নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। ফেলে আসা বছরের ভুলগুলোকে সংশোধন করার প্রয়াসও শুরু হয় নতুন বছরে। তবে কিছু ভুল যা ভারত নামক রাষ্ট্রের পরিচালিকা শক্তি কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে, সেই ভুলকে সংশোধন করার অবকাশ খুবই সীমিত এবং সেই ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিকদের। ২০২৪ সাল আমাদের সামনে প্রমাণ করে দিয়েছে পরিবেশকে উপেক্ষা করা, পরিবেশকে যথেচ্ছ মাত্রায় ধ্বংসের পরিণাম কী ভয়ানক হতে পারে। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসের ৯৩ শতাংশ দিনই ভারতের নানা প্রান্তে আবহাওয়ার ক্ষেত্রে চরম অবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে দিল্লির তাপমাত্রা পেরিয়ে ছিল ৫০ ডিগ্রির গণ্ডি, দেশের অন্যান্য প্রান্তেও তাপপ্রবাহের সঙ্গে জুড়েছে ঘন ঘন সাইক্লোনের হানা, প্রবল বজ্রপাত, অস্বাভাবিক বৃষ্টি, বন্যা ও ধস। সব মিলিয়ে এসব ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৩২৩৮ জনের। প্রবল বন্যার কবলে পড়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, শুধুমাত্র ত্রিপুরাতেই ঘরছাড়া হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। এইসব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছিল কেরলের ওয়েনাড় বিপর্যয়, অতিবৃষ্টি আর হড়পা বানে পাহাড় ভেঙে নেমে আসা কাদাজল, পাথর রাতারাতি মুছে দিয়েছিল চূড়ামালা এবং মুণ্ডাক্কাই গ্রামকে। ২৫০-এর কাছাকাছি প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাবহীন। এই মৃত্যুমিছিলকে আটকানো যেত, যদি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে ভূমিধসের সতর্কবার্তার কাজটি সম্পন্ন করা যেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে, জেলাভিত্তিক ভূমিধসের সতর্কবার্তা দানের মডেলটি এখনও পরীক্ষামূলক স্তরেই আটকে রয়েছে।
বিজেপির সরকার তৃতীয়বারের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হলেও ২০১৪ সালের পর থেকে পরিবেশ ও জলবায়ুর সুরক্ষার বিষয়ে তাঁদের যে উদাসীনতা ও পরিবেশকে ধ্বংস করার ক্রমাগত যে প্রয়াস তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে ২০১৪ সালের আগস্টেই, বিজেপি সরকার ন্যাশনাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ-এর স্বাধীন সদস্যসংখ্যা ১৫ জন থেকে কমিয়ে মাত্র ৩ জনে নামিয়ে আনে, যার অর্থ উক্ত বোর্ডে সরকার মনোনীত সদস্য সংখ্যাকে বৃদ্ধি করা এবং সরকারের একপেশে সিদ্ধান্তকে প্রয়োগ করা। এই সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ আমরা ২০১৯ সালে দেখলাম ন্যাশনাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ বিনা বাধায় বন্যপ্রাণের সুরক্ষার কথা পরিহার করে ৯৯.৮২ শতাংশ শিল্প উদ্যোগকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। ২০১৭ সালে আরও এক উদ্বেগজনক পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে, গোটা দেশের ৪০০ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে তাঁরা বিনা বাধায় বর্জ্য নির্গমনের ছাড়পত্র দিয়ে দিল। যার ফলস্বরূপ আমরা দেখলাম ২০১৮ সালের মধ্যে সারা বিশ্বের ২০টি সর্বাধিক দূষণযুক্ত শহরের মধ্যে ১৫টি শহরই ভারতবর্ষে অবস্থান করছে। ২০১৬ সালে ঘটা করে ক্ষতিপূরণমূলক বৃক্ষ রোপণের আইন প্রণয়ন হলেও এবং ২০১৯-’২২ সালে সেই খাতে ৫১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ হয়নি, ২০১৯ সালে মোদি সরকার (Modi Govt) ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রকল্পের সূচনা করলেও তার কার্যকারিতার দিকটা অত্যন্ত হতাশাজনক, এই প্রকল্প সারা দেশের ১৩১টি শহরের বায়ুর গুণমান বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুরু হলেও ২০২২ সালে লক্ষ্য করা যায় যে, মাত্র ৬৯টি শহরে এই প্রকল্প চালু আছে এবং এই ৬৯টি শহরের মধ্যে ১৬টি শহরের বায়ুর গুণমান বৃদ্ধির বদলে সেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ রক্ষার মাপকাঠিতে বিজেপি সরকার যে চূড়ান্ত ব্যর্থ তা দু-একটি উদাহরণ সহযোগে বোঝানো যায়, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে ২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাবাইট নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন করবে কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয় বিজেপি সরকার, উৎপাদন হয় মাত্র ১১৯ গিগাওয়াট! এনভায়রনমেন্টাল পারফর্মেন্স ইনডেক্সে ২০১২ সালে যেখানে ভারতের স্থান ছিল ১২৫, মোদি সরকারের আমলে ক্রমাগত অবনতির দিকে ধাবিত হতে হতে ২০১৮ সালে ভারতের স্থান হয় ১৭৭তম এবং ২০২২ সালে এসে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয় সর্বশেষ ১৮০ তম।
বিজেপি সরকার (Modi Govt) তাদের ১০ বছরের শাসনকালে পরিবেশগত বিভিন্ন নিয়ম ও আইনগুলোকে যেভাবে পরিবর্তিত ও সংশোধিত করেছে তা পরিবেশ ও জলবায়ুর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংকটজনক, ২০০৬ সালের এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বিজ্ঞপ্তির বিভিন্ন জায়গাগুলোকে সংশোধিত করে তারা বৃহৎ শিল্প-উদ্যোগ স্থাপনের রাস্তাকে প্রশস্ত করে দিয়েছে পরিবেশকে ধ্বংসের বিনিময়ে। যা সুস্থায়ী উন্নয়নের পরিপন্থী। ফরেস্ট কনসারভেশন আইন, ১৯৮০-কে ২০২৩ সালে সংশোধিত করে ‘অরণ্য’-এর সংজ্ঞাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাল্টে দিয়ে অরণ্যের ক্ষতিসাধনের চাবিকাঠি খুলে দিয়েছে, যার ফলস্বরূপ ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মোট ১.৫ লক্ষ হেক্টর অরণ্য শিল্প ও কল-কারখানার তিমিরে হারিয়ে গেছে। ২০১৯ সালের কোস্টাল রেগুলেশন জোন-এর নতুন বিজ্ঞপ্তিতে ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’-এর পরিসীমা সমুদ্রতট থেকে মাত্র ৫০ মিটার করা হয়েছে, পূর্বে যা ছিল ২০০ মিটার। নিকোবর দ্বীপে ১৩০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্যরোদন করে গ্রেট নিকোবর আইল্যান্ড প্রকল্প চালু করেছে। নতুন শিল্প, কলকারখানা স্থাপনের জন্য ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বন্যপ্রাণ বিভাগ, অরণ্য বিভাগ ও সমুদ্র উপকূল বিভাগের ছাড়পত্রের মাত্রা ৫৭৭ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২৪৯৬।
আরও পড়ুন- ঘুরে আসুন পিন উপত্যকা
এই সমস্ত কার্যক্রমের কারণের পিছনে উত্তরটা একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য থেকে উঠে এসেছে যে, সেই সমস্ত শিল্প উদ্যোগী যাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদকে বিনষ্ট করার ইতিহাস রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে, তাঁরাই বেনামে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা অনুদান দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে এবং সেই রাজনৈতিক দলের মুখ্য ভাগে সবথেকে বেশি অংকের অনুদান গ্রহণ করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও সিপিএম নামক অস্তমিত হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলটিও একদা আমাদের সুজলা, সুফলা বাংলার মাটিকে দূষিত করেছে। সিপিএমের আমলে নব্বইয়ের দশকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বুজিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তৈরি হয়ে যেত সরকারি মদতে, যদি না হাইকোর্ট ওই বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করত। তথ্য এও বলছে যে, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বৃহত্তর কলকাতার জলাভূমির পরিমাণ ১৪ থেকে ৬ শতাংশে এসে ঠেকেছিল, হাওড়ার জয়পুর বিল, হুগলির ডানকুনি ও হিন্দমোটরের বিস্তীর্ণ জলাভূমি এসব অঞ্চল জুড়ে একের পর এক অবৈধ নির্মাণ হয়েছে বাম আমলে। প্রয়াত বাম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী নিজেই বামশাসিত প্রশাসনের এই অন্যায্যতা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল ‘নির্বিকল্প সমাধিতে’।
এই পাল্টে যাওয়া পরিবেশ ও জলবায়ু যা আমাদের সুস্থ থাকার সমস্ত শর্তকে ভেঙে দিচ্ছে, তার থেকে উদ্ধারের উপায় কী হতে পারে? উপায় জানেন মা-মাটি- মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই আশঙ্কার কথা অনুধাবন করেই নেত্রী চালু করেছেন ‘সবুজশ্রী’ প্রকল্প, যেখানে প্রত্যেক নবজাতক শিশুর বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বৃক্ষের চারা, বৃক্ষের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠবে শিশুটি, প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করতে শিখবে, সুস্থায়ী উন্নয়নের ভাবনা এর থেকে ভাল আর কিই-বা হতে পারে! তাই নেত্রীর কথা ধরেই বলতে ইচ্ছা করে, ‘সবুজ বাঁচাও, সবুজ দেখাও/ সবুজের মাঝে বিবেক জাগাও/ সবুজ ধ্বংস করো না/ সৃষ্টিকে উপড়ে দিও না…।’