বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা
বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা কাশীবাই। কবে কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মনে নেই। জ্ঞান হয়ে ইস্তক নেড়া মাথা, সাদা থান আর হবিষ্যির ভূরিভোজ। শরীরে মনে বয়সের আগুন পাপের ভয়ে সয় দহন জ্বালা। কোনও এক সোনার আংটি শাস্ত্রীজির সাথে কাশীবাই জড়ালেন সম্পর্কে যার ফলভোগ একান্তই মেয়েদের। সোনার আংটি ততদিনে পগারপার। বাঁচার তাগিদে সন্তানের গলার নলি কেটে হত্যা করলেন মা। ধরা পড়ে মহারানির বিচার ব্যবস্থায় কাশী হলেন দ্বীপান্তরবাসী। সময়ের সঙ্গে নিন্দার ঝড় থেমে গেলেও একজন নিম্নবর্ণের মহিলার মনে ঝড় তুলল এই ঘটনা। গোটা শহর জুড়ে পড়ল পোস্টার : আপনাদের শিশুদের হত্যা না করে এখানে চলে আসুন, সম্মানের সঙ্গে বাঁচুন। খুললেন একটি আশ্রম— ধর্ষিত, নিপীড়িত নারীদের আশ্রয় দিলেন ভারতের প্রথম মহিলা শিক্ষক সাবিত্রী বাই ফুলে। ভাল কাজ করে যারা মানুষ তাদের যায় না ভুলে, সে-যুগের নারী আজকেরও বিস্ময় সাবিত্রী বাই ফুলে।
আরও পড়ুন-কলকাতা পুলিশের তদন্তেই সিলমোহর, সঞ্জয় রাইয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি চাইল সিবিআই
কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে
সিপাহি বিদ্রোহের আগুন তখনও জ্বলেনি, কোম্পানির আমল পেরিয়ে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতের ভার নেওয়ার তখনও ছাব্বিশ বছর দেরি। পাঁচ বছর পর কামার পুকুরে হবে ধর্ম বিপ্লবের আবির্ভাব। ভারতের এরকম এক রাজনৈতিক সময়ে মহারাষ্ট্রে ১৮৩১ ৩ জানুয়ারি সাবিত্রী বাই-এর জন্ম। যুগ যুগ ধরে জমে থাকা অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারের পুরু স্তর ভেদ করে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো সমাজে পড়ছে ইতিউতি। সেই আলোর রেখা পড়েছিল ভুল করেই হয়তো এই অন্তেবাসী মেয়ের ওপর। ভুল তো নিশ্চয়ই, কেননা একে দলিত সম্প্রদায়ের তাতে আবার মেয়ে! সে-যুগের গল্পের পর সমাজ দুশো বছরের কাছাকাছি পথ চলেছে তবুও এখনও সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রবল বিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, মেয়েরা আজও পণ্য, যৌতুক পণ জোগাতে বাবা ভিটে বেচে। পেটের দায়ে মেয়ে শরীর বেচে। বর বিয়ে করতে যাওয়ার আগে মাকে বলে যায় ‘দাসী আনতে যাচ্ছি’, সারা দিন পরিশ্রম করে সংসার ধরে রাখা মেয়েরা অভ্যাসে বলে ‘কিছু করি না’। তবুও কিছু মেয়ে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে দেশ শাসন করে, কেউ-বা সমুদ্র কেউ-বা পর্বত বিজয় করে ফেরে। ডাক্তার হয়ে প্রাণ বাঁচায়, শিক্ষক হয়ে মানুষ তৈরি করে। এসব আজকের দিনে স্বাভাবিক হলেও দুই শতাব্দী আগে এগুলো মানুষের কল্পনাতেও আসত না। তবুও অন্ধকারেই যুগে যুগে সাবিত্রীর মতো কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ জন্মায় যারা নতুন প্রজন্মকে আলোর স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায়, আনে ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
যে ফুলে আগুন থাকে
দরিদ্র কৃষক পরিবারের নিরক্ষর মেয়ের ৯ পেরিয়ে বিয়ে হল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ১৩ বছরের মালির ছেলের সঙ্গে। তখনকার সমাজ রীতিতে গল্পের এই অংশটুকুর মধ্যে কোনও চমক নেই। চমক এর পরের অংশে। নিজে পড়া চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া জানা বালক বীর স্ত্রীকে দাসী করে না রেখে করে তুললেন শিক্ষিতা। এর পর চলল মেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়ে উঠলেন শিক্ষিকা। ভারতের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা সাবিত্রী বাই ফুলে। পুণেতে ভিদে ওয়াদায় সাবিত্রী স্বামী জ্যোতিরাও ফুলের সহযোগিতায় খুললেন প্রথম মেয়েদের স্কুল ভিদে ওয়াদা। সাবিত্রী প্রধান শিক্ষিকা। ১৮৪০-এর ১ জানুয়ারি মেয়েদের শিক্ষার ইতিহাসে এক আলোর ঝলক। সে-যুগে দাঁড়িয়ে এক নিম্ন বর্ণের মহিলার এত সাহস যে মেয়েদের জন্য একটা গোটা স্কুল! ধর্মের ধ্বজাধারীরা গেল খেপে। জ্যোতিরাও-এর বাবাকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে তার বউমার অনাচার বোঝালেন। শিক্ষায় শূদ্রের অংশগ্রহণ শাস্ত্রবিরোধী তাতে আবার মেয়েদের নৈব নৈব চ। তাই এতে ঘোর অমঙ্গল হবে শূদ্রদের। অনিকেত হলেন সস্ত্রীক জ্যোতি। মুসলিম বাড়িতে পেলেন আশ্রয়। সেই ফতেমা শেখও সাবিত্রী জ্যোতির পথে চললেন আলো আনতে। কয়েক বছরে পুণে ও আশপাশে মোট আঠারোটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন সাবিত্রী ও জ্যোতিরাও। ১৮৬৩ সালে কাশী বাই সংক্রান্ত ঘটনায় ব্যথিত সাবিত্রী বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ নামে একটি আশ্রম খোলেন। এখানে ৩৫-এর বেশি ব্রাহ্মণ বিধবা আশ্রয় নিয়েছিলেন যাঁরা কোনও ভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। সে যুগের নিরিখে সাবিত্রী বাই এক অসম সাহসী বিপ্লবী।
আরও পড়ুন-ভোপাল গ্যাস-ট্র্যাজেডি চার দশক পরে সম্পূর্ণ সরানো হল বিষাক্ত বর্জ্য
তোমরা যতই আঘাত করো
দিদিমণি যখন ইস্কুল যান কাঁধের ঝোলাটা থাকে বেশ ভারী। বয়সে ছোট হলে কী হবে, রাশভারী বড়দিদিমণি সাবিত্রী। গোটা পুণে শহরে তখন একটা নামই চর্চার বিষয়। সাবিত্রীর স্কুলে যাওয়ার পথে তাঁকে লক্ষ্য করে ছেলেরা ছোঁড়ে পাথর, গোবর, নোংরা বাক্যে ও বস্তুতে। নিত্যদিনের ঘটনা, সাবিত্রী স্কুলে গিয়ে ব্যাগ থেকে পরিষ্কার কাপড় বের করে পরে নেন, তারপর চলে শিক্ষাদান পর্ব। একদিন ছেলের দলের মুখোমুখি হলেন সাবিত্রী— আমি তোমাদের বোনদের জন্য আলোয় সন্ধানে চলেছি, তোমাদের এসব বাধা আমার চলার পথে কোনও বিঘ্ন ঘটাতে পারবে না। মাথা নিচু করে ফিরে গিয়েছিল সেদিনের সেই ছেলেদের দল। এই ফুলে-দম্পতিকে হত্যা করার জন্য উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের লেঠেল পাঠিয়েছিল। ধরা পড়লে সাবিত্রী বলে এই কাজ করে তারা যে অর্থ পাবে তা দিয়ে যেন নিম্নবর্ণের মানুষের উপকারে আসে। কারণ তাঁর জীবন নিচুস্তরের মানুষদের উপকারে নিবেদিত। ক্ষমা চেয়ে চলে যায় লেঠেল। একবুক আশা নিয়ে সেও যাবে সাবিত্রী দিদির ইস্কুলে আলোর খোঁজে!
বাঁশি আমি দিয়ে যাব কাহার হাতে
সমাজসংস্কার, শিক্ষার প্রসার আর বর্ণ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সময় কাটান ফুলে-দম্পতি। কুসংস্কার আর অজ্ঞানতার অতলে ডুবে থাকা জাতি ভুলে গেছে কবেকার গার্গী, মৈত্রীর কথা। তারা জানে না গুণ ও কর্মের বিভাগে শুরু হয়েছিল বর্ণাশ্রম প্রথা। এ হাজার বছরের অন্ধকার একটু শিক্ষার আলো পেলেই দূর হয়ে যাবে একটু করে। তাই ফুলে-দম্পতির উদ্দেশ্য শিক্ষার প্রসারের। দম্পতি সন্তানহীন, তাই দত্তক নেন বালহত্যা প্রতিবন্ধক গৃহে আশ্রমের এক ব্রাহ্মণ বিধবার অবৈধ সন্তানকে— যশবন্ত রাও ফুলে। জ্যোতিরাও ফুলের মৃত্যুর পর সাবিত্রী তাঁর সমাজসংস্কার ও শিক্ষার প্রসারের কাজে পাশে পেয়েছিলেন ডাক্তার ছেলেকে। দেশে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে মায়ের আদেশে ছেলে সেনাবাহিনীর কাজ ছেড়ে পুণেতে চিকিৎসা শুরু করেন। এক প্লেগ রোগীকে পিঠে করে ক্লিনিকে আনাতে
প্লেগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান ভারতের প্রথম মহিলা শিক্ষক সাবিত্রী বাই ফুলে। দিনটা ছিল ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ। কাজের ফাঁকে কলমও ধরেছিলেন সাবিত্রী বাই। সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে একাধিক কবিতা রচনা করেছেন। দুটি কাব্যগ্রন্থ কাব্য ফুলে এবং বভন কাশী সুবোধ রত্নাকর।
আরও পড়ুন-প্রশাসনের উদ্যোগে বসেছে ৫০ ওয়াটার এটিএম
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন
আঠারোশো শতকের প্রথম দিকে ভারতের অন্ধকার-আচ্ছন্ন সে-যুগে একজন দলিত সম্প্রদায়ের মহিলার পক্ষে নিম্নবর্ণের মেয়েদের জন্য স্কুল খুলতে পারার লড়াইটা বেশ কঠিন ছিল। সমাজসংস্কারক, শিক্ষার প্রসার এসব কাজে পরে অনেকের নাম আসবে কিন্তু মনে বারবার ধাক্কা দেবে সময়টা। তাই সাবিত্রীর লড়াইটা ছিল কার্গিল প্রমাণ। মনের জোর আর সঙ্গীর যোগ্য সঙ্গত সাবিত্রীর চলার পথে অক্সিজেন জুগিয়েছে অনবরত। এইসব লড়াইয়ের ফলে আজ মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। তারা সংখ্যায় কম হলেও এগিয়ে চলেছে নানা দিকে। কিন্তু এই আগুন জ্বলল যাঁর হাত ধরে তাঁর কথা ক’জন মেয়ে জানে? পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাল্টে হয়েছে সাবিত্রী বাই ফুলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতীয় ডাকবিভাগ প্রকাশ করেছে ডাকটিকিট। মহারাষ্ট্রে ওঁর জন্মদিন ৩ জানুয়ারি ‘বালিকা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এছাড়া বড়জোর কোথাও ব্রোঞ্জ মূর্তি কিংবা একটা গলির নাম। মেয়েদের খিড়কি থেকে সদর দরজা যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেখিয়ে নিজের গোটা জীবন কাটালেন যে নারী তিনি কি আদৌ তাঁর যোগ্য সম্মান পেয়েছেন? জাতীয় শিক্ষক দিবসে তাঁর নামটা কি একটু আলো পেতে পারে না? আসলে জীবনভর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা সব সাবিত্রীরাই জানে এখনও মহিলাদের কৃতিত্ব বেশি স্বীকার করতে হলে পুরুষতন্ত্রে একটু ধাক্কা লাগে বইকি! তাহলে কি তাঁদের লড়াই বৃথা? সমাজসংস্কারককে কোনও সংস্কার করতে পারেননি? পেরেছেন বইকি! না-হলে আজ দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন কীভাবে! বৈষম্য, বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জোর তো সেসব লড়াইয়ের ফল। ছোটবেলায় যে মেয়েটি একটা ইংরেজি বইয়ের পাতা উল্টানোর জন্য বাবার কাছে মার খেয়েছিল, সেই মেয়ে হয়েছিল ভারতের প্রথম শিক্ষিকা। এই অদম্য জেদ বুকে থাকুক প্রতি মেয়ের। এখনও যা বৈষম্য আছে সেগুলো দূর করতে যুগে যুগে জন্মাক অনেক অনেক সাবিত্রী বাই— যুগান্তরের আশায়।