আরজি কর কাণ্ডের চিকিৎসক-কন্যার নির্মম হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা হল শনিবার। সেদিকেই নজর ছিল গোটা দেশের।
তরুণী চিকিৎসকের নারকীয় হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল প্রতিটি মানুষের হৃদয়। জাস্টিসের দাবিতে উত্তাল হয়েছিল কলকাতা। ‘প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগ ছিল নির্যাতিতার পরিবারের ও আন্দোলনকারীদের। তাই অপরাধীর সংখ্যা এক নাকি একাধিক, তা নিয়ে বির্তক উঠেছিল চরমে।
কিন্তু তাঁদেরই পছন্দের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই জানিয়ে দিয়েছে, অপরাধী একজনই। সঞ্জয় রায়। তাতে স্পষ্ট, অভয়ার প্রতি মানুষের সীমাহীন আবেগকে বিপথগামী করার একটা পরিকল্পিত চক্রান্ত হয়েছিল বাংলায়। ‘সূত্রে’র দোহাই দিয়ে গল্পের গোরুকে চড়ানো হয়েছিল গাছে। কিন্তু, আদালত সাক্ষ্য আর প্রমাণ, এ দুয়ের ভিত্তিতে করে দিল সত্যি-মিথ্যের ফয়সালা।
আরও পড়ুন-অগ্নিদগ্ধ কাজী নজরুল ইসলামের নাতি, অবস্থা আশঙ্কাজনক
নির্যাতিতার বাবা-মায়ের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে তাঁদের দিশেহারা অবস্থা। ঘটনার পর ‘সিবিআই সূত্রে’র বলে যে সমস্ত খবর সামনে আনা হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ রাজ্যবাসীর মতো তাঁরাও তাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু আদালত তো ‘সূত্রের খবরে’র ভিত্তিতে মিডিয়া ট্রায়ালকে উড়িয়ে দিল।
আরজি কর কাণ্ডের তদন্ত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে। প্রতিটি পর্বে তদন্তের ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ মহামান্য আদালতে পেশ করেছে সিবিআই। নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী দু’বার বদল হয়েছে। তার মধ্যে একটি আইনি সংস্থা জানিয়েছিল, ‘তারা আদালতে লড়াই করে আইনের বলে, প্রমাণের উপর নির্ভর করে এবং পেশাগত নীতি মেনে।’ তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পিছনে যে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্রে’র কথা বলা হচ্ছে, তার কি আদৌ কোনও প্রমাণ আছে! আন্দোলনকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয় বুঝেই আইনি সংস্থাটি এমন হাইভোল্টেজ মামলা থেকে সংস্থাটি নিজেদের সরিয়ে নেয়।
মিডিয়া ট্রায়ালে’র জেরে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ কলকাতার বুকে গণ-আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল। প্রচার করা হয়েছিল, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতির অনেক কিছুই নাকি নির্যাতিতা চিকিৎসক জেনে গিয়েছিলেন। তিনি সব ফাঁস করে দিতে পারেন, এই আশঙ্কাতেই নাকি তাঁকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! এর জন্য তাঁর নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র’ বলে অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন। তাতেই আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াতে সমর্থ হন বিভ্রান্তকারীরা। চিকিৎসকেরাও টানা ৪২ দিন কর্মবিরতি চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাতে চিকিৎসা না পেয়ে অকালমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তাও মানুষ সব সহ্য করেছে।
আরও পড়ুন-২২ জানুয়ারি থেকে জয়েন্টের রেজিস্ট্রেশন
আর এবার? মেদিনীপুর মেডিক্যালে প্রসূতি-মৃত্যুর ঘটনার সিআইডি তদন্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরও তদন্ত করেছে। তার উপর ভিত্তি করেই ১২ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়েছে। তার মধ্যে ছ’জন সিনিয়র ডাক্তারবাবুও আছেন। এবার রাজ্যে সরকার জনস্বার্থে কঠোর পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করবে না, টের পেয়ে আন্দোলনকারীরা চুপ হয়ে গেছেন। বিভ্রান্ত সৃষ্টির আয়োজনে যতি টেনেছেন।
এরপরেও যিনি বা যাঁরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁদেরকে সবিনয়ে জানাই, সিবিআই চার্জশিটে দোষী সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ১১টি অকাট্য প্রমাণ দাখিল করেছিল।
১. সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই জানা গিয়েছে, গত ৯ অগাস্ট ভোরে (ঘটনার দিন) আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলায় গিয়েছিলেন সঞ্জয়। সেটাই ছিল মূল ঘটনাস্থল।
২. সঞ্জয় যে ওই রাতে আরজি কর হাসপাতালেই ছিলেন, তার মোবাইল ফোনের লোকেশন থেকেই তার প্রমাণ মিলেছে।
৩. ময়নাতদন্তের সময় মৃতার দেহ থেকে সঞ্জয়ের ডিএনএ মিলেছে।
৪. সঞ্জয়ের যে প্যান্ট এবং জুতো পুলিশ উদ্ধার করেছিল, তা থেকে মৃতার রক্তের দাগ মিলেছে।
৫. ঘটনাস্থল থেকে যে ছোট ছোট চুল পাওয়া গিয়েছিল, তা সঞ্জয়ের চুলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
৬. ঘটনাস্থল থেকে যে ব্লুটুথ ইয়ারফোন উদ্ধার হয়েছিল, তা সঞ্জয়ের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া ফোনের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ করা জরুরি, ঘটনার রাতে সঞ্জয়কে যখন ঘটনাস্থলের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল, তখন তাঁর গলায় ব্লুটুথ ইয়ারফোন জড়ানো ছিল। কিন্তু তিনি যখন ফিরছিলেন ঘটনাস্থল থেকে, তখন সেই ব্লুটুথ ইয়ারফোন তাঁর গলায় ছিল না। সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই তা জানা গিয়েছে বলে দাবি করেছিল সিবিআই।
আরও পড়ুন-খুনের ষড়যন্ত্র ফাঁস! অল্পের জন্য রক্ষা, অডিও বার্তায় জানালেন দেশ-ঘরছাড়া হাসিনা
৭. সঞ্জয়ের শরীর থেকে যে ক্ষতচিহ্ন মিলেছিল, দেখা গিয়েছে, সঞ্জয়ের মেডিক্যাল পরীক্ষার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগে সেই ক্ষত তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, হিসাব মতো ৮ অগাস্ট থেকে ৯ অগাস্টের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল সেই ক্ষত। ঘটনাচক্রে, মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাও ওই সময়েই ঘটেছিল।
৮. সঞ্জয়ের শরীরে যে ক্ষতচিহ্ন মিলেছে, সেগুলি নির্যাতিতার প্রতিরোধের ফলেই তৈরি হয়েছিল।
৯. সঞ্জয়ের মেডিক্যাল পরীক্ষা থেকে এ রকম কোনও প্রমাণ মেলেনি যে, তিনি সঙ্গমে অক্ষম।
১০. সিএফএসএল কলকাতার রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মৃতার অন্তর্বাসের সেলাই যে ভাবে ছিঁড়ে গিয়েছে, তা থেকে বোঝা গিয়েছে যে, সেটি জোরজবরদস্তি খোলা হয়েছে।
১১. সিএফএসএল কলকাতার রিপোর্ট অনুযায়ী, মৃতা যে কুর্তি পরেছিলেন, কোমরের কাছে সেই কুর্তির দু’পাশটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তা টানাহেঁচড়ার কারণেই হয়েছে।
সুতরাং, অযথা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে, অপপ্রচার চালিয়ে লাভ নেই। বরং আসুন, সবাই একযোগে আওয়াজ তুলি, দোষী সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই।