নতুন বছর, আসতে আর মাত্র কিছুদিন। সংখ্যাতাত্ত্বিকরা বলছেন ২০২৫-এর যোগফল হল ৯। সংখ্যাতত্ত্বে ৯ মানে মঙ্গল অর্থাৎ লাল গ্রহ বা মার্স। মানবদেহের যে পাঁচটি তত্ত্ব পৃথ্বীতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, জলতত্ত্ব এবং আকাশতত্ত্ব তার মধ্যে অগ্নিতত্ত্বের মালিক হলেন মঙ্গলগ্রহ। সূর্য যদি হন রাজা তবে মঙ্গল হলেন তাঁর সেনাপতি। ওরেব্বাস সেনাপতি!!! তাঁর মানেই হল নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, আত্মসংযম আর তৎপরতা। না হলেই কিন্তু বিপদ।
যত ভোরে উঠবেন আর যত পরিশ্রম করবেন ততই মঙ্গল।
পুষ্টিকর খাবার খাবেন, জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড বাদ দেবেন, নেশাভাঙ যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাবেন। আর সবচেয়ে বেশি যেটা করবেন তা হল ব্যায়াম, যোগাসন, ধ্যান বা মেডিটেশন (Meditation)। না হলেই রোগ¬¬ব্যাধি, হাসপাতাল আর কী! অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, অনিয়ম, রাত জাগা, বেলা অবধি ঘুমোনো, দেদার পেটপুজো, অলসতা, কড়া ভাষা, চড়া সুর কোনওটাই সহ্য করবে না সেনাপতি। তাই মনকেও রাখতে হবে শান্ত। আসলে শুধু সংখ্যাত্বত্ত্বের বিচারে নয়, জীবনকে উন্নত করার একমাত্র রাস্তাই লাইফ স্টাইল মডিফিকেশন। যা ব্যায়াম এবং মেডিটেশন থেকেই আসে। স্ট্রেস, অ্যাংজাইটির যুগে দিনে দিনে বাড়ছে ধ্যানের গুরুত্ব। বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন নিয়মিত ধ্যান করার।
কেন ধ্যান করবেনই
ধ্যান নিয়ে অনেকরকম ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন ধ্যান করা মানে চোখ বন্ধ করে বসে মনে মনে ঠাকুরের চিন্তা করা। তা নয়। ধ্যান করতে বসে আপনি চাইলে ঈশ্বরকে বা ইষ্টকে স্মরণ করতেই পারেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ। তবে সেটাই ধ্যান নয়। তাহলে ধ্যান কী? ধ্যান বা মেডিটেশন হল মস্তিষ্কের গভীর বিশ্রাম। আমরা সারাদিন ব্যস্ত থাকি, কিছু না কিছু করেই চলি। রাতে যখন শুতে যাই তখনও আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু সচলই থাকে। সে বেচারা বিশ্রাম পায় না কারণ সারাদিনের সব ঘটনাপ্রবাহ মস্তিষ্কে জমা হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। ধ্যান বা মেডিটেশন (Meditation) মস্তিষ্কের এই অবিরাম চলাকে বেশ কিছুটা সময় পজ করে দেয় ঠিক আমরা যেমন ফোনে বা টিভিতে পজ বাটন চাপি আর সব স্থবির হয়ে যায় তেমনই। জেগে থাকা এবং ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক মাঝের চিন্তাশূন্য একটা স্তর হল ধ্যান বা মেডিটেশন। যা আপনার দেহ এবং মন উভয়কেই ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করবে। ক্লেদাক্ত শরীর, মন হবে পরিস্রুত।
ধ্যানের উপকারিতা
মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে ধ্যানের দ্বিতীয় জুড়ি নেই।
সাংসারিক জীবন এবং কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে নিয়মিত ধ্যানের অভ্যেস।
অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায় ধ্যান ফলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা কমে।
কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে ধ্যান।
স্ট্রেসের কারণে যে হরমোনগুলো অতিরিক্ত নিঃসরণ হয় সেগুলো কমাতে সাহায্য করে।
শরীর এবং মনকে রিল্যাক্স করে। গভীর বিশ্রাম দেয়।
সামনের যে কোনও পরিস্থিতি এবং মানুষের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা বা অ্যাকসেপটেন্স বাড়ায় ধ্যান।
মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
আত্মিক আনন্দ বাড়ায় ধ্যান।
হজমশক্তি বাড়ায় ধ্যান।
মুড সুইং বা ঋতুস্রাব বা মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনে মনে যে চাপ বাড়ে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র ধ্যান ।
ধ্যানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনই ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হয়।
উচ্চরক্তচাপ, কোলেস্টেরল, থাইরয়েড-সহ বহু রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে মেডিটেশন (Meditation)।
ব্যথা, যন্ত্রণারও উপশম করে মেডিটেশন।
পরিবার, কর্মক্ষেত্র বা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করে ধ্যান। অসীম ধৈর্যশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন- আমেরিকা সবক শেখাল ইউনুসকে
কীভাবে করবেন ধ্যান
আধঘণ্টা থেক ৪৫ মিনিট সুখাসনে বা সুবিধামতো অন্য কোনও ধ্যানাসনে বসতে হবে।
ধ্যানের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় হল ব্রাহ্ম মুহূর্ত অর্থাৎ ভোর ৪টে থেকে ৫টা ৩০ পর্যন্ত। এই সময়টা সবার পক্ষে ধ্যান করা সম্ভব নাও হতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা অনেক রাত করে বাড়ি ফেরেন, তাঁদের। তাঁরা যখন সম্ভব ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ধ্যান করে তারপর অন্য কাজ শুরু করুন। আরও একটা সময় হল সায়ংকাল অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময়। এছাড়া আপনার দৈনিক রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে দিনের যে কোনও সময় করতেই পারেন ধ্যান।
ধ্যানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পরিবেশ। অর্থাৎ কোন পরিবেশে ধ্যান করছেন সেটা। কারণ পরিবেশ যদি শান্ত, নিশ্চুপ না হয় তাহলে ধ্যানের অভ্যেস গড়ে উঠবে না।
ধ্যানে বসার সময় আপনার বসার পশ্চার বা ভঙ্গিমা যেন ঠিক থাকে অর্থাৎ শিরদাঁড়া বা মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতে হবে। দু’হাত দুই হাঁটুর ওপর হাতের তালু উপরের দিকে করে রাখতে হবে। ধ্যানের মুদ্রা না জানলে করার দরকার নেই।
ধ্যানের সময় কখনও যেন খুব ভরা পেট অথবা একদম খালি পেটে বসবেন না। হালকা কিছু খেয়ে ধ্যানে বসুন। খাওয়ার পরে ধ্যান করতে চাইলে দেড়ঘণ্টা পর করুন।
ধ্যানের আগে কয়েকটা ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম অথবা স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করে নিন। অন্তত দুটো প্রাণায়াম অনুলোম বিলোম, কপালভাতি করে বা ওম চ্যান্টিং করে বসুন। আসলে শারীরিক দৃঢ়তা না থাকলে ধ্যানের গভীরে যাওয়া মুশকিল।
ধ্যানে বসার প্রাথমিক অসুবিধে
প্রথমবার যখন বসছেন ধ্যানে একটা অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। রেস্টলেসনেস আসতে পারে। গা, হাত-পা ইচিং বা চুলকানো ভাব অনুভূত হবে।
ঘুম পাওয়া এবং ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়া বা ঝিমিয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক লক্ষণ। তাই আগে একটু ব্যায়াম করে ধ্যানে বসলে শরীর মন ঝরঝরে হয়ে যায়। ধ্যানে বসে ঘুম পেলেও সমস্যা নেই।
ধ্যান বা মেডিটেশনে (Meditation) সফল হওয়া কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজেরই একটা লড়াই। কারণ নিজের মধ্যে অন্তর্লীন হওয়া সহজ নয়। এক কথায় আয়না দেখা যাকে বলে। সবাই কি আয়না দেখতে চায়? কিন্তু যদি একবার আয়নায় নিজেকে চিনে নিতে পারেন নতুন বছরে এবং আগামী জীবনে আপনার জয় নিশ্চিত।