নয়ের দশকের কবি তাজিমুর রহমান। তাঁর কবিতায় যাপিত জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈশ্বিক পর্যটনের আভাস রয়েছে। ঘটান ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রকাশ। বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। হাতে এসেছে কবির ‘মৃদুস্বরে যেটুকু বলা যায়’ কাব্যগ্রন্থটি। ৬৪ পৃষ্ঠার সংকলনটি দেয় প্রাণের আরাম। নানা বিষয়ের কবিতাগুলো মৃদু হাওয়ার মতো। শান্ত। ছড়িয়ে দেয় অপার শান্তি। ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে কবির চেনা স্বর। মনকে নিয়ে যায় অলীক জগতে।
‘অমরত্ব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘ইচ্ছেগুলো কেমন তাক করে আছে সমুদ্র!/ সময় দূত হলে বারান্দার আকাশ ক্রমে/ ছোট হয়ে আসে/ দিগন্তের বলাকা উড়ে যায় উদ্দেশ্যহীন।’ নাম ‘অমরত্ব’, তবে এ এক নিটোল মৃত্যুর কবিতা। ‘সময় দূত’ প্রয়োগটি গভীর অর্থবহ। দিগন্তের বলাকার উদ্দেশ্যহীন উড়ে যাওয়া যে মৃত্যুর উপমা, বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
‘ঈশ্বর’ কবিতায় কবির অভিমানী উচ্চারণ ফুটে ওঠে, ‘তুমি কি আমার বাড়ি আসবে কখনো/ এ প্রশ্ন রেখেছি জন্মাবধি/ হে বৃক্ষ, অরণ্যকেও বলেছি অনিবার/ তবু দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছো নিখাদ সংকোচে, অবিশ্বাসে।’ কবির অভিমান জনমানুষের অভিমান হয়ে আছড়ে পড়ে ঈশ্বরের তটে। ‘বাউল’, ‘নিয়তি’, ‘ঘাতক’, ‘হাত বাড়ালে’ কবিতাগুলো মর্মস্পর্শী, সার্থক। বই টার্মিনাস প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদশিল্পী শ্রেয়সী নাথ ও সুলগ্না সরকার। দাম ১৭৫ টাকা।
বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে পরিচিত নাম আবু রাইহান। কবিতার পাশাপাশি নিয়মিত গদ্য লেখেন। তিতীর্ষু থেকে বেরিয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসা লিখি রাত্রির খামে’। ৪৮ পৃষ্ঠার উজ্জ্বল সংকলন। রয়েছে বেশকিছু মনে রাখার মতো কবিতা। এই কবি এক আশ্চর্য জাদুকর। আড়ালে না রেখে ঘটান নিজের প্রকাশ। পাঠকদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখেন। নীরব কবিতাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চিরন্তন প্রেম। এই প্রেম তীব্র নয়, নিচু সুরে বাঁধা। কবির প্রেমিক মন হরণ জানে না। সমর্পণ জানে। স্মৃতিচিহ্ন আঁকড়ে বাঁচে।
প্রথম কবিতা ‘ভালোবাসা লিখি রাত্রির খামে’। দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম দুই পঙক্তি : ‘আজন্ম আমি এক স্বপ্নবিলাসী অসুখী বিষণ্ণ বালক/ আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে তোমার উদ্ধত দুটি পালক।’ পালকের ঔদ্ধত্যর মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে গভীর ভালবাসা। এর পরেই কবি লিখেছেন, ‘এখন যখন গোধূলির শেষে প্রতিদিন অন্ধকার নামে/ আমি ভালোবাসা লিখি তোমার নামে, রাত্রির খামে।’ এই অংশে এসে বিষণ্ণতা ছুঁয়ে যায়। জন্ম নেয় মনকেমনিয়া সুর।
আরও পড়ুন-অগ্নিদগ্ধ কাজী নজরুল ইসলামের নাতি, অবস্থা আশঙ্কাজনক
‘বসন্তে দগ্ধ রাত্রিদিন’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে/ সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, আর নিবিড় রক্তক্ষরণ/ এই সত্য আমার উপলব্ধিতে ছিল না বলে/ এতদিন ভুল করে নিয়েছি অহেতুক তর্কের স্মরণ।’ অস্বীকার করার উপায় নেই, রক্তক্ষরণের সঙ্গে ভালবাসার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একইরকম নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সহিষ্ণু প্রতীক্ষা এবং ভালবাসার মধ্যে। চরম অনুভূতিপ্রবণ কবিমন ঠিক বুঝে নেয়। যথাযথ প্রকাশ ঘটায়। ‘বিশ্বাসী মুখ’, ‘মায়াডোর’, ‘রাত্রির গান’, ‘ধূসর ব্যাকুলতা’ প্রভৃতি কবিতাগুলো যেমন সত্য, তেমন সুন্দর। দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদ কবিতার মতোই। দাম ১০০ টাকা।
আরও পড়ুন-২২ জানুয়ারি থেকে জয়েন্টের রেজিস্ট্রেশন
সুনেন্দু পাত্র তুলনায় নবীন কবি। কবিতা-অন্তপ্রাণ। প্রতি মুহূর্তে স্নাত হন অক্ষরের ধারাজলে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘তিনি চৈতন্য’। প্রকাশিত হয়েছে আলোপৃথিবী থেকে। ক্রমশ বদলে যাচ্ছে তাঁর কবিতার ভাষা। নিয়মিত পাঠের ফলে তা সহজেই বোঝা যায়। ৪৮ পৃষ্ঠার সংকলন। কবিতাগুলোর কোনও শিরোনাম নেই। বোঝানো হয়েছে সংখ্যা দিয়ে। ৮ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘কলাপাতায় ভেসে যাচ্ছেন লক্ষ্মীপ্রিয়া।/ বিরহ, সর্পদংশন এইটুকুই যা তার সঙ্গী।’ নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে যে সময়, সেই সময়ে বসে তিনি নারীর প্রকৃত অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে আজকের নারীর কোনও তারতম্য নেই। মাঝের অংশে ফুটে উঠেছে করুণ ছবি, ‘চারিদিকে আজ অবাক চলচিত্র, প্রণয় সম্ভার। সবকিছু ফেলে/ ভেসে যাচ্ছেন তিনি।’ এই ভেসে যাওয়া যেন যে-কোনও নারীর ভেসে যাওয়া।
পৌরাণিক চরিত্রের পাশাপাশি ঐতিহাসিক চরিত্র ভিড় করেছেন কবিতায়। নীরবে উচ্চারিত পঙক্তিগুলো ভাবায়। মৃত্যু যে অনিবার্য, স্পষ্ট বোঝা যায়। ১২ সংখ্যক কবিতাটি চমকে দেয়। কবি লিখেছেন, ‘পুরী ছেড়ে ফিরে যাবেন প্রভু।/ হাতে নীলাচলের কমণ্ডলু। ঝোড়ো হাওয়া।/ তিনি আর ফিরবেন না/ ছড়াবেন না আগুনের ওপর প্রেমের অঙ্কুরিত প্রশ্বাস।’ থমকে যেতে হয় ‘ঝোড়ো হাওয়া’ অংশে এসে। যেন তুলকালাম। ‘প্রেমের অঙ্কুরিত প্রশ্বাস’-এর পাশে কী অপূর্ব বৈপরীত্য। এমন কবিতার কাছে বারবার নতজানু হতে হয়। বাকি কবিতাগুলিও গভীর। অর্থবহ। শ্যামল জানার প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি রাখে। দাম ১৬৫ টাকা।