অন্ধকার পেরিয়ে আলোকের যাত্রা এখন এই রাজ্যে

২০১১ থেকে ২০২৪। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে তমসাচ্ছন্ন প্রহর থেকে আলোকময়তার চলন। কেন এই অভিমত শিক্ষক সমাজের? ব্যাখ্যা করছেন দিলীপ সিংহ রায়

Must read

বর্তমানে উন্নয়নের অগ্নিকন্যা বিশ্ববরেণ্যা পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে এই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা এক ব্যতিক্রমী সরকার ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যা আজ সারা পৃথিবীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।

আরও পড়ুন-অন্ধকার পেরিয়ে আলোকের যাত্রা এখন এই রাজ্যে

বিগত ৩৪ বছর ছিল অন্ধকারের কাল। অজস্র নজির শিল্পাঞ্চল শ্মশান, কলকারখানা বন্ধ, কর্মহীন যুবকের বুকে বেকারত্বের দীর্ঘশ্বাস— পরিযায়ী শ্রমিকের কাজের জন্য ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া, সর্বহারার রাজত্বের বদলে পুঁজিবাদের নির্লজ্জ দালালি আর সবার উপরে ৩৪ বছর তক্ততাউসে কায়েমি থাকার জন্য প্রতি নির্বাচনে যথেচ্ছ রিগিং, পুলিশ দলভৃত্য, গণতান্ত্রিক বিরোধীকণ্ঠকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেওয়া, বানতলা থেকে ধানতলা, ১৯৯০-এর গণধর্ষণ, ছোট আঙারিয়া থেকে নানুর, ভূমিহীন মজুরকে নির্মম হত্যা, মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের রক্তপাত, সাঁইবাড়িতে দুই ছেলেকে খুন করে ছেলের রক্তে মাকে ভাত মেখে খাওয়ানো, কলকাতার বিজন সেতুর উপর প্রকাশ্য দিবালোকে ১৭ জন আনন্দমার্গীকে খুন! ১৯৯৩-এ সেদিনের অগ্নিকন্যা মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে মিছিলে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীকে গুলি করে হত্যা, তাঁকে খুনের চক্রান্তের অঙ্গ হিসেবে তাঁর মাথায় পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা অকথ্য হিংস্রতা সংবলিত সংগঠিত ঘটনার যোগফলের নাম সিপিএমের ৩৪ বছরের জমানা। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আপ্রাণ, নির্ভীক সংগ্রামের ক্রমিক ফল আস্তে আস্তে আলোর পথে ফেরা, ধ্বংসের স্তূপীকৃত ছাই সরিয়ে রাজনৈতিক আলোক-সত্তার উদ্ভাস এবং পরিবর্তিত সময়ে উন্নয়নের নিশান উড্ডীন হওয়া। ঘটে গেল এক নিঃশব্দ বিপ্লব! সিপিএম জমানায় পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল ‘অনিলায়ন’। অনিল বিশ্বাসের ফরমান অনুযায়ী স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল তুলে দেওয়া হয়। ইংরেজি ভাষা তুলে দিয়ে মাতৃভাষা চর্চার নামে শিক্ষায় আধুনিকতার পথ রুদ্ধ করা হয়। অথচ বাম নেতাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো চলতেই থাকে। ফলত সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার গভীর চক্রান্ত চলে, পরিণতিতে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সদর থেকে মফসসল ও সুদূর গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে যায়। অনিলায়নের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অঙ্গুলিহেলনেই চলছিল। কম্পিউটারের বিরোধিতা করতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষা তথা সারা বিশ্বের চলমান গতি ও দ্রুতি থেকে এই রাজ্যকে আলোকবর্ষ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নয়ের দশকে হঠাৎ একরাতে শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে ৬০ বছরে নামিয়ে এনে বাংলার প্রায় ৬৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর চাকরি খেয়েছিল তৎকালীন সিপিএম সরকার, আর চুপচাপ মজা দেখছিল এবিটিএ। সেদিনের সেই নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা ভুলি কি করে! সেদিন কলকাতার রাজপথে চাকরি হারানো শিক্ষকদের কান্নার মিছিলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চার্জ করে, বৃদ্ধ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তিন দিন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে রাখা ভুলি কি করে!

আরও পড়ুন-মনু, গুকেশের হাতে খেলরত্ন, বিশেষ সম্মান বাংলার সাঁতারু সায়নীকে

তৎকালীন সিপিএম সরকার রোপা-৯৮ ঘোষণার পর আড়াই বছর মহার্ঘভাতা (ডিএ) দেওয়া বন্ধ রেখেছিল, আর তখনকার এবিটিএ নেতারা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিল। শুধু তাই নয়, তৎকালীন সিপিএম সরকার সরকারি অর্ডার বের করে ‘‘বকেয়া এরিয়ারের টাকা পিএফ-এ জমা করতে হবে এবং এই বকেয়া অর্থ অবসরের আগে তোলা যাবে না” বলে নির্দেশ দেয়, কিন্তু এই বকেয়া টাকার ধার্যকৃত ইনকাম ট্যাক্সের টাকা নগদে পরিশোধ করতে ফরমান জারি করে।
এই কালা আইন বাতিলের দাবিতে আমরা রাজ্যব্যাপী তীব্র এক ঐতিহাসিক আন্দোলন সংগঠিত করি এবং আমি, দিলীপ সিংহ রায়, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে সরকারকে সেই অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য করি এবং পরবর্তীতে ধার্যকৃত ইনকাম ট্যাক্সের সমপরিমাণ টাকা এরিয়ারের থেকে কেটে নিয়ে পিএফ-এ জমা করতে বাধ্য করি। এই রাজনৈতিক জয় আজও আমার মধ্যে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের উন্নয়ন ও গতির দৃষ্টান্ত—
মাস পয়লা বেতন : বাম আমলে শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীদের বর্তমান মাসের বেতন পরের মাসেও পাবার কোনও গ্যারান্টি ছিল না। বেতনের জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হত। অথচ গত এক যুগ ধরে মাসের ১ তারিখে বা তার আগেই তাঁদের বেতন নিশ্চিত করা হয়েছে।
পেনশন : শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের অবসরোত্তর পেনশন পেতে বাম আমলে যেখানে দেড়-দু’বছর লাগত, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস শাসনের এই সময়ে ই-পোর্টাল-এর মাধ্যমে অবসরের দু’এক মাস আগেই শিক্ষকেরা পিপিও পেয়ে যাচ্ছেন। শোনা যায়, পূর্বে ঘুষ দিয়ে পেনশন পাবার অলিখিত রেওয়াজ ছিল। এবিটিএ-এর সৌজন্যে ঘুষ প্রদানের ক্ষেত্রে অবসাদ এবং দুশ্চিন্তায় শিক্ষকদের কপালে ভাঁজ পড়ত। স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল সরকারের আমলে অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই পেনশন হাতে পেয়ে এখন শিক্ষককুল সম্পূর্ণ স্বস্তিতে অবসরের দিন কাটাতে পারেন।
চাইল্ড কেয়ার লিভ : মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত মানবিক ভাবনার ফলে ও তাঁর সংবেদনশীলতার কারণে শিক্ষিকাদের ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’-এক অভূতপূর্ব প্রাপ্তি। প্রশ্ন করা যেতে পারে, ইতিপূর্বে কোনও সরকারের আমলে শিক্ষিকাদের জন্য কেউ দরদি হৃদয়ে এরকম ভেবেছিলেন কি? বাম আমলে তো নৈব নৈব চ…!
ট্রান্সফার : শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরিতে বদলি অথবা মিউচুয়াল ট্রান্সফার, ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ পছন্দমতো স্কুলে বদলি হওয়ার সুবিধা বর্তমানে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সদর্থক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সুবিধাদানের অনুকূল ভাবনার নজির।

আরও পড়ুন-গওহর জান, এক নক্ষত্রের নাম

কলেজে ভর্তি : পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তীর্ণোত্তর কলেজ বা পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য প্রচণ্ড হয়রান হত। এখানেও অলিখিত ঘুষ চালু ছিল বলে শোনা যায়। ফলে বাম নেতাদের পকেট ভারী হত। ২০১২ সাল থেকে অনলাইনে ফর্ম ফিল-আপ চালু হয়। পরে সরকারের অধিকতর আধুনিক ভাবনার আলোকে ও সদিচ্ছায় সেন্ট্রাল অ্যাডমিশন পোর্টাল-এর মাধ্যমে ভর্তির জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা একইসঙ্গে ২৫টি কলেজের ফর্ম পূরণ করে তাদের সুবিধা ও পছন্দ মতো যে কোনও একটিতে ভর্তি হতে পারে। সরকারের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকেরা আজ সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত।
মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান-ভাবনা : মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সেখানে বিজ্ঞান-ভাবনা সংক্রান্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণভাবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়তা প্রকল্প : সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য হাজারো সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে এই সরকার। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’ আজ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। সাইকেল প্রদান, ট্যাব গ্রান্ট প্রদান, শিক্ষাশ্রী-সহ শিশুদের ব্যাগ, বই, খাতা, পোশাক, জুতো, মিড-ডে-মিল ইত্যাদি প্রদান শিশুদের স্কুলমুখী করে তুলেছে।
কত-কত ঘটনা-রটনা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র টলেনি। রাজ্যের বিগত বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের রায় আসল সত্যটা প্রমাণ করেছে। কত-কত ঘটনা-রটনা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র টলেনি। রাজ্যের বিগত বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের রায় আসল সত্যটা প্রমাণ করেছে।

Latest article