১৭ রানে ৫ উইকেট। এমতাবস্থায় জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে আইসিইউ থেকে ভারতকে টেনে তোলেন অধিনায়ক কপিলদেব। কালজয়ী ১৭৫ রানের ইনিংসের দৌলতে। বস্তুত, সেই ম্যাচে ভারত যদি হেরে যেত তাহলে ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হত। ভারতের বিশ্বজয় হয়তো অধরাই থেকে যেত।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ধুঁকতে থাকা পশ্চিমবঙ্গকে কার্যত কপিলদেব নিখাঞ্জের মতোই টেনে তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু টেনে তোলা নয়, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বলছে, আজ নানা দিক থেকে এগিয়ে বাংলা।
কর্মযজ্ঞ কাকে বলে বিগত ১৪ বছর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কর্মযজ্ঞের জোড়া ফলা নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যসাথী ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।
তিনি যখন দায়িত্ব নেন তখন রাজ্যের ওপর লক্ষ কোটি টাকার দেনা চাপিয়ে মানে মানে কেটে পড়েছে বামফ্রন্ট। সেই জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গ আজ সারা দেশের কাছে রোল মডেল। চরম রাজনৈতিক বিরোধী বিজেপিও ভোট বৈতরণী পার হতে মমতা ম্যাজিক সামনে রাখছে। যেমন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনুকরণে মধ্যপ্রদেশের লাডলি বহেনা। মহারাষ্ট্র দখলেও একই ছবি দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন-কৈলাসের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা
সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী প্রণীত স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প টুকলি করে আয়ুষ্মান ভারত চালু করেছে ভারত সরকার। ২০১৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চালু হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী। আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আয়ুষ্মান ভারত লাগু করেছে ২০১৮ তে। যদিও স্বাস্থ্যসাথীর মাতৃত্বের তুলনায় আয়ুষ্মান ভারত নিছকই সৎমা। মানবিকতার ধার কাছ দিয়েও যায়নি সেই প্রকল্প। অপরদিকে, রাজ্যের ৮ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষ এখনই স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় চলে এসেছেন। ৩ হাজারের বেশি হাসপাতাল, নার্সিংহোমে মিলছে স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা। অনেক ব্যয়বহুল রোগ, অপারেশনের চটজলদি সমাধান এনেছে এই প্রকল্প। এখন পর্যন্ত রাজ্যের প্রায় এক কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসাথীর পরিষেবা পেয়েছেন। এই খাতে রাজ্যের খরচ হয়েছে ১১,৩১৫ কোটি টাকা। শুধু স্বাস্থ্যসাথী নয়, সাম্প্রতিক অতীতে অতিমারি কোভিড মোকাবিলাতেও পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মধ্যে নজির তৈরি করেছে। নিজের জীবন বিপন্ন করে মুখ্যমন্ত্রী পথে নেমেছেন মানুষকে সচেতন করতে, রাজ্যের কোটি কোটি মানুষকে রক্ষা করতে।
বাজেটেও এই সরকার স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বহুলাংশে বাড়িয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ১১ থেকে পৌঁছেছে ৩৭-এ। ৪২টি নতুন সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে রাজ্যে। সরকারি হাসপাতালে শয্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার। ৪৭টি ট্রমা কেয়ার ইউনিট চালু হয়েছে। ১১৭টি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালে নার্সিং স্টাফ ৩৩,৮৩১ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৯,১১৩। মাতৃমা পোর্টালের মাধ্যমে সন্তানসম্ভবা প্রসূতি ও শিশুদের স্বাস্থ্যর নিয়মিত মনিটরিং চলছে জোরকদমে। প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ছানি অপারেশন ও ৩০ লক্ষের কাছাকাছি চশমা প্রদান করা হয়েছে। আশাকর্মীর সংখ্যাও উল্লেখজনক ভাবে বেড়েছে।
হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স ইংরেজিতে খুবই চালু কথা। যদিও স্বর্গ আর নরককে জানতে আলাদাভাবে পরলোকে পাড়ি জমাতে হয় না। ইহলোকে বসেই দিব্যি স্বর্গ-নরকের অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। এই যেমন আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে প্রায় ৩০ বছর ছিল এমনই এক স্বর্গরাজ্য। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিল্প থেকে নাগরিক পরিষেবা— সবেতে চ্যাম্পিয়ন। দেশের মধ্যে অগ্রণী রাজ্য।
আরও পড়ুন-রাজ্যের মামলা ডিভিশন বেঞ্চে
অথচ সেই রাজ্যটাই কিনা ছিবড়ে হয়ে উঠেছিল বন্ধ্যা বাম জমানায়। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ নিঃসন্দেহে আমাদের প্রেক্ষিতে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ। নামেই তারা কমিউনিস্ট। মুখে আওড়াচ্ছেন দাস ক্যাপিটাল। কাজে ক্যাপিটালিজমের কেরামতি। হাতে বিড়ি, পকেটে ফাইভ ফিফটি ফাইভ গোছের হিপোক্রিটদের হাত ধরে সোনার পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ সর্বক্ষেত্রে পিছোতে আরম্ভ করে। কলকারখানায় শ্রমিক আন্দোলনের নামে লাল পতাকা ঝুলিয়ে লকআউট করে সেসব জমি বেচে দেওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হয়। যথারীতি মালিকের হাত শক্ত করে সমৃদ্ধ হয় ইউনিয়ন লিডারের ধ্বজাধারী কমরেডরা। ভেসে যায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের পরিবার। কেউ আত্মঘাতী হয়, কারও হাল হয় না-মানুষ-এর।
কলকারখানা তথা শিল্প ধ্বংস করে বাংলা তথা বাঙালির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার হাত বাড়ায় জরুরি পরিষেবার দুটি হাত স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার পরিসরে। সরকারি হাসপাতালে রোগী আর কুকুরের সহবাস হয়ে ওঠে নিত্য রেওয়াজ। সদ্য জন্মানো শিশুকে মুখে করে নিয়ে গেল কুকুর সংক্রান্ত শিরোনাম সামনে আসতে থাকে। প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দিয়ে বাঙালির সামান্যটুকু ডানা মেলার সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া হয় সুপরিকল্পিতভাবে। একটা জাতিকে কার্যত আর্থিক, সামাজিকভাবে নপুংসক করে তোলার সেই চেনা চিনা পলিসি। মেড ইন চায়নার বঙ্গজ বাম সংস্করণ। তাত্ত্বিক নেতাদের সমাজ বদল আর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মেকি আওয়াজে প্রলেতারিয়েত উলুখাগড়া সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
সবকিছুরই একটা শেষ আছে। প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ পরাধীনতা থেকে যেমন দেশবাসী মুক্তি পেয়েছিল, এই বাংলায় তেমনই মুক্তির জিয়নকাঠি হয়ে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্যই সহজ ছিল না সে পথ। সিপিএমের হার্মাদ,পৈশাচিক স্তালিনিস্ত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে অবশেষে আরও এক স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন মমতা। দীর্ঘ রোগভোগের পর সেরে উঠতে সময় লাগে ঠিকই। কিন্তু সঠিক লালন-পালন, মমত্ব এবং পরিচর্যায় আজ আমাদের রাজ্যও অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক পরিসংখ্যান সেই চিত্র বহন করছে। স্বাস্থ্যেও আজ দেশের অন্যতম সেরা হয়ে উঠেছে বাংলা। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে সেই সুনাম।