প্রতিবেদন : ক্রমশই শক্তি বাড়াচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। শক্তি বাড়িয়ে শুক্রবার তা শক্তিশালী সাইক্লোনের আকার নিতে চলেছে। শনিবার তা আছড়ে পড়বে ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে। ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগ। শনিবার থেকে এর প্রভাব টের পাবেন রাজ্যবাসী। এর জেরে উপকূলবর্তী জেলাগুলির পাশাপাশি সকলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আলিপুর হাওয়া অফিস। এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি সম্পর্কে আগাম জানিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে মৌসম ভবন। মৌসম ভবনের তরফে জানানো হয়েছে যে, দক্ষিণ থাইল্যান্ডের কাছে এই নিম্নচাপটি তৈরি হয়েছে। শক্তি বাড়িয়ে ক্রমশ তা ঘূর্ণাবর্তে পরিণত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সেখান থেকে পশ্চিমে সরে গিয়ে তা মধ্য আন্দামান সাগরে ছিল। শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর তা আরও শক্তি বাড়িয়ে পশ্চিম থেকে আরও উত্তর-পশ্চিমে সরে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনে পরিণত হবে। শনিবার ৪ ডিসেম্বর সকালের দিকে তা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তর উপকূল এবং ওড়িশা উপকূলের কাছে সাইক্লোন হয়ে আছড়ে পড়বে। এর জেরে ওই দুই রাজ্যে প্রবল দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দফতর। সেদিন থেকেই উপকূলবর্তী দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, হাওড়ায় বৃষ্টি শুরু হবে।
এদিকে শনিবার থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আবহাওয়ার বড়সড় পরিবর্তন হতে চলেছে। ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’ আছড়ে পড়বে সুন্দরবন উপকূলে। যার প্রভাবে ৭০ থেকে ৮০ কিমি বেগে ঝোড়ো বাতাস বইবে। ঝড়ের সঙ্গে ভারী বৃষ্টিও হবে। রবি ও সোমবার কমলা সতর্কতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর। শনিবার বিকেলের মধ্যে নদী ও সমুদ্র থেকে মৎস্যজীবীদের উপকূলে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেলার উপকূল এলাকায় পুলিশ, ব্লক প্রশাসন, মৎস্য দফতর ও কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে মাইকে সতর্কতার প্রচার শুরু হয়েছে। কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা, রায়দিঘি, কুলতলি, বাসন্তী, ক্যানিং, গোসাবার বিভিন্ন মৎস্যবন্দরে প্রচার চলছে। নামখানায় হাতানিয়া-দোয়ানিয়া, ক্যানিংয়ের মাতলা, কুলতলির ঠাকুরান নদীর উপরে লঞ্চ নিয়ে প্রচার চালায় পুলিশকর্মীরা। ঝড়ের পাশাপাশি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে অভিনব অভিযান ‘স্কুল ডাকছে’
জেলার ৭০ শতাংশ জমির আমন ধান পেকে গিয়েছে। ধান কাটাও চলছে। এইসময় ভারী বৃষ্টি হলে ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি ধান কেটে খামার মজুত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শীতকালীন সবজিরও ক্ষতির আশঙ্কা থাকছে। নিম্নচাপের দোসর হিসেবে থাকছে ভরা কোটাল। রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে অমাবস্যার কোটাল। জোড়া ফলায় আবারও সুন্দরবনের বেহাল নদী ও সমুদ্র বাঁধ উপচে জল ঢোকার আশঙ্কা থাকছে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন নিচু এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। সুন্দরবনের সব ফ্লাড সেন্টারগুলি তৈরি রাখা হয়েছে। ব্লক প্রশাসন শুকনো খাবার, ত্রিপল মজুত করেছে। শনিবার থেকে ব্লকগুলিতে কন্ট্রোলরুম খোলা হবে। জেলার অতিরিক্ত মৎস্য আধিকারিক (সামুদ্রিক) জয়ন্ত প্রধান বলেন, ‘‘সব বন্দর এলাকায় মাইকে প্রচার চলছে। শনিবার বিকেলের মধ্যে মৎস্যজীবীদের উপকূলে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ জেলাশাসক পি উলগানাথন বলেন, ‘‘দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য ব্লকস্তর থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত আছে।’’
আরও পড়ুন : ফের সাইক্লোনের প্রমাদ গুনছে বাংলা ওড়িশা
ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’ মোকাবিলায় প্রস্তুত দুই মেদিনীপুরের প্রশাসনও। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী ৩ ডিসেম্বরের পর অন্ধ্রপ্রদেশ ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়বে এই ঘূর্ণিঝড়। ইতিমধ্যেই দুই মেদিনীপুর-সহ উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে হলুদ সর্তকতা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই পূর্ব মেদিনীপুরে এসেছে এনডিআরএফ-এর দুটি দল। একটি দল দিঘায়, অন্য দলটি কাঁথিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকায় ৪৩টি মাল্টিপারপাস সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। যথারীতি মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে যাঁরা সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছেন, তাঁদের শুক্রবারের মধ্যে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে জেলা, মহকুমা ও ব্লক স্তরে খোলা হচ্ছে কন্ট্রোল রুম। উপকূলবর্তী এলাকায় এবং জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মাইকিং করা হচ্ছে। উপকূলবর্তী এলাকার মানুষজনকে সর্তকতার পাশাপাশি প্রয়োজনে তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি সেরে রাখছে প্রশাসন। দুই মেদিনীপুরের কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে মাইকিং করে চাষিদের দ্রুত আমন ধান কেটে বাড়িতে তোলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আলু, সবজি ও সরষে জমিতে যাতে জল না জমে তার জন্য আগাম ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি দফতর। দিঘা, শঙ্করপুর, মন্দারমণি ও তাজপুর পর্যটন কেন্দ্রে হোটেলগুলোতে প্রচুর পর্যটক রয়েছেন। শীতের এই মরশুমে আগামী বেশ কয়েকদিন হোটেলগুলোর বুকিংও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সতর্কবার্তা নিয়ে শুক্রবার ও শনিবার দিঘা শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের হোটেল মালিকরা বৈঠক করবেন। জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা অফিসার মৃত্যুঞ্জয় হালদার বলেন, “জেলাজুড়ে এই ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায় প্রশাসন প্রস্তুত।” এর আগের ঝড় মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এবার সেই অভিজ্ঞতায় কাজ চলছে।
অন্যদিকে সাইক্লোন নিয়ে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসের পরই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সাইক্লোন নিয়ে নয়াদিল্লিতে গুরুত্বপূ্র্ণ বৈঠক করে কেন্দ্রীয় সংকট মোকাবিলা কমিটি। বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়জনিত ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে এদিন রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা। এই বৈঠকে হাজির ছিলেন মৌসম ভবনের প্রধানও। বৈঠকে তিনি জানান, একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপরে। ৩ ডিসেম্বর এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের আকার নেবে। সেটি অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল অতিক্রম করবে ৪ ডিসেম্বর। সে সময় সাইক্লোনের গতি থাকবে ঘণ্টায় প্রায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। এর জেরে প্রবল বৃষ্টি ও সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত ওডিশা ও অন্ধ্র উপকূলে প্রাকৃতির দুর্যোগ দেখা দেবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেও দুর্যোগ ঘনিয়ে আসবে। এই বৈঠকে হাজির ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মুখ্যসচিব ও উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। যে রাজ্যগুলিতে বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা সেখানে আপাতত এনডিআরএফ বা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ৩২টি দলকে পাঠানো হয়েছে। তৈরি রাখা হয়েছে নৌবাহিনীকেও।