লোকশিল্পের হাব এখন পশ্চিমবঙ্গ

প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি শিল্পকলা, তাও প্রশিক্ষিত কারও সৃষ্টি নয়। পরম্পরাগত বৈভবে তার দ্যুতি, জন-যোগাযোগে তার সমৃদ্ধি। আর অশিক্ষিত পটুত্বে প্রাণের পরশ দিয়ে তৈরি সেই শিল্পের ভরকেন্দ্র এখন পশ্চিমবঙ্গ। সৌজন্যে মমতাময় প্রশাসনিক সাহায্য। লিখছেন জিয়ান কর্মকার

Must read

যদি বাউলের সুরে ঘুম ভাঙত, কবিগানে নিশি, স্বপ্নময় বাংলা আমার ইতিহাসের সাথী। পূর্ব ভারতের বৈচিত্র্যময় শৈল্পিক কারুকাজের দৃষ্টিনন্দন রূপে ঘেরা পশ্চিমবঙ্গ। পটচিত্রের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প থেকে প্রাণবন্ত ডোকরা অজানা শিল্পকর্মগুলি ইতিউতি যে উঁকি মারত আগে, এখন তা বহির্বিশ্বের কাছে এক অনন্য আশ্চর্য। ভারতীয় লোকশিল্পের শিকড় দেশের সবচেয়ে প্রাচীন উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীরভাবে নিহিত রয়েছে। লোকশিল্পের উদ্ভব সাধারণত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। কারণ কোনও না কোনও উপজাতি তাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিমন্থন বা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে কিছু নিবেদনের জন্যই ব্যবহার করত। শতাব্দীর পর শতাব্দী লোকশিল্প স্থানীয় সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু শিল্প কখনও কোনও গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তার মহিমা, শৈলী রাস্তা খুঁজে নেবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এর জন্য চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের অবদান কিছু কম নয়। তিনি বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় লোকশিল্পের প্রতি মনোযোগ দিয়ে তাকে জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করেছিলেন। দৈনন্দিন জীবনের চিত্রায়ন অনেকসময় শিল্পীর শিল্পসত্তার সঙ্গে অনুরণিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের চিত্রকর্মের ঐতিহ্য তার সাংস্কৃতিক ল্যান্ডস্কেপের মতোই বৈচিত্র্যময়। বিশেষ করে পটচিত্র বা কাঁথা এমব্রয়ডার অথবা মধুবনি পেইন্টিংস কিংবা ডোকরা। টেরাকোটাও কিন্তু আছে তার সঙ্গে বাটিক প্রিন্ট আজও নারী সমাজের সৌন্দর্য ও তার ঐতিহ্য সমানভাবে বহন করে চলেছে। পুরুলিয়ার আদিবাসী সমাজের একাংশের প্রচলিত বিশ্বাস ছিল স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছাতে মর্ত্যেরও ছাড়পত্র লাগে। যা যমপট বা চক্ষুদান পটের মাধ্যমে সম্ভব। অর্থাৎ মর্ত্যের মৃত্যুর পর মৃতদেহের সামনে বসে পটুয়ারা পটে তাঁর চোখ আঁকবে যা রাখা হবে ঘরে, তবেই স্বর্গের প্রবেশের অনুমতি মিলবে। এই চক্ষুদান পর্বকে সামনে রেখেই পটচিত্র নামক লোকশিল্প গড়ে উঠেছিল, যা পশ্চিম মেদিনীপুরের পটচিত্র থেকে কিছুটা আলাদা। কালের নিয়মে পুরুলিয়ার সেই পটচিত্র অবলুপ্তির পথে। পুরুলিয়ার মাজরামুড়ায় পটচিত্রের মেলা হয় একটুকরো পটচিত্রকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য। এই মেলায় শিল্পীরা পাথর, গাছের পাতা, ফুল ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি রঙ দিয়ে ছবি আঁকেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের পটচিত্র গ্রাম এমন এক প্রাচীন লোকশিল্প যা সারাবিশ্বের শিল্পপ্রেমীদের কাছে অঙ্কনশৈলীর জন্য সমাদৃত। পটের শিল্পগুলি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরতে যে ফোক আর্ট সেন্টার নির্মিত হয়েছে তা যেন জীবন্ত মিউজিয়ামের রূপ ধারণ করেছে। ২০২২ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটের গ্রাম নয়ার শিল্পীদের পটচিত্র দেশ বিদেশের অতিথিদের মন কেড়েছিল। পটচিত্রে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, ক্ষুদিরাম বোস, সিদো কানহোকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তা অনন্য শিল্পীরা দেখিয়েছিলেন। হারানো মোমঢালাই পদ্ধতির শিল্পকর্ম হল ডোকরা। হাজারো বছর আগে ডোকরা শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাপ্ত নৃত্যরত নারী মূর্তি দেখে।

আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যন্ত এলাকায় শুরু হচ্ছে ‘দুয়ারে সরকার’, কবে থেকে ক্যাম্প?

পশ্চিমবঙ্গের ডোকরা শিল্পের প্রসার কয়েকশো বছর পূর্বে ঘটে। প্রধানত ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা থেকে আগত শিল্পীদের আবাস এখন পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তের জেলা বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। যা এক একটি এলাকাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। ডোকরা শিল্প উপজাতি কারিগরদের অপরিসীম প্রতিভা প্রদর্শন করে। এই শিল্পকে কাজে লাগিয়ে দেব-দেবীর মূর্তি, তার সাজসজ্জা তৈরিতে অসাধারণ সফলতা লাভ করেছে। বাঁকুড়া জেলার বিকনা গ্রাম এই রাজকীয় শিল্পের আবাস। বর্ধমানের দরিয়াপুর গ্রামটিও এই নিপুণ ডোকরা কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত। মেটাল ঢালাই ডোকরা মুখোশ শিল্পকর্মকে সঙ্গী করে বাঁকুড়ার মহিলা শিল্পী গীতা কর্মকার ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সুদৃশ্য কারুকার্য সমৃদ্ধ গয়না, ঘর সাজানোর সরঞ্জামের ওপর ভিত্তি করে ডোকরা শিল্প আজ গ্রামসরণি থেকে রাজপথে জায়গা করে নিয়েছে। শুধু ডোকরা শিল্প নয়, বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রামটি কিন্তু পোড়ামাটি যা টেরাকোটার শিল্পের জন্য বিখ্যাত। টেরা শব্দের অর্থ ‘মাটি’ আর কোটার অর্থ ‘পোড়ানো’। যার থেকে পোড়ামাটি শব্দটি এসেছে। হস্তশিল্পের প্রতীক হিসেবে টেরাকোটা ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। All India Handicrafts সংস্থার লোগোতেও বাঁকুড়ার ঘোড়ার (টেরাকোটা শিল্প) ছবি ব্যবহৃত হয়। বাঁকুড়া জেলার শঙ্খ বনিক বা শাঁখারি নামে পরিচিত লোকেরা এখনও কিন্তু শঙ্খ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বালুচরি শাড়ির একটি নিজস্ব ইতিহাস আছে। মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলি খান তাঁর পরিবারের বেগমদের জন্য নতুন শাড়ির বরাত দিয়েছিলেন এক তাঁতি সম্প্রদায়কে এবং পরবর্তী সময়ে সেই তাঁতি সম্প্রদায়কে থাকার জন্য গঙ্গার তীরে একটি গ্রাম দিয়েছিলেন। সেই গঙ্গা তীরবর্তী বালু থেকেই বালুচরি শাড়ির উদ্ভব। তবে বর্তমানে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর বালুচরি শাড়ির গড়। বিষ্ণুপুরের লণ্ঠন শিল্প খুব জনপ্রিয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুখোশ শিল্পকর্মের একটি রহস্যময় পরিচিতি রয়েছে। মাটি, কাঠ, স্পঞ্জ কাঠ বা শোলা কাগজ দিয়ে মুখোশ তৈরি করে লোকনৃত্যে ব্যবহৃত হয় আদিকাল থেকে। ২০১৫ সালে প্যারিসে এই শিল্পকর্মের প্রদর্শনের জন্য ইউনেস্কো দ্য রুরাল ক্রাফট হাব অফ বেঙ্গলকে নির্বাচিত করেছিল। ছৌ-নাচ তো ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ছৌ-নাচ বিভিন্ন শৈলীর সঙ্গে মিউজিকের একটি মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে। ২০০২ ও ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে বাংলার ট্যাবলোয় পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ তুলে ধরে সেরার শিরোপা জিতেছিল। এইবার প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির কর্তব্য পথে জায়গা করে নিয়েছে পুরুলিয়ার নাটুয়া নৃত্য। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির অন্যতম অংশ হল নাটুয়া নৃত্য। হরপার্বতীর মিলন নৃত্য দেখবে গোটা দেশ। ১০০ জন লোকশিল্পী বীররসের এই নাচ প্রদর্শন করবেন বলরামপুরের পাড়দ্দা গ্রামের শিল্পী বীরেন কালিন্দীর নাটুয়া নৃত্যদলের নেতৃত্বে।

লোকশিল্পের এই বিকাশের পিছনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তাভাবনা ও পরিশ্রম অনেকাংশে দায়ী তা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। শিল্পী বাঁচলে শিল্প বাঁচবে, এই সহজ সত্যকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ‘লোকপ্রসার’ প্রকল্পের অধীনে ১৮-৬০ বয়স পর্যন্ত লোকশিল্পীদের মাসিক ১০০০ টাকা রিটেনার ফি হিসাবে দেওয়া হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ (ষাটোর্ধ্ব) লোকশিল্পীদের মাসিক ১০০০ টাকা করে পেনশন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নথিভুক্ত লোকশিল্পীদের অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য ১০০০ টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। গোটা রাজ্যের প্রায় ২ লক্ষাধিক এমন লোকশিল্পী আছেন যারা লোকপ্রসার প্রকল্পের আওতায় নিবন্ধিত। পশ্চিমবঙ্গের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বিভাগের পরিচালনায় বিশ্ব বাংলা লোকসংস্কৃতি উৎসবের স্থানে লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণের স্বার্থে বাংলার আদিবাসী হস্তশিল্প প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। সরস মেলা, সবলা মেলা এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন মেলায় হারিয়ে যাওয়া হস্তশিল্পের সম্ভার তুলে ধরা হয় ক্রেতাকুলের কাছে, যা লোকশিল্পের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার প্রমাণ করে। পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক লোকশিল্প আছে যারা বংশ পরম্পরায় আঁকড়ে রয়েছেন শুধু শিল্পটুকুই, আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হয়েও তাঁরা কিন্তু হাল ছাড়েননি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ধরনের লোকশিল্পীদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ারও চেষ্টা করছে। সময়ে সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার লোকশিল্পের সমৃদ্ধকরণের জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করছে। আসলে বাংলার লোকশিল্পের সম্ভার অফুরন্ত। সঙ্গীত, চিত্রকলা, হস্তশিল্পের সংমিশ্রণে তা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি প্রভৃতি সঙ্গীত ঘরানা যুগ যুগ ধরে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে চলেছে। কালের গতিতে বেনোজলের আবাহন হলেও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে সরকারের উদ্যোগে লোকশিল্প এখন অক্ষত।

Latest article