এক্সট্রা X-ফ্যাক্টর

পুরুষ-দেহে উপস্থিত ক্রোমোজোমে রয়েছে লিঙ্গ নির্ধারণকারী দুটি X ও Y ক্রোমোজোম; এখন যদি একটি X কিংবা একটি Y ক্রোমোজোম অতিরিক্ত থাকে, তাহলে কী হবে— প্রথম পর্বে পুরুষ-দেহে একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের উপস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

X-ফ্যাক্টর
আমি? আমি পারব না, মাস্টারমশাই। আমি তো ভাল অভিনয় জানি না! গোপাল মাস্টার হেসে বললেন, “তোর অভিনয় জানা দরকার নেই, তোর মধ্যে এমনকিছু আছে যা মানুষকে টেনে আনে, ওটাই এক্স-ফ্যাক্টর। সেটাই কাজে লাগাবি।” নাটকের দিন এল। নাটক শেষ হওয়ার পর চারপাশে শুধু একটাই আলোচনা: “অমল অসাধারণ, যেন চরিত্রটা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।” হম্ ওটা এক্স-ফ্যাক্টরই ছিল, যা অমলকে একটি অনন্য পরিচয় দিল। এক্স-ফ্যাক্টর হল কোনও ব্যক্তির এমন একটি অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য যা তাঁকে অন্যের চেয়ে আলাদা হিসেবে প্রতিপন্ন করে, প্রশংসা পায়, অসম্ভব কিছু করে দেখানোর উৎসাহ লাভ করে।
বায়োলজির চোখ দিয়ে দেখলে, মানবদেহে বিশেষ করে পুরুষ-দেহে একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে এক্স-ফ্যাক্টর! জীববিজ্ঞানীরা এইরকম অনিয়মিত সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকার ব্যাপারটিকে অ্যানুপ্লয়েডি বলে থাকেন; সাধারণত এই ঘটনায় দেহে নির্দিষ্ট ক্রোমোজোমের চেয়ে বেশি কিংবা কম সংখ্যক ক্রোমোজোম উপস্থিত থাকে। ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ২৩নং জোড়টিই সেক্স ক্রোমোজোম: স্ত্রী দেহে XX, এবং পুরুষ দেহে XY। অ্যানুপ্লয়েডির হিসেব অনুযায়ী, শরীরে ২১তম ক্রোমোজোম-জোড়ের একটি এক্সট্রা কপি উপস্থিত থাকলে তখন বলা হয় ডাউন সিনড্রোম। আবার কোনও স্ত্রীর দেহে যদি একটি X ক্রোমোজোম কম থাকে তখন ব্যাপারটি হয়ে যায় টার্নার সিনড্রোম, আবার যদি একটি বেশি থাকে, তাহলে বলা হয় ট্রিপল এক্স সিনড্রোম। এখন যদি কোনও পুরুষ-দেহে একটি X ক্রোমোজোম অতিরিক্ত থাকে, তাহলে কী হবে? এই এক্স-ফ্যাক্টর শরীরের মধ্যে কী কী পরিবর্তন আনতে পারে, সেটাই এখন জানার।

আরও পড়ুন-এনকাউন্টারের জন্য দায়ী ৫ পুলিশ, নির্দেশ এফআইআরের

৪৭, XXY
যদি বিরল, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ দেহে অতিরিক্ত একটি X ক্রোমোজোম উপস্থিত থাকে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ক্লাইনফেল্টার সিনড্রোম। সাধারণত এক্স-ফ্যাক্টর বলতে পজিটিভ কিছু বোঝালেও, মানবদেহে অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের অস্তিত্ব সেই অর্থে সুখকর নয়! আক্রান্ত পুরুষের বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতেই নানা ধরনের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, যৌনাঙ্গের বৃদ্ধি ঠিকঠাক হয় না, ছোট এবং দুর্বল হওয়ায় সমস্যাটি পুরুষ বন্ধ্যাত্বের দিকে এগিয়ে যায়। এছাড়াও আরও অন্যান্য কিছু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়।
প্রতি দশহাজার জনসাধারণের মধ্যে অন্তত চার জনের এইপ্রকার ক্রোমোজোম-সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে, সমীক্ষায় উঠে এসেছে প্রায় ২৫ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা জীবনে কখনও না কখনও এই রোগ ধরা পড়েছে। জন্মের সময়ই কোনও শিশু তার মা-বাবার কাছে থেকে এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মায়। সচেতন হয়ে যদি বয়ঃসন্ধির প্রাক্কালেই ক্রোমোজোমের ক্যারিওটাইপিংয়ের মধ্য দিয়ে এই রোগ শনাক্ত করা যায়, তাহলে ওষুধ এবং নানারকম ব্যবস্থাপনায় আক্রান্ত একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
X ক্রোমোজোম
মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী, বেশ কিছু প্রজাতির পতঙ্গ (ড্রসোফিলিয়া মাছি), সাপ, মাছ (গাপ্পি) প্রভৃতির দেহে উপস্থিত XY লিঙ্গ নির্ধারণকারী তন্ত্রের অন্যতম অংশ হল X। আবার প্রাণিজগতের বহু প্রজাতির পতঙ্গ এবং অন্যান্য কীটের শরীরের X0 লিঙ্গ নির্ধারণকারী তন্ত্রেরও মূল এই X ক্রোমোজোম, এই তন্ত্রে 0 (শূন্য) Y ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি নির্দেশ করে। সাধারণত স্ত্রী দেহে দুটি X ক্রোমোজোম এবং পুরুষ দেহে একটি X এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে।
প্রথম ১৮৯০ সালে কোষবিদ ড. হারমান পল অগাস্ট ওট্ট হেঙ্কিঙ্গ জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের লাইপজিগ শহরে পাইরোকোরিস অ্যাপটেরাস (ফায়ার বাগ) নামে একটি লাল-কালো রঙের পোকার অন্ডকোষ পরীক্ষা করতে গিয়ে এই X ক্রোমোজোমের হদিশ পান। প্রথমত, তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, যে, এটা একটি ক্রোমোজোম, কেননা, তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, এটা মিয়োসিস কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করছে না। এই অনিশ্চিত ব্যবহারের জন্যই এর নাম রাখাহয় “X এলিমেন্ট”। পরবর্তীতে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান কোষবিদ ডঃ ক্ল্যারেন্স এরউইন ম্যাকক্লাঙ্গ পঙ্গপালের অণ্ডকোষ পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রমাণ করেন, যে এটি X ক্রোমোজোম, যা প্রাণীদেহে লিঙ্গ নির্ধারণ করতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন-বিজেপি-নীতীশের বিহারে ফের বিষমদ ট্র্যাজেডি, মৃত্যু ৭

মিয়োসিস এবং অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের প্রাপ্তি
দ্যা কনসেনসাস কোডিং সিক্যুয়েন্স প্রোজেক্টের হিসেব অনুযায়ী, মানবদেহে রয়েছে প্রায় ২০-২৫ হাজার জিন, তার মধ্যে X ক্রোমোজোমে রয়েছে ৮০০টি প্রোটিন কোডিং জিন এবং Y ক্রোমোজোমে রয়েছে ৭০টি জিন। কোষ বিভাজনের সময় এরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। যৌন-প্রজননের সময় যদি জননকোষের নিউক্লিয়াসে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোজোম উপস্থিত থাকে, তাহলে মিলনের ফলে সৃষ্ট অপত্য কোষে তা দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলন মিয়োসিস কোষ বিভাজনের মধ্যে দিয়ে হয়। এইক্ষেত্রে উভয় জননকোষেই অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজোম উপস্থিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই মিয়োসিস বিভাজনের সময় কোনওপ্রকার ত্রুটির জন্যই পিতা-মাতার শরীর থেকে পুত্রসন্তানের শরীরের একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোম চলে আসে, ফলে সৃষ্ট হয় ৪৭, XXY। তবে বয়স্ক মাতৃদেহ থেকে এই ক্রোমোজোম সন্তানের শরীরে আসার ঝুঁকি বেশি।

আরও পড়ুন-কৃষক হত্যার রিপোর্ট তলব সুপ্রিম কোর্টের

রোগ ও তার প্রতিকার
নাহ্ কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই অতিরিক্ত ক্রোমোজোমটি শিশুর দেহে আসে না, এটি দৈবাৎ। মানবদেহে X ক্রোমোজোম প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন সংখ্যক ডিএনএ তৈরির মূল উপাদান “বেস প্লেয়ারস” জোগান দেয়। এবং এর অতিরিক্ত উপস্থিতি মানবদেহের কাঠামো, এমনকী হাত-পাগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় লম্বা হলেও মাংশপেশি শিথিল এবং দুর্বল হয়ে থাকে। বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ বিকাশ হয় না, অটোইমিউন ডিস-অর্ডার দেখা দেয়। সারাদেহ তুলনামূলকভাবে রোম বিরল হয়। পুরুষ-দেহে স্ত্রীর মতো স্তনগ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, যাকে গাইনোকোমেস্টিয়া বলা হয়ে থাকে। অণ্ডকোষের সাইজ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ছোট হয়, ফলস্বরূপ যৌন-উৎসাহ জাগে না, বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। এমনকী অস্টিওপোরোসিস, হার্টের রোগ এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারও হয়ে থাকে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও অ-স্থিতিশীলতায় ভোগে আক্রান্ত ব্যক্তি।
তবে এই সমস্যাগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রাথমিকভাবে সচেতন হয়ে সামান্য রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে যদি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগীকে একটি সুস্থজীবন উপহার দিতে সক্ষম। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-পূর্ব পর্তুগালের ব্রাগাঙ্কা শহরের একটি প্রাচীন কবর থেকে তুলে আনা কঙ্কাল পরীক্ষা করতে গিয়ে, খোঁজ মেলে এই রোগের। ফিজিক্যাল থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, টেস্টোস্টেরন হরমোন প্রতিস্থাপন, কাউন্সেলিং প্রভৃতির প্রয়োগে আক্রান্ত ব্যক্তি একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম।

Latest article