ওরা স্বাধীনতা দিবসের তারিখটাও বদলাতে চাইছে

ইতিহাস পরিবর্তন করতে চাইছে ওরা। গান্ধী, নেতাজি, দেশবন্ধুদের চাপা দিতে চাইছে সাভারকরের সন্তানরা। আর তাই এবার ১৫ অগাস্টকে বদলে অন্য স্বাধীনতা দিবসের ভাবনা হিন্দুত্বের কারখানায়। লিখছেন ড. মইনুল হাসান

Must read

ঝুলি থেকে বিষাক্ত ও কড়া দাঁত, নখগুলো ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে। বিজেপি’র মস্তিষ্ক বলে সাব্যস্ত আরএসএস। যারা এই দেশে হিন্দুত্ববাদ কায়েম করতে চায়। যারা এই দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পাল্টে দিতে চায়। যারা নতুন করে দেশের ইতিহাস লিখবে বলে জানান দিয়ে রেখেছে। কোথাও কোথাও কাজও শুরু করেছে। এমনকী তারা দেশের পবিত্র দলিল সংবিধানকেও ছাড় দিচ্ছে না। সেই আরএসএস-এর প্রধান পুরুষ একটা নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন দেশের স্বাধীনতা দিবস বা স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা। তিনি বলেছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই দিন যেদিন অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট নাকি কিছুই না।

আরও পড়ুন-এক্সট্রা X-ফ্যাক্টর

কয়েকটি বাক্যে তিনি তাঁর কাজ সেরেছেন। কিন্তু তার ব্যঞ্জনা মারাত্মক। অত্যন্ত গভীরে তার তাৎপর্য। ভারত-বিরোধী বহু মানুষের সন্ধান আমাদের জানা আছে। মাঝে মাঝে কাগজপত্রে তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ বোধ হয় এত নগ্নভাবে ভারতের জনগণের দীর্ঘদিনের জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম, স্বাধীনতার যুদ্ধে অসংখ্য শহিদদের অপমান করার সাহস পাননি। শতবর্ষে পা দিতে যাচ্ছে সংগঠনটি। তাদের এমন ভয়াবহ মূর্তি দেখে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে অগণিত সাধারণ ভারতবাসীর কর্তব্য নির্ধারণের সময় উপস্থিত হয়েছে।
মুসলমানদের ‘বিষাক্ত সাপ’ হিসাবে চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে অশেষ ঘৃণা ও বিদ্বেষ বর্ষণ করে এবং শূদ্র-অতিশূদ্র জনগণের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টায় আশঙ্কিত হয়ে হেডগেওয়ার ও আরও কয়েকজন হিন্দু মহাসভার নেতা রামনবমীর দিনে আরএসএস গঠন করেন। সংগঠনটির নামে যুক্ত হল ‘রাষ্ট্রীয়’ শব্দ, ‘হিন্দু’ নয়। কারণ হেডগেওয়ারের মতে, রাষ্ট্র ও হিন্দু সমার্থক শব্দ। প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই আরএসএস ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার চেষ্টায় রত থেকেছে। পতাকা হিসাবে নিয়েছে ভগবান রামের ঝাণ্ডা। যা শিবাজি ব্যবহার করতেন। এই ঝাণ্ডার নিচে হিন্দুদের সর্বত্র সমবেত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই ছোট ছোট সংগঠনকে বলা হয় শাখা। সেখানে অস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হয়, ছুরি চালানো শেখানো হয়, লাঠি খেলা হয়। খাকি হাফ প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরিহিত শাখাকর্মীরা যেন যুদ্ধ কৌশল শিখছে! এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়নি। বরং দেশের মানুষের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহার হয়েছে। ১৯২৭ সালে নাগপুরে হিন্দুদের মহালক্ষ্মী পুজো ও মুসলমানদের ধর্মীয় শোভাযাত্রার মধ্যে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যে সম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে তাতে সংঘের কর্মীরা ব্যাপক মাত্রায় জড়িত ছিল। সামাজিক কাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি তাদের কাজ বলে সরসংঘ পরিচালকরা প্রচার করতেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আরএসএস ভারতের মহান ঐতিহ্য ও সংঘবদ্ধ জীবনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে বরাবর উপস্থিত থেকেছে।

আরও পড়ুন-চেন্নাই-জয়েই চোখ আজ মোহনবাগানের

আরএসএস-এর অন্যতম নেতা সাভারকার সেলুলার জেলে বন্দি হলেন ১৯১১ সালের ৪ জুলাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। সেই সময় কংগ্রেস নেতা লালা লাজপত রায়। সাভারকার তাঁকে আর নেতা মানলেন না। জেলে থেকেই ক্ষমা প্রার্থনা করলেন ইংরেজের কাছে। তিনি আর কোনওদিন ভুল করবেন না। ইংরেজকে সাহায্য করবেন ইত্যাদি বলে। এই জেলে বসেই একটি পুস্তিকা লিখলেন ‘হিন্দুত্ব’ নামে। যা ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। আরএসএস-এর বাইবেল, সাভারকার একদম উল্টে গেলেন। হিন্দুদের একটা জাতি বলে চিহ্নিত করলেন। এটাও বললেন হিন্দুরা এক নিজস্ব সভ্যতার অংশীদারী। ১৯২৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আরএসএস প্রধান ছিলেন সাভারকার। হিন্দু মুসলমান যে এক জাতি বা এক ঐতিহ্যের অংশীদার হতে পারে না সেটা তিনি তাঁর পুস্তিকাতে বলেন। আজকাল আরএসএস নেতারা দেশ, দেশের মানুষ সম্পর্কে যে ভাষণ দেন সেটা সবসময় সাভারকারের চিন্তা থেকেই।
আমরা দেশ, স্বাধীনতা, দেশের মানুষ নিয়ে অনেক আবেগের কথা বলি। আরএসএসের সে সমস্যা নেই। কারণ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের কোনও যোগ ছিল না। বরং এই লড়াইতে তারা নেই বলে তাদের নেতারা বহু চিঠি ব্রিটিশ শাসককে দিয়েছে। সুতরাং শহিদদের রক্তের দাম কী সে মূল্য তাদের জানা নেই। সবাই জানেন আমাদের রাষ্ট্রীয় ধ্বজ, তেরঙা পতাকা বিষয়ে তারা আবেগময় নয়। এই পতাকা তারা মানতেই পারেনি। শেষকালে চাপে পড়ে। রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হবে এই আশঙ্কায় পতাকা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান পুরুষ মহাত্মা গান্ধী তাদের কাছে কোনও শ্রদ্ধা পাননি কোনও সময়। শেষ পর্যন্ত তাদের এক কর্মীর গুলিতে বাপু প্রাণ হারান। শহিদ হন। আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ভারত সরকার। গৃহমন্ত্রী তখন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। গান্ধীজির হত্যাকারীকে আজও প্রশংসায় ভরিয়ে দেয় আরএসএস। কোথাও তার মূর্তি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছে। সম্প্রতি একটা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। যাতে বোঝা যাচ্ছে তারা পণ্ডিত নেহেরুকেও হত্যর চেষ্টা করেছিল।

আরও পড়ুন-১০ম জঙ্গলমহল উৎসব, আদিবাসীরা উপহার পেলেন ধামসা-মাদল

আরএসএস কেমন শিক্ষা তার কর্মীদের দেয় সেটাই সামান্য উদাহরণ দেব। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আরএসএস প্রধান সগর্বে জানিয়েছিলেন যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যে কাজ ৬-৭ দিনে করবে আরএসএস সে কাজ ৩ দিনে করবে। এটি দেশরক্ষার ক্ষেত্রে। আরও বলেন, দেশের যদি প্রয়োজন হয় এবং সংবিধান যদি স্বীকৃতি দেয় তাহলে স্বয়ংসেবকরা যে কোনও সামরিক পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে পারে। আরএসএস-এর সামরিক প্রস্তুতির মাত্রা এত উঁচুস্তরের যে, সঙ্ঘপ্রধান নির্দ্বিধায় এমন মন্তব্য করতে পারেন। এমন কথাও সঙ্ঘ থেকে বলা হয় যে, ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একমাত্র হিন্দুরাই ঠিক করবে। বিদেশিদের ও ভারতের অহিন্দু কোনও বাসিন্দার কোনওভাবে মাথা গলানো বরদাস্ত করা হবে না।
খুব সহজেই বোঝা যায় একটা সমান্তরাল দেশ চালাচ্ছে বা চালাতে চায় আরএসএস। সারা দেশে লক্ষ লক্ষ শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সব কিছুর সঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। প্রচুর অস্ত্রের জোগাড় হচ্ছে। একেবারে বেআইনি। সুস্থ স্বাভাবিক দেশজ অবস্থাকে হট্টমেলায় পরিণত করার চেষ্টায় সঙ্ঘ তৈরি।
তাদের আলাদা আদালত, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন চায়। তাই তাদের আলাদা স্বাধীনতা দিবস দরকার। সেটাই ঘোষণা করেছেন মোহন ভাগবত মহাশয়। রামমন্দির উদ্বোধনের দিনটি তিনি ঠিক করেছেন। যে ব্যক্তি বা সংগঠন দেশের স্বাধীনতা দিবস মানে না ও পাল্টাতে চায় তারা দেশদ্রোহী তাছাড়া আর কিছু নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক বলেছেন যে, এটা দেশদ্রোহীর কাজ। বিচিত্র এই দেশ এমন দেশবিরোধী বক্তব্যের পরে দেশ প্রশাসকদের হেলদোল নেই। অবলীলায় তারা নানা রঙিন স্বপ্নে মত্ত আছেন। বীর শহিদ, যাদের রক্তে স্বাধীনতা এসেছে, তাদের দিব্যি খেয়ে বলছি, ভারতবাসী এসব মানবে না।

Latest article