বিল পাশ করানোর সময় অবজ্ঞাত হচ্ছে সংসদ। আইন রদের সময়েও সংসদে আলোচনা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এক বিচিত্র চুপ করানোর খেলায় মেতেছে মোদি জমানা। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আজ বিপন্নতার শিকার। লিখছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
আরও পড়ুন-তিস্তার পরিবারের পাশে রয়েছে হিন্দু মহাসভা, অস্বস্তি সৃষ্টি বিজেপিতে
সংসদীয় গণতন্ত্র কেন প্রয়োজন? আমাদের মতো দেশে এই মডেলটি গ্রহণ করার জন্য একটি কারণই ছিল। সেটি হ’ল বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়া। শুধুমাত্র ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত বৈচিত্র নয়, মনন বা চিন্তার বিভিন্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই সংবিধান নির্মাতারা সংসদীয় গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। রাষ্ট্রপতি দ্বারা শাসিত ব্যবস্থার তুলনায় তা অনেক বেশি আলোচনার দ্বারা পরিচালিত হতে পারবে, এই ভাবনাটি তাঁদের ছিল।
আরও পড়ুন-বিচারপতি নিয়োগ প্রশ্ন কল্যাণের
স্বাধীনতার পর বহু বছর নানা বিল আইনসভার সম্মতি নিয়ে, নানাবিধ বিতর্ক ও সংশোধনী সহ আইনে পরিণত হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই, আইন করার ক্ষমতা থাকলেই যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা যায় না। বিরুদ্ধ মতের সারবত্তা থাকলে তাকে গুরুত্ব দিয়ে সংশোধনী গ্রহণ করলে তবেই একটি আইন সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তো যেকোনও বিল পাশ করিয়ে নেওয়া যায়! রাষ্ট্রনীতির ছাত্রদের কাছে একটি আইন পাঠ করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি সেই আইন নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য জানাটা জরুরি। সেইখানেই একটি বিরাট ফাঁকিবাজি চলছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের একাধিপত্য শুধুমাত্র যে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করছে, তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রনীতি চর্চার বিস্তৃত পরিসরটিও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুন-ইডেনে ফের দাদাগিরি সৌরভের ব্যাটে, কর্তাদের ক্রিকেটে মাঠে ফিরলেন আজহার
অর্ডিন্যান্স কখন আনা যেতে পারে? অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে, সংসদের দুটি অধিবেশনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সময়ে। প্রয়োজনটি আপৎকালীন হওয়া আবশ্যক। পরবর্তী অধিবেশনে অবশ্যই অর্ডিন্যান্স আইনসভায় আনতে হবে এবং বিতর্কের মাধ্যমে পাশ করাতে হবে। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদল সংসদীয় গণতন্ত্রের এই সাধারণ প্রক্রিয়াটি মেনে নিতে অপারগ। তাঁরা মনে করছেন যে একপ্রকার সংসদীয় একনায়কতন্ত্র চালাতে পারলেই বোধহয় উপযুক্ত শাসনব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা যাবে। এটি হল অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা।
আরও পড়ুন-ড্র ম্যাচে ছন্দের আশ্বাস ইস্টবেঙ্গলের
অন্যায় তো বটেই, অদূরদর্শী পদক্ষেপ। গত আড়াই বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদী একের পর এক বিল সংসদীয় বিতর্ক ছাড়াই স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাশ করিয়ে নিয়েছেন। কাশ্মীর প্রশ্নে ৩৭০ ধারা বাতিল করার সময়ে, আগের দিনও সাংসদরা জানতেন না কী হতে চলেছে। অথবা আন্দাজ করলেও বিল সংক্রান্ত বিতর্কের কোনও অবকাশ রাখা হয়নি। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের জন্য যে বিতর্ক হয়েছিল তা সম্পূর্ণ একপেশে। বিরোধীদের আনা সংশোধনীগুলো ধ্বনি ভোটে পরাস্ত করাই যেন হয়ে উঠেছিল শাসকদলের ধ্যানজ্ঞান। অথচ ওই বিরোধী সংশোধনীগুলো যদি গ্রহণ করা হত হয়তো বা এতদিনে আইন প্রণয়নের রুল তৈরি করা সম্ভব হত। দেশের এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষজনকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় কালযাপন করতে হত না। রুল তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় একান্তই শাসক দলকে নিতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বোধটিই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। তাকে আঘাত করা আর সোজাসুজি একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে একই মুদ্রার দুটি পিঠ মাত্র।
আরও পড়ুন-স্কুলে পড়ুয়া ফেরাতে দুয়ারে বিডিও
তিনটি কৃষি আইনকে ঠিক এইভাবেই আনা হয়েছিল। অর্ডিন্যান্স জারি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আপৎকালীন কোনও বিষয় নয়। কর্পোরেটদের কৃষিক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া বা খুব ভাল অর্থে, কৃষি অর্থনীতিতে সংস্কার আনার বিষয়টি হুড়োহুড়ি করার জন্য নয়। গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে অনর্গল আলাপচারিতার পর একটি সুসংবদ্ধ সংস্কারের চিন্তা নিয়ে আইন করাই যেতে পারত। সেই আইনটি সংসদের উভয়কক্ষে আলোচনা করে তবেই পাশ করাতে হত। কিন্তু সেসবের ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে সরাসরি অর্ডিন্যান্স এনে ফেলা হল এবং রাষ্ট্রপতির সইসাবুদ সেরেও ফেলা গেল। অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়কেও অকাতরে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর দেখিয়ে পাল্টে ফেলা হল। গতবছর বাদল আর শীতকালীন অধিবেশনের অন্তর্বর্তীকালে এইসব কাজ করে ফেলল কেন্দ্রীয় শাসকদল।
আরও পড়ুন-সংসদে সরব শতাব্দী, সক্রিয় প্রশাসন
শুধুমাত্র অকালি দলের মন্ত্রীই যে পদত্যাগ করবেন, এরকম একটি ধারণা হয়তো তাঁদের ছিল। কিন্তু সংসদের বাইরে এমন বিপুল এবং দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলন যে হতে পারে, সেটা ছিল ধারণাতীত। আমরা স্বাধীনতার আগে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যে শ্রেণি সমন্বয়মূলক কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস পড়েছি, এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। এর সঙ্গে যুক্ত হল অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষজনের সোচ্চার উপস্থিতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ। তাঁদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে আটকে রাখা গেল না। আন্দোলন দমনের পথে গুন্ডা লেলিয়েও কোনও কাজ হল না।
আরও পড়ুন-Akhil Giri-Suvendu Adhikari: শুভেন্দুকে ‘লোডশেডিং MLA’ বলে খোঁচা রাজ্যের মন্ত্রীর
লখিমপুর খেরির নির্দয় ঘটনার পর দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ আরও সোচ্চার হলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি ভাবলেন, এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন তাঁর একটি কথাতেই আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে, আলতো করে ক্ষমাটমা চেয়ে যদি আসন্ন উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে মানুষের মন জয় করা যায়! সেই প্রক্রিয়াটিও বিতর্ক ছাড়াই হল। ন্যূনতম প্রশ্ন, ভিন্ন দাবি পেশের অবকাশ রাখা হল না।
ইতিমধ্যে কৃষক আন্দোলনে বহু কৃষক রক্তাক্ত হয়েছেন। সাতশোর বেশি কৃষক প্রাণ হারিয়েছেন।
তাঁদের পরিবারের প্রতি অন্তত দৃষ্টিপাত করুন। এবছরের শুরুতেই তো শীর্ষ আদালত তিনটি কৃষি আইনের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল যে এত মানুষ যখন প্রবল শীতের মধ্যেও, অত্যন্ত কষ্ট করে এই আন্দোলন করছেন, বুঝতে হবে আইন পাশ করার প্রক্রিয়ায় কোথাও গলদ আছে।
প্রক্রিয়াটি সংসদকে অবজ্ঞা করার অভ্যাসের ফলেই এত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে নিজেকে প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে ফেলল।