নেতাজির ‘নাগিনী’
গাড়িতে রয়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। গাড়ি চালাচ্ছেন তাঁর ড্রাইভার। উল্টোদিক থেকে গুলি চালালেন শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস। ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার। সেই গুলি গিয়ে লাগল নেতাজির গাড়ির চালকের বুকে। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন নেতাজি নিজে। সেই মুহূর্তে সেখানে ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের নীরা আর্য। জয় রঞ্জনকে তিনি দ্বিতীয় সুযোগ দেননি। চোখের পলকে জয়রঞ্জন-এর পেটে বেয়নেট চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। ঘটনার ক্লাইম্যাক্স ছিল শেষে। এই শ্রীকান্ত জয়রঞ্জনই ছিলেন নীরা আর্যর স্বামী। নেতাজি এবং দেশের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা ছিল তাঁর যে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বনকারী নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেনি। এই ঘটনায় নেতাজি অভিভূত হয়ে নীরার নাম রেখেছিলেন ‘নাগিনী’।
প্রথম মহিলা গুপ্তচর
নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি লক্ষ্মীবাই রেজিমেন্টের মহিলা শাখার সৈনিক ভারতের প্রথম গুপ্তচর নীরা আর্য। ১৯০২ সালে উত্তরপ্রদেশের বাগপতের খেকরায় জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর পড়াশোনা কলকাতাতেই। বাবার ব্যবসাসূত্রে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতায় বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি-সহ একাধিক ভাষা শিখেছিলেন। তাঁর বাবা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন। সেই কারণেই তিনি তাঁর মেয়েকে ইংরেজ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে বিয়ে দেন। এই শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন সিআইডি ইন্সপেক্টর। নীরা দেশকে স্বাধীন করতে যতটা মরিয়া ছিলেন অন্যদিকে তাঁর স্বামী ব্রিটিশদের প্রতি ছিলেন ততটাই অনুগত। ছোটবেলায় তিনি বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশ কয়েকদিন হরিয়ানায় লুকিয়ে ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য নীরার মধ্যে আগুন জ্বলছিল। তাই তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্ট-এ যোগ দেন। নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের প্রথম মহিলা গুপ্তচর হিসাবে নীরা ব্রিটিশ শাসকদের মনে ত্রাস তৈরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন-সন্তোষজয়ীদের সংবর্ধনা ইস্টবেঙ্গলের, উদ্বুদ্ধ করলেন ক্রীড়ামন্ত্রী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে আজাদ হিন্দ ফৌজের আত্মসমর্পণের পর দিল্লির লালকেল্লার বিচারে সমস্ত বন্দি আজাদ হিন্দ সেনাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। শুধু নীরাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। স্বামীর হত্যায় ‘কালাপানির’ সাজা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁর প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়েছিল। জেলে তাঁর উপর চলত অকথ্য অত্যাচার। নেতাজির খবর না পেয়ে তাঁর একটা স্তনও কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নীরার মুখ থেকে একটি শব্দও বের করতে পারেনি ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। দেশ স্বাধীন হলে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন নীরা। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন হায়দরাবাদে ফুল বিক্রি করে। কারও কোনও সাহায্য তিনি নেননি। নিজের সংগ্রামের কথা লিখে গিয়েছেন ‘মেরা জীবন সংগ্রাম হ্যায়’ আত্মজীবনীতে।
বোসেস ট্রিলজি
এ-দেশে প্রথম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই বুঝতে পেরেছিলেন সেনাবাহিনীতে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদেরও প্রয়োজন। তবে তার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও সুযোগ। সেনাবাহিনীতে যোগদান করে অস্ত্র হাতে পেলে মহিলারা দেশের জন্য প্রাণ ও দিতে পারেন। কিন্তু সে-সময় সমাজে মহিলাদের ক্ষমতার মান্যতা ছিল না। তাঁদের দুর্বল ও অবলা বলে দূরে সরিয়ে রাখা হত। নেতাজি প্রথম সমাজের এই মিথ ভাঙলেন। ১৯৪২ সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে সুভাষচন্দ্র প্রথম মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। স্বাগত জানিয়ে বলেন, পুরুষ সেনাদের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে মহিলাদেরও হাতে তুলে নিতে হবে বন্দুক রাইফেল। সিঙ্গাপুরে বসে ১৯৪৩ সালে মহিলাদের নিয়ে তৈরি করলেন রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট। তাকে জুড়ে দিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে। শক্তিশালী করে তুললেন নিজের স্বপ্ন দিয়ে গড়া সেই মহিলা ব্রিগেডকে।
নেতাজির এই রানি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। আমাদের কাছে যিনি লক্ষ্মী সাইগল। দক্ষিণ ভারতের এই লক্ষ্মী পেশায় ছিলেন চিকিৎসক ও আদর্শে বামপন্থী। সুভাষচন্দ্রর স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে নেতাজি তাঁর হাতেই তুলে দেন ঝাঁসির রানি বাহিনীর নেতৃত্ব।
ইউরোপ থেকে ফিরে এসে ১৯৪৩-এর ২ জুলাই সিঙ্গাপুরের মাটিতে পা দেন নেতাজি। সঙ্গে সঙ্গে উদীপ্ত হয়ে ওঠেন নারী বাহিনীর সবাই। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীর ভাষায় ‘এস ইফ চার্জ উইথ ইলেক্ট্রিসিটি’। শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে একটা রেজিমেন্ট তৈরি করার স্বপ্ন এর আগে কেউ দেখাতে পারেনি। মেয়েদের সেনা ট্রেনিং দেওয়ার কথা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না। নেতাজি সেই কল্পনাকে বাস্তবায়িত করে দেখালেন। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী তাই অকপটে বললেন,‘‘আমার নামের (লক্ষ্মী) গুরুত্ব যে কতখানি প্রসারিত তা নেতাজির সান্নিধ্যে না এলে হয়তো কখনও বুঝতেই পারতাম না। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের সঙ্গে আমার নামটা জুড়ে দিয়ে নেতাজি যখন ঝাঁসি রেজিমেন্ট শুরু করলেন তখন উপলব্ধি করেছিলাম ‘লক্ষ্মী’ নামটার গুরুত্ব। এই নামটার সঙ্গেই বোধহয় মন্ত্রের মতো জড়িয়ে আছে লড়াইয়ের ইতিহাস। রানি লক্ষ্মীবাই হাসিমুখে জীবনের পরোয়া না করেই ঝাঁসিকে ইংরেজের কবল থেকে বাঁচাতে আত্মবলিদান দিয়েছেন। একইভাবে নেতাজি ভারতের জন্য আমাদের লড়াই করার আহ্বান করেছিলেন। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা অসম্ভব।’’ ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীকে সঙ্গ দিলেন কমান্ডার জানকী থেরাস এবং লেফটেন্যান্ট অঞ্জলি ভৌমিক।
আরও পড়ুন-এবার বাড়ি লিফ্টিংয়ে তিন শর্ত, পুনর্বাসন দেবে পুরসভা
জানকীর সুইসাইড স্কোয়াড
সেদিন ছিল ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ সাল। বাংলা নববর্ষের সূচনায় আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল সৌকাত আলি মালিকের নেতৃত্বে মণিপুরের মৈরাং ও ইংখলে প্রথম স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা পতাকা তোলা হয়। ব্রিটিশরা অবনত হয়। কমান্ডার জানকী থেরস ঝাঁসি বাহিনীর ২৫০ জন নারীকে নিয়ে তৈরি করলেন বিশেষ সুইসাইড স্কোয়াড। নেতাজি সেদিন ঘোষণা করলেন,‘‘ঝাঁসি রানি বাহিনীর আমার সশস্ত্র বীরাঙ্গনা ভগিনীগণ… আজাদ হিন্দ ফৌজের দিল্লি চলো স্লোগানের সঙ্গে আর একটি স্লোগান যুক্ত হোক— রক্ত, আরও রক্ত; ব্লাড, মোর ব্লাড। এর অর্থ ৪০ কোটি ভারতবাসীর মুক্তির জন্য আমাদের আরও নিঃশর্ত দান।’’
তিন ভুবনের পারে
লেফট্যানেন্ট আশা সহায় ও অঞ্জলি ভৌমিক যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। প্রায় ৫০০ নারী সৈন্য নিয়ে বিশাল মহিলা ব্রিগেড পরিচালনা করেছেন।
ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন।
সুভাষচন্দ্র বসুর নারী বাহিনী নির্মাণের সূচনা কিন্তু রানি লক্ষ্মীবাই ব্রিগেড নয়। এই লক্ষ্যে ১৯২৪ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ৩০০ মহিলাকে নিয়ে সুগঠিত ও সুসজ্জিত বাহিনী তৈরি করা হয়। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। এদের কুচকাওয়াজের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল অধিবেশন। এর পুরোভাগে দায়িত্বে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের ভাইয়ের কন্যা লতিকা ঘোষ। কোনওরকম সামরিক ট্রেনিং ছাড়াই সুভাষচন্দ্র তাঁকে কমান্ডিং অফিসার-এর দায়িত্ব দেন। যদিও এই ভলান্টিয়ার্স-এর মেয়েদের পরনে ছিল শাড়ি। হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না। তবু এই প্রতীকী কুচকাওয়াজের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বার্তা দিতে চেয়েছেন— রণাঙ্গনে নারী আর উপেক্ষিত নয়। পরে তিনি লতিকাকে অনুপ্রাণিত করেন রাষ্ট্রীয় মহিলা সঙ্গ সংগঠনের কাজে।
লক্ষ্মী ব্রতকথা..
সুভাষ-এর আরও একজন সেনানী ছিলেন লক্ষ্মী। আইএনএ-র সিঙ্গাপুর শাখার সভাপতি শ্রী আট্টাভার ইয়েলাপ্পার অনুরোধে লক্ষ্মী, যিনি আগে থেকেই ইন্ডিয়ান লিবারেশনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং বিমানবন্দরে সুভাষকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন, এরপরই ১২ জুলাই আইএনএ-র সভায় সুভাষকে মহিলাদের দ্বারা গার্ড অফ অনার দেওয়ার উদ্যোগে শামিল হন। শুরু হয় কুড়িজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবীর খোঁজ, যাঁরা সামরিক কায়দায় সুভাষের হাতে তুলে দেবেন অস্ত্র। কাজটা সহজ ছিল না, কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টার পর সিঙ্গাপুরে কুড়িজন মহিলাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। গবেষকদের মতে, এই কুড়িজনই ছিলেন পরবর্তীকালে গঠিত সুভাষের রানি লক্ষ্মীবাই ব্রিগেডের প্রাণ। এই কুড়িজন সামরিক ধাঁচের প্রশিক্ষণ নেন এবং ড্রিল শেখেন। ওজনে যথেষ্ট ভারী আইএনএ ব্যবহৃত এনফিল্ড রাইফেল সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁরা সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল। এভাবেই লক্ষ্মীর উপর ভরসা জন্মায় সুভাষচন্দ্রের। তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় রেজিমেন্টের। আজাদ হিন্দ বাহিনীর মেজর জেনারেল কিয়ানি জানিয়েছেন, নারী বাহিনী গঠনের আগে সুভাষ তাঁদের কারও সঙ্গেই পরামর্শ করেননি। কিয়ানি নিজের স্ত্রীকে এই বাহিনীর সৈনিক হিসেবে কুচকাওয়াজ করতে দেখে আশ্চর্য এবং বিরক্ত হন, কিন্তু তিনি রানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেননি কারণ তাঁকে জানানো হয়েছিল, এই বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না, এঁদের ভূমিকা শুধুই প্রতীকী। ভেরা হিল্ডারব্যান্ড তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, নারীর অবস্থান বার্মা বা মালয়ে খুব উঁচু ছিল না। এমনকী ভারতীয় অংশের মধ্যেও মহিলা সৈনিকের ধারণা খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই বোধহয় ১৯৪৭ সালের পর লেখা বইতে জেনারেল চ্যাটার্জি ভারতীয় মেয়েদের সীতা ও সাবিত্রীর সঙ্গে তুলনা করে রানি বাহিনী গঠনের পরিকল্পনার সপক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের আরেক সদস্য মেহেরবান সিংয়ের বিশ্বাস করেন এই বাহিনী কখনওই যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে বলে মনে করা হয়নি। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে ইউনিফর্ম পরে, অস্ত্র হাতে ভারতীয় মেয়েদের কুচকাওয়াজের মধ্যে দিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোই এই বাহিনীর সার্থকতা বলে মনে করা হয়েছিল।
নেতাজি শিখিয়েছেন নজরুলগীতি
লক্ষ্মীদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র। একদিন লক্ষ্মী গুনগুন করে গাইছিলেন দুর্গম গিরি, কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে। কৃষ্ণা বসু জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি নজরুলের বাংলা গান কোথায় শিখলে? বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে লক্ষ্মী হেসে বললেন, কেন, নেতাজি শিখিয়েছিলেন। আমাদের রানি বাহিনীর কয়েকজন মেয়েকে এক লাইন করে গান গেয়ে নিজে শিখিয়েছিলেন।
নেতাজি যখন এসে সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন, তখন লক্ষ্মী সেখানে তরুণী চিকিৎসক। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগের সভাপতি ইয়েলাপ্পা বলে পাঠালেন, নেতাজি ডেকে পাঠিয়েছেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী গঠনের ভার দিতে চান। ৯ জুলাই এক বিশাল সমাবেশে ‘টোটাল মোবিলাইজেশন’-এর ডাক দিয়েছেন নেতাজি। মুক্তি সংগ্রামে সার্বিক যোগদান, মেয়েদের বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। তিনদিন পরে গঠিত হল নারী বাহিনী।
নেতাজি দেখতে আসবেন খবর পেয়ে জনা কুড়ি মেয়েকে তিনদিন ধরে গার্ড অব অনার দেওয়ার তালিম দিলেন লক্ষ্মী। শাড়ির আঁচল কোমরে জড়ানো, হাতে মস্ত ভারী রাইফেল, গার্ড অব অনার দিলেন।
আরও পড়ুন-ধর্ষকের মুক্তি নেই: গুড়াপে সাজা ঘোষণায় পুলিশ-বিচার বিভাগকে ধন্যবাদ মুখ্যমন্ত্রীর
মেয়েদের হতে হবে বীরাঙ্গনা
পরে নারী বাহিনীর মেয়েদের ইউনিফর্ম হল জোধপুর ব্রিচেস, বুশ শার্ট, কালো বকলস দেওয়া জুতো। মিলিটারি ট্রেনিং শুরু হল। জাপানি সংস্কৃতিতে মেয়েরা গৃহিণী অথবা মনোরঞ্জনকারিণী। প্রথম দিকে ট্রেনিংয়ের গুলিবারুদ দিতে তাঁদের বিশেষ আপত্তি। পরে অবশ্য মেয়েদের সাহস ও আন্তরিকতায় জাপানি অফিসারেরা মুগ্ধ হন।
ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়ার পথে সাবমেরিনে বসে মেয়েদের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর বাপারে তাঁর বক্তব্য নেতাজি ডিকটেশন দিলেন আবিদ হাসানকে। সাবমেরিন জলের উপর সামান্য ভেসে উঠেছিল। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের চোখ পড়ে যাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি। বিপদসংকেতের মধ্যে দুলতে দুলতে সাবমেরিন জলের তলায় ডুবছে। আবিদের কানে এল নেতাজির শান্ত কণ্ঠস্বর— আবিদ, আমি একটা লাইন দু’বার বললাম, তুমি লেখোনি। কাঁপা হাতে লিখতে শুরু করলেন তিনি।
কী সেই বক্তব্য যা তিনি সিঙ্গাপুরে নেমেই মেয়েদের কাছে তুলে ধরলেন? আবিদ হাসান নোট নিয়েছিলেন— মেয়েদের হতে হবে বীরাঙ্গনা। মৃত্যু ও অসম্মানের মধ্যে ভারতীয় নারী বেছে নিয়েছে মৃত্যু। কিন্তু এখন চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে। যেমন হয়েছিলেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁরই পুণ্য নামে হবে রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট। সিপাহি বিদ্রোহকে নেতাজি বলতেন, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। দেশের শেষ স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েদের সামরিক বাহিনীর অধিনেত্রী হলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সাইগল)।
নেতাজির মতো ‘ফেমিনিস্ট’
লক্ষ্মী বলতেন, তোমরা যে কী সব নারীস্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে বড়াই করো, নেতাজির মতো ‘ফেমিনিস্ট’ আমি আর দেখিনি। কথাটা সত্যি। তিনি লিখেছিলেন, রন্ধন আর সন্তান উৎপাদন নারীর একমাত্র জীবন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর চেয়েছিলেন বাসন্তী দেবী বাংলার হাল ধরবেন। তিনি রাজি না-হওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আপনি কর্তব্যে অবহেলা করেছেন।
ইম্ফল রণাঙ্গনে যেতে চায় মেয়েরা। তাদের সিঙ্গাপুর থেকে এগিয়ে আনা হল রেঙ্গুনে। বাছাই করা এক দলকে পাঠানো হল অগ্রবর্তী ঘাঁটি মেমিওতে। নেতৃত্বে আছেন লক্ষ্মী। মেমিও হেডকোয়ার্টার্স পরিদর্শনে এলেন নেতাজি। সে রাতেই চাঁদের আলোয় প্রবল বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল তাদের ব্যারাক। মেমিওর কাছে কালাউতে ইংরেজদের হাতে বন্দি হলেন লক্ষ্মী। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে মেয়েদের দাপট দেখে ইংরেজরা স্তম্ভিত। বুঝিয়ে দিলেন— আরও একবার নেতাজির কথা— মেয়েদের হতে হবে বীরাঙ্গনা। মৃত্যু ও অসম্মানের মধ্যে ভারতীয় নারী বেছে নিয়েছে মৃত্যু। কিন্তু এখন চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে।