কমিক্স এবং কার্টুনের রাজা

নারায়ণ দেবনাথ এবং চণ্ডী লাহিড়ী। প্রথমজন ছিলেন মূলত অলঙ্করণ শিল্পী। জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কমিক্স এঁকে। দ্বিতীয়জন কার্টুনিস্ট। বাংলা কার্টুনকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। গতকাল, ১৮ জানুয়ারি ছিল দুই শিল্পীর প্রয়াণদিবস। স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

কমিক্সের রাজা নারায়ণ দেবনাথ
একটি বা দুটি প্রজন্ম নয়, বাঙালির কয়েকটি প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। তিনি মূলত অলঙ্করণ শিল্পী। কমিক্স আঁকতেন। বাংলা কমিক্স সাহিত্যের প্রথম পর্বের অন্যতম দিশারি। শুধুমাত্র আঁকতেন না, মূলত নিজেই লিখতেন গল্পগুলো। রচনা করতেন সংলাপ। সবমিলিয়ে ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী। ‘হাঁদা-ভোঁদা’ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। এই কমিক্সের পথচলা শুরু ১৯৬২ সালে। ১৯৬৫ সালে তিনি জন্ম দেন সুপারম্যান বাঁটুলের। হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা যুবকটি ছিল অসীম সাহসী। ‘শুকতারা’ হাতে পেলে ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও চোখ রাখত এই দুই কমিক্সের পাতায়। হাঁদা ভোঁদার খুনসুটি আর বাঁটুলের বীরত্ব দেখার জন্য। ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এর পাশাপাশি উচ্চারিত হত ১৯৬৯ সাল থেকে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নন্টে আর ফন্টে’র নামও।

আরও পড়ুন-সময়ে নির্বাচনের দাবি, উত্তেজনা মোহনবাগানে

রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে
যদিও কমিক্সের দুনিয়ায় তিনি পা রেখেছিলেন তারও আগে। ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। ‘রবি ছবি’ নামে ধারাবাহিক কমিক্স স্ট্রিপের মাধ্যমে। আঁকতেন তিনি। লিখতেন বিমল ঘোষ বা মৌমাছি। পরবর্তী সময়ে নারায়ণ দেবনাথ কমিক্স করেছেন বিবেকানন্দ, শিবাজিকে নিয়ে। যদিও অলঙ্করণ শিল্পী হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি গত শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি। কালিদাস রায়ের অনুবাদ কবিতার বই ‘ত্রিবেণী’র জন্য এঁকেছিলেন ছবি। কাজ করেছেন প্রচুর। তবে তিনি সেইভাবে কোথাও বাঁধা মাইনের চাকরি করেননি।
সিরিয়াস এবং মজা
অল্প সময়ের মধ্যেই শিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। ছিলেন ভার্সেটাইল। একই সঙ্গে এঁকেছেন সিরিয়াস এবং মজার ছবি। ওঁর সময় আর কেউ ছিলেন না যিনি দুই রকম ছবির সমান ভাবে আঁকতে পারতেন। মনে করেন শিল্পী দেবাশিস দেব। তাঁর মতে, পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি কমিক্স করেছেন। ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে ফন্টে’ তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। কমিক্স তাঁকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল, তবে তিনি ছিলেন মূলত অলঙ্করণ শিল্পী। রেফারেন্স জোগাড় করে গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সময় কাজ করেছেন। ওঁর গুরু ছিলেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রিয়েলিস্টিক কাজ করতেন। ঠিক ঠিক বর্ণনা অনুযায়ী। তাঁর মতোই নারায়ণবাবুর ছবিও জীবন্ত হয়ে উঠত। বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত। আকর্ষণ করত ছোটদের।

আরও পড়ুন-আর্থিক পুরস্কার, রবিদের বরণ সবুজ-মেরুনের, তিন প্রধানকে বার্তা সঞ্জয়ের

জাতীয়তাবোধের জাগরণ
বাংলা গ্রন্থচিত্রণের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। জন্ম হাওড়ার শিবপুরে। ১৯২৫-এ ২৫ নভেম্বর। প্রায় শতবর্ষ আগে। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাসস্থান ছিল ওপার বাংলায়। বাবা-কাকারা এপারে চলে এসে গয়নার ব্যবসা শুরু করেন। কাকা ছিলেন নকশাদার। তাঁর কাজ দেখেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ জন্মায় নারায়ণ দেবনাথের। রং-তুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ কমিক্সের মাধ্যমে তিনি কি শুধুই পাঠকের নির্মল আনন্দ দিতে চেয়েছেন? আর কিছু চাননি? ভুললে চলবে না, ১৯৬২ সালে ঘটে গিয়েছে ভারত-চিন যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুযুধান। বাঁটুলের আগমন যেন সেই যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে কোথাও জাতীয়তাবোধের জাগরণকে চিহ্নিত করে। ভারত-পাক সংঘাতের সময়ে খানসেনাদের তুলোধোনা করে বাঙালির একান্ত জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরেছিল বাঁটুল দি গ্রেট। এই কমিক্সের কুশীলবরা যেন এক অলীক শহরের বাসিন্দা। হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে পুরোপুরি বাঙালি কেতায়। ভুঁইফোঁড়, লোক-ঠকানো, ফ্যাশন-সর্বস্ব পোশাকের দোকানের নাম দিয়েছিলেন ‘অঙ্গবাহার’। সাদাসিধে পোশাক বিপণির নাম ‘অঙ্গঢাকা’। এইরকম রসবোধে মজে যেতে সময় লাগেনি বাঙালি পাঠকদের। এর পাশাপাশি ‘হাঁদা-ভোঁদা’র পরিমণ্ডল ষোলো আনা বাঙালি। রোগা-পাতলা হাঁদা। দুষ্টু। নাজেহাল হয়। সহজ-সরল ভারী চেহারার ভোঁদা বুদ্ধি খাটিয়ে জিতে যায়। এই ছকেই বাঁধা হয়েছে প্রতিটি গল্প। পুনরাবৃত্ত হয়েছে এই কাঠামো। আশ্চর্য ক্ষমতা। একটুও একঘেয়ে লাগে না। আসলে এই কমিক স্ট্রিপ খুদে দস্যিদের পেরেছিল একাত্ম বোধ করাতে। তাদের অভিভাবকদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কৈশোরের দিনগুলোয়।

জীবনের নানা কাহিনি
‘নন্টে-ফন্টে’র দুনিয়া ছিল একেবারেই অন্যরকম। ছাত্রাবাসের ঘেরাটোপে সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর বেয়াদব সিনিয়র কেল্টুর সঙ্গে নন্টে-ফন্টের অনিঃশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হস্টেল জীবন কাটিয়ে আসা বঙ্গসন্তানকে স্মৃতিভারাক্রান্ত করে। যাঁরা সেই জীবনের স্বাদ পাননি, বন্ধুদের মুখ থেকে শুনেছেন সেই জীবনের নানা কাহিনি, তাঁদেরও প্রায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে সক্ষম হয়েছে এই চিত্র-কাহিনি। আরও বেশ কিছু কমিক স্ট্রিপ রচনা করেছিলেন। ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘ডিটেকটিভ কৌশিক রায়’ ইত্যাদি। তবে এই সবের মধ্যে উল্লেখের দাবি রাখে ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়’ সিরিজ। দুর্দান্ত অপরাধী ব্ল্যাক ডায়মন্ড আর গোয়েন্দা ইন্দ্রজিতের টক্করে কে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়, তা জানা যায় না কখনওই। সেইসব চিত্রকাহিনি গোগ্রাসে গেলেনি, কৈশোর পেরোতে থাকা তেমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার।
দেখা যেত বাঙালিয়ানা
শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ছোটবেলায় নারায়ণ দেবনাথের কমিক্সের সঙ্গে আমার পরিচয়। দেবসাহিত্য কুটীরে ছাপা হত। দেখতাম। অবাক হতাম। আনন্দ পেতাম। ওঁর কমিক্সের মধ্যে এক ধরনের বাঙালিয়ানা দেখা যেত। ভাবনাগুলোও ছিল অদ্ভুত। সারা পৃথিবীর বাঙালিদের মাতিয়ে দিয়েছিল। মুগ্ধ হতেন শিল্পী এবং সাধারণ মানুষ। দুটো পাতার মধ্যে ছবি এঁকে গল্প সাজিয়ে দিতেন। ছবির সঙ্গে সংলাপ ছিল পারফেক্ট। একেবারেই ওভারলোডেড মনে হত না। ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে-ফন্টে’র পাশাপাশি আরও কিছু কমিক্স করেছেন। সেগুলো রিয়েলিস্টিক ড্রয়িং। দেখা যেত আলোছায়ার পারফেকশন। সবগুলোই দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। ওঁর কাজগুলো ছিল সহজ সরল, অথচ সুন্দর। দেবসাহিত্য কুটীর এবং পত্রভারতীতে প্রচুর কাজ করেছেন।” কতটা অনুপ্রাণিত হয়েছেন? তিনি জানালেন, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আগে আমি কমিক্স এবং কার্টুন আঁকা শুরু করি। তখন নারায়ণবাবুর কাজ দেখে শেখার চেষ্টা করেছি। কপি করেছি। প্র্যাকটিস করেছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও শেখার চেষ্টা করেছে। নারায়ণবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল একটা সময়। তখন নিয়মিত কলেজ স্ট্রিটে আসতেন। ময়ূখ চৌধুরী, শৈল চক্রবর্তী প্রমুখর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। আমরা তখন নতুন। চুপচাপ ওঁদের কথা শুনতাম। শিখতাম। সেই দিনগুলো আজও মনের মণিকোঠায় থেকে গেছে।

নিখুঁত আর ঝকঝকে
নারায়ণ দেবনাথের নিজের হাতে আঁকা পাতা ছুঁয়ে দেখেছিলেন শিল্পী অর্ক পৈতণ্ডী। তিনি জানান— এত নিখুঁত আর ঝকঝকে যে, ছাপা বলে ভ্রম হয়। সেই পাতা দুটো হাতে নিয়ে বসেছিলাম বহুক্ষণ। রেখাগুলোয় আঙুল বুলিয়েছিলাম। ছোট থেকে ওঁর কমিক্স পড়ে বড় হয়েছি। কিন্তু শিল্পীর হাতে আঁকা পাতা ছুঁয়ে দেখার সেই রোমাঞ্চ বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। ময়দানে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলছে এমন এক কিশোরের হাতের মুঠোয় যদি কখনও চলে আসে শচীন তেন্ডুলকরের ব্যাট, তার যেমন অবস্থা হবে, আমার অবস্থাও ঠিক তেমনই তখন।
নারায়ণ দেবনাথ পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। ২০২২-এর ১৮ জানুয়ারি, ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
কার্টুনের রাজা চণ্ডী লাহিড়ী
চণ্ডী লাহিড়ী ছিলেন কার্টুনিস্ট। যাপন করেছেন বর্ণময় জীবন। জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ মার্চ। বুড়ো শিবতলায়। মামার বাড়িতে। নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন। বাংলায় এমএ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত দিনে হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। শহরে গেলেও নবদ্বীপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। দীর্ঘ পাঁচ দশক বাংলা কার্টুনচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় দৈনিক লোকসেবক পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে। এরপর ১৯৬১ সালে ব্যঙ্গচিত্রী হিসেবে কার্টুনচর্চা শুরু করেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় যোগ দেন ১৯৬২ সালে। সর্বভারতীয় নানা পত্রিকায় কার্টুন এঁকেছেন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক
কার্টুন এঁকেছেন পশ্চিমবঙ্গের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের জন্য। তাঁর সৃষ্ট পকেট কার্টুন ‘তির্যক’ও ছোটদের জন্য সৃষ্ট কমিক্স জনপ্রিয় হয়েছিল। রাজনৈতিক ও সামাজিক দুই ধরনের কার্টুন আঁকতেন। কার্টুন নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। যার মধ্যে রয়েছে কার্টুনের ইতিবৃত্ত, বাঙালির রঙ্গব্যঙ্গচর্চা, গগনেন্দ্রনাথ : কার্টুন ও স্কেচ। তাঁর কার্টুন সংগ্রহের নাম চণ্ডী লুকস অ্যারাউন্ড এবং ভিজিট ইন্ডিয়া উইথ চণ্ডী। ব্যঙ্গচিত্রী হিসেবে ডেভিড লোয়ির অনুরাগী ছিলেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রেও কার্টুন করেছেন। যার মধ্যে ‘হংসরাজ’, ‘ধন্যিমেয়ে’, ‘মৌচাক’, ‘চারমূর্তি’ প্রভৃতি খুবই বিখ্যাত। কন্যা তৃণার সঙ্গে যৌথভাবে ‘মানুষ কি করে মানুষ হল’ নামে তাঁর একটি নৃবিজ্ঞান বিষয়ক কাজের জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নরসিংহ দাস পুরস্কারে সম্মানিত হন।
এডিটোরিয়াল কার্টুন
রত্নব্যবসা থেকে ভাড়াটে উচ্ছেদ, ভোট প্রচার থেকে সিনেমা প্রচার– জনরুচির এই সুবিশাল গণ্ডিতে মিতব্যয়ী কয়েকটি কালো রেখা সম্বল করে যে কালোত্তীর্ণ থাকা যায়, চণ্ডী লাহিড়ীর কাজ তার মোক্ষম উদাহরণ। তাঁর গুণমুগ্ধ শিল্পী দেবাশিস দেব জানালেন, চণ্ডী লাহিড়ী কার্টুনিস্ট হবেন বলেই এই লাইনটা বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে একটি কাগজে সাংবাদিকতা করতেন। সেখানেই বেরোয় ওঁর প্রথম কার্টুন। একটা সময় চলে আসেন আনন্দবাজারে। সেখানে এডিটোরিয়াল কার্টুন-সহ প্রচুর কার্টুন করেছেন। ছয়ের দশকের গোড়ায় শুরু হয় তির্যক। প্রতিদিন একটি করে কার্টুন আঁকতে হত।

আরও পড়ুন-২২ জানুয়ারি থেকে জয়েন্টের রেজিস্ট্রেশন

পলিটিক্যাল স্যাটায়ার
চিত্রবিদ্যার সঙ্গে বৈদগ্ধকে মেলাতে পেরেছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী। সেই কারণেই কার্টুনিস্ট হিসেবে বিখ্যাত হতে পেরেছিলেন। গ্রাম থেকে এসেছিলেন শহরে। একটা সময় দিনের বেলায় কলকাতায় ঘুরে বেড়াতেন। মানুষ দেখতেন। কার্টুনের বিষয় সংগ্রহ করতেন। স্কেচ আঁকতেন। শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, চণ্ডী লাহিড়ী মূলত কার্টুন আঁকতেন। ওঁর কার্টুনে দেখা যেত পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। তুলে ধরতেন সময়ের কথা। সমাজের কথা। মানুষ হিসেবে ছিলেন সহজ, সরল, ভদ্র। এড়িয়ে চলতেন ঝগড়াঝাঁটি। অফিসে একটু আগে আসতেন পূর্ণেন্দু পত্রী। দু’জনে বসতেন একই ঘরে। পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছে কেউ এলে চণ্ডীদার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতেন। সেই সময় চণ্ডীদা ঘরে তাঁর চেয়ারে অন্য কেউ বসে আছে দেখলে বাইরে পায়চারি করতেন। একই অফিসে কাজ করতাম। এইগুলো আমাদের নিজের চোখে দেখা। তিনি আরও বলেন, মাঝেমধ্যে চণ্ডীদা মজার মজার গল্প বলতেন। চলচ্চিত্রে করেছেন অ্যানিমেশনের কাজ। অনবদ্য কার্টুন। হাত ছিল পাকা। কিছু জায়গা ভরাট রাখতেন, কিছু জায়গা ফাঁকা। এটাই ছিল ওঁর বৈশিষ্ট্য। কোনওরকম ওভারলাইন দেখা যেত না। ছোট্ট স্পেসকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করতেন। আঁকতেন কলম দিয়ে। সবই স্বচক্ষে পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি। অনেককিছু শিখেছি। কী শক্তিশালী ছবি আঁকার হাত ছিল, ভাবলে অবাক হতে হয়।
রোষানলে পড়েছিলেন
আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি পত্রিকা ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এর ‘থার্ড আই’ জনপ্রিয়তা দিয়েছিল চণ্ডী লাহিড়ীকে। ওঁর কাজ দেখেছেন, ওঁর কার্টুনের দ্বারা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন শিল্পী অর্ক পৈতণ্ডী। তিনি জানালেন, পলিটিক্যাল কার্টুনে ওঁর কোনও তুলনাই হয় না। কাফি খাঁ-র যোগ্য উত্তরসূরি। একটা সময় সংবাদপত্রে নিয়মিত কার্টুন ছাপা হত। এখন তার চল প্রায় নেই বললেই চলে। চণ্ডী লাহিড়ী যে সময় কাজ করেছেন, সেটা ছিল স্বর্ণযুগ। ওঁর কার্টুন সংকলন আমার সংগ্রহে রয়েছে। মাঝেমধ্যেই পাতা ওল্টাই।
ঝড়ঝাপটা এসেছে জীবনে। তবে দমে যাননি চণ্ডী লাহিড়ী। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর রোষানলে পড়েছিলেন। তবু থামাননি কাজ। আপনমনে ডুবে থেকেছেন সৃষ্টির আনন্দে। কার্টুন আঁকার পাশাপাশি ‘দেশ’ পত্রিকায় ছবি এঁকেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক ফিচার ‘সুনন্দর জার্নাল’-এ। লিখেছেন আত্মকথা। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটি ছিলেন বিরল প্রতিভাসম্পন্ন। বাংলা কার্টুনকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন। আজও তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়।

Latest article