর ছবিটা বদলাল। জয়রামবাটির মেয়ে কামারপুকুরে এলেন বউ হয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের মেজো দাদা রামেশ্বরের মেয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে একটু একটু ‘বর্ণপরিচয়’ পড়তেন। শ্বশুরবাড়ির মেয়ে লক্ষ্মীর যে স্বাধীনতা ছিল বালিকাবধূর যে তা ছিল না, সেটা টের পেলেন হৃদয়ের আচরণে। হৃদয় শ্রীরামকৃষ্ণের ভাগনে। তিনি সারদার হাত থেকে ‘বর্ণপরিচয়’ কেড়ে নিলেন। বললেন, “মেয়েমানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই। শেষে কি নাটক-নভেল পড়বে?”

সেই নিগ্রহের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে নিজের মুখে শুনিয়েছেন সারদা। চড়া গলায় বলা কথা না-হলেও, সেই স্মৃতিতে যে বেদনা ভেজা জল ছিল, প্রতিবাদের আঁচ ছিল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সারদামণি বলছেন, “লক্ষ্মী তার বই ছাড়লে না। ঝিয়ারি মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে”। অর্থাৎ, বাড়ির মেয়ে লক্ষ্মী হৃদয়ের কথায় কান দেয়নি। সে বাড়ির বউ নয়, ‘ঝিয়ারি মানুষ’। তাই তার সরব প্রতিবাদ, দৃশ্যত হৃদয়কে অমান্য করার সুযোগ ছিল। কিন্তু পরিবারের বধূ হিসেবে সে স্বাধীনতা রামকৃষ্ণজায়া সারদার ছিল না।
ভাগনে হৃদয় মামিমার ‘বর্ণপরিচয়’ পড়া জোর করে ধমকে বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির কেউ তার কথায় আপত্তি জানাননি। সারদামণিও হৃদয়ের সঙ্গে বাক্-বিতণ্ডায় অবতীর্ণ হননি। অথচ, তাঁর কথা মেনেও নেননি। তিনি কী করলেন? সারদা জানাচ্ছেন, “আমি আবার গোপনে আর একখানি (বর্ণপরিচয়) এক আনা দিয়ে কিনে আনলুম। লক্ষ্মী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত। সে এসে আবার আমায় পড়াত”। পরে দক্ষিণেশ্বরে আর একটু ভালভাবে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিংবা বলা ভাল, করে নিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন চিকিৎসার জন্য কলকাতার শ্যামপুকুরে। দক্ষিণেশ্বরে সারদামণি একাটি আছেন। ভব মুখুয্যেদের বাড়ির একটি মেয়ে গঙ্গায় নাইতে আসত। সে মাঝে মাঝে সারদামণির নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে কাটাত। সারদা বলছেন, সেই অবকাশেই চলত পাঠ প্রদান ও শিক্ষালাভ। মুখুয্যে বাড়ির মেয়েকে নিজের সংসারের শাকপাতা গুরুদক্ষিণা হিসেবে দিয়ে লেখাপড়া শিখতেন সারদা। মেয়ে হলেই বিয়ে দিতে হবে, গৌরীদানে কৌলীন্য রক্ষা হবে, এমন কথা কোনওদিন ভাবেননি। যাতে কেউ এমনটা না-ভাবে, সে বিষয়ে সদা সতর্ক থেকেছেন। মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না বলে কেউ উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত হয়ে তাঁকে কিছু বললেই সারদা বলতেন, “বিয়ে দিতে না পার তো ভাবনার কী আছে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দাও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে”।

শুধু সিস্টার নিবেদিতার স্কুল নয়, গৌরী মা-র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিও তাঁর সুপ্রসন্ন দৃষ্টি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, সেলাই প্রভৃতি কাজ শিখছে, এতে তাঁর আনন্দ। যখন কোনও অভিভাবক মেয়েদের সেরকম সুযোগ না দিয়ে ‘আট বছর হতে না হতেই’ বলতে শুরু করতেন, “পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও”, তখন সারদা তাঁদের দেখে এই ‘পোড়া দেশের’ জন্য আক্ষেপ করেছেন। এইভাবে প্রাচীন আদর্শের শেষ প্রতিনিধি হয়ে সারদামণি পুরুষতান্ত্রিকতার যাবতীয় কুশ্রীতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি বটে, তবে নবীন আদর্শের অগ্রদূত হিসেবে নারী স্বাধীনতার সহায়ক কার্যাবলিতে নিজের আস্থা প্রকাশে কোনও দ্বিধা করেননি। এই যে বলা হচ্ছে, ‘সারদামণি নবীন আদর্শের অগ্রদূত ছিলেন’, সেটা নেহাতই একটা কথার কথা, এমনটা নয়। অথচ বাম -বিজেপি কোনও পক্ষই কথাটা সোচ্চারে কস্মিনকালে বলেনি। কেন বলেনি, সেটা আপনারাই বুঝে নিন।

Latest article