ইতিহাস ভূগোলের ওঠানামায় সান্তাক্লজের ভূমিকার অদলবদল হয়েছে, খুব একটা তা নয়। বরং, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জীবনে, ডিসেম্বরের শীতকাতর সময়গুলোয় পৃথিবী জোড়া এক আশ্চর্য অপেক্ষা। ঠিক কবে থেকে শুরু এ অপেক্ষার। এ নিয়ে মিথ-এর শেষ নেই। আর সেইসব মিথ ভেঙে দার্শনিক মতবাদের নিজস্ব ঘেরাটোপটিও শক্তপোক্ত। তবে, ইতিহাস খুঁড়লে চতুর্থ শতকের মায়রাহের কথা মনে আসেই। সেই মায়রাহ যা এখন টার্কি নামে আমাদের সবার চেনা। ছোট্ট বন্দর শহর। সে শহরের খ্রিস্টান বিশপ সেন্ট নিকোলাসের কাছে, নাবিকরা তো বটেই, সেই সঙ্গে সদ্য বিবাহিতরাও আসতেন আশীর্বাদ নিতে। নিকোলাস ছিলেন দেবতার মতোই এক পরম আশ্রয়। সব বয়সের সব মানুষের।
আরও পড়ুন- ইডির অফিস থেকে ঘুষের টাকা উদ্ধার করল সিবিআই
পরপর তিন অবিবাহিতা মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে অপারগ সেসময় শহরের এক পিতা। সে অসহায়তার খবর পান নিকোলাস। খবর পান, টাকার জোগাড়ের জন্য, নিজের মেয়েদের পতিতালয়ে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন পিতা। আর ঠিক তখনই, নিকোলাস নিজের টাকার ব্যাগটি রেখে আসেন, রাতের অন্ধকারে দরিদ্র পিতার ঘরে। পরদিন, খুব স্বাভাবিক ভাবেই অযাচিত এমন অর্থ সমাগমকে ঈশ্বরের দান মনে করেন পিতা। পরপর দুটি মেয়ের বিয়ের টাকা এভাবে পেয়ে যাওয়ার পর, তৃতীয় বারে নিকোলাসের দানটি ধরা পড়ে যায়। কিন্তু, তাতে কী। পীড়িত মানুষের পাশে দেবত্বের বসুধারা তো চিরকাল কোনও এক অমৃত সন্তানের হাত ধরেই নেমেছে। নিকোলাস হয়ে উঠলেন, সেই সুধামৃতের নাবিক। সেন্ট নিকোলাস থেকে সিন্টার ক্লজ, আর তা থেকেই সান্তাক্লজ। অযাচিত প্রাপ্তির ঝুলিটি পূর্ণ করে দিয়ে চলে যান, সারা পৃথিবী জুড়ে, আজও। লোককথা অনুযায়ী উত্তর মেরুতে মিসেস সান্তাক্লজকে নিয়ে জুটি বাঁধা এ ঈশ্বর তনয়, খ্রিস্টজন্মের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর রাতে, বেরিয়ে পড়েন, উপহারের ডালি নিয়ে। তার আগে, শিশুদের জন্য তৈরি করেন, দীর্ঘ তালিকা। দুষ্টু ও শান্ত শিশুর সে তালিকায় উপহারের জন্য নির্বাচিত হয়, শান্ত শিশুরা। তবে, এ-সবটাই রূপকথা। বির্তকের নিরিখে, সান্তাক্লজের যাবতীয় মিথের পিছনে বড়দিনের আনন্দকে বাণিজ্যকরণের চেষ্টা একেবারে উড়িয়ে দেবারও নয়। তবে, উড়ানো যায় না, যে সত্য, তা হল, প্রয়োজন আর প্রাপ্তির সমীকরণ শেষে দরিদ্র মানুষের কান-এঁটো করা হাসি। সুদূর অতীতের নিকোলাস, আজও তাই লাল-সাদা পোশাকের দাড়িওয়ালা ঝুলি কাঁধে ঘুরে বেড়ানো স্বপ্ন। আমাদের সবার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটি হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে শান্তি ত্যাগ তিতিক্ষার চিরকালের সত্য। যেখানে মাথা রেখে ঘুমালে, কোনও এক শীতের রাতে ঝোলানো মোজা ভরে উঠবে কাঙ্ক্ষিত পাওনায়। লোভ ঈর্ষা প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র থেকে দূরে থেকে সান্তার জন্য অপেক্ষা। পশ্চিমবঙ্গের হতদরিদ্র মানুষের কাছে কোনও দিন কোনও সান্তাক্লজ এসেছেন কিনা জানা নেই। তবে, দুপুরের একপেট খিদের সামনে, সাদাভাত আর ডাল-ডিমের নিশ্চিত আশ্বাসটুকু ‘ডিম্ভাতের’ বিদ্রুপে ঘিরে রাখার মিথ্যে চেষ্টায় ছায়াগ্রস্ত তো হয়ই না, বরং চকচকে চোখ অপেক্ষা করে। কন্যাশ্রীর টাকাটুকু লেখাপড়ার বল ভরসা হয় নাবালিকা মেয়েটার। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা প্রান্তিক বাউলগানের মানুষটি শিল্পী-ভাতার টাকায় দুবেলা ভাত ফোটান হাঁড়িতে। মুখ্যমন্ত্রীর একটার পর একটা সরকারি প্রকল্পের সার্বিক জোয়ারটুকু সাধারণ মানুষের ঝুলি পূর্ণ করলে, সত্যি সত্যিই ভাবতে ইচ্ছে করে, সান্তাক্লজ বুঝি দিয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তো তা না। কোনও সাগরপারের বিদেশি সন্ত নন। এক্কেবারে চেনা বাংলার চিরচেনা ঘরের মেয়ে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এ এক আশ্চর্য পাঠ। শীত-ভেজা নবান্নের দেশে বসে দরিদ্র সাধারণ মানুষের পূর্ণতার প্রাপ্তি। অস্বীকারের কোনও জায়গাই নেই।
আরও পড়ুন- গঙ্গাসাগর নিয়ে বৈঠকে মন্ত্রী ফিরহাদ