অধূমপায়ীদের ফুসফুস ক্যানসার

ছিটোফোঁটা ধূমপান না করেও ফুসফুসে ক্যানসার! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। গবেষণা অনুযায়ী পৃথিবী জুড়ে তথা ভারতেও অধূমপায়ীদের মধ্যেও দিনে দিনে বাড়ছে ফুসফুস ক্যানসার। যার পরিসংখ্যান প্রায় ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ হল একটি বিশেষ বিষাক্ত গ্যাস যার নাম ‘রেডন’। এ-ছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু প্রাকৃতিক কারণ। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ফুসফুস ক্যানসার! শুনলেই একটাই কথা মাথায় আসে, আর তা হল ধূমপান। সিগারেট খেয়ে খেয়ে পাঁজরাকে ঝাঁজরা করে দিয়েছে— এই কথাটা আমরা হরদম বলে থাকি। আগে শুধু পুরুষেরাই ধূমপান করতেন এখন পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়েরাও হয়ে উঠেছে বেশ পাকা ধূমপায়িনী। ফলে উভয়সঙ্কট। এখন মেয়েদের মধ্যেও সমানতালেই দেখা দিচ্ছে ফুসফুস ক্যানসার। কিন্তু অনেকেই হয়তো এটা জানেন না যে প্রায় ২০%-এর বেশি যাঁরা ফুসফুস ক্যানসার রোগী কখনও ধূমপান করেননি বা গোটা জীবনে ১০০টিরও কম সিগারেট খেয়েছেন। তাহলে বিড়ি, সিগারেটের অভ্যেস না থাকা সত্ত্বেও ফুসফুসে ক্যানসার! কীভাবে সম্ভব?
এমনটা কীভাবে সম্ভব সেটা জানতেই গবেষণা শুরু হয়েছিল আমেরিকাতে তার সাম্প্রতিকতম ফল দেখে চমকে উঠেছেন অনেকেই। দেখা গেছে বর্ণহীন, গন্ধহীন একটি গ্যাসের প্রভাব অধূমপায়ীদের মধ্যেও এই মারণক্যানসার ডেকে আনছে। এই গ্যাসটি তৈরি হয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণই কিন্তু ক্যানসারের অন্যতম কারণগুলোর একটি। আর সেই গ্যাসটির নাম ‘রেডন’। যা ফুসফুস ক্যানসারের দ্বিতীয় প্রধান কারণ।
ভয়ের বিষয় হল এই গ্যাসটি থাকে আমাদের বাড়ি ঘরদোরের খুব কাছেই, মাটির নিচে। যার জেরে ফুসফুস ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিনমুলুকে ইতিমধ্যেই রেডন গ্যাস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেই কারণে আমেরিকা-সহ আরও বেশকিছু দেশেই জানুয়ারি মাসে পালিত হয় রেডন অ্যাকশন মান্থ। কিন্তু শুধু মার্কিনমুলুকেই নয় সাম্প্রতিক সমীক্ষা এটাও বলছে ভারতবর্ষেও বাড়ছে অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব। যার অন্যতম কারণ হল এই রেডন গ্যাস। এ ছাড়া আরও বেশকিছু প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে যেমন ডিজেল নিষ্কাশন, অ্যাসবেসটস, সার্বিক বায়ুদূষণ ইত্যাদি।
প্রাকৃতিকভাবে তৈরি রেডন গ্যাস একধরনের তেজস্ক্রিয় গ্যাস যা বাড়ির নিচে পাওয়া যায়। মূলত বাড়ির বেসমেন্টে পাওয়া যায় বলা যেতে পারে। আর বর্ণ, গন্ধ কিছুই নেই বলে এই গ্যাসের টিকি মেলা ভার। ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। কতটা রয়েছে তা বোঝার উপায় থাকে না এবং ধীরে ধীরে তা ফুসফুসকে প্রভাবিত করতে থাকে। অধূমপায়ীদের মধ্যে যে ধরনের ফুসফুসের ক্যানসার খুব কমন তা হল অ্যাডিনোকার্সিনোমা। যা ব্রঙ্কিওল থেকেই শুরু হয় একটা ছোট শ্বাসনালি, এটি ফুসফুসের বাইরের দিকে বাড়ে। এই ব্রঙ্কিওলগুলোই শ্লেষ্মা তৈরি করে।

আরও পড়ুন-বারাকপুরে শপিংমল ও রেস্তোরাঁয় আগুন

উপসর্গ
ক্রমাগত কাশি যা বাড়তে বাড়তে ক্রমশ খারাপ হতে থাকে।
কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া। কফের রং মরচের মতো হয়।
শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া।
ঘ্রাণ নিতে এবং পেতে সমস্যা।
কর্কশতা।
খিদে কমে যাওয়া।
কারণ ছাড়াই ওজন কমতে থাকা।
খুব ক্লান্তি।
গিলতে অসুবিধা হওয়া।
ঘাড় বা মুখে ফোলা।
নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য পুনরাবৃত্ত ফুসফুসের অসুস্থতা।
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা।
অধূমপায়ী বা যাঁরা ধূমপান খুব কম করেছেন তাঁদের ক্ষেত্রে ক্যানসারের বাড়বৃদ্ধি খুব ধীরে হয়। এক্ষেত্রে অপারেশনও অনেক সময়ই সফল হয়। রোগীর বেঁচে যাবার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি থাকে। অধূমপায়ীদের ফুসফুসের ক্যানসার অন্য অঙ্গে ছড়ায় না অর্থাৎ মেটাস্টেসিস পর্যায়ে যেতে খুব কম দেখা যায়। ধূমপান করেন না এমন ব্যক্তির ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য ৫০-৬০ শতাংশ দায়ী আডিনোকার্সিনোমা। ১০ থেকে ২০ শতাংশ দায়ী স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা।

আরও পড়ুন-পড়তে হবে না হ্যারিকেনে, ছাত্রীর বাড়িতে বিদ্যুৎ সায়ন্তিকার উদ্যোগে

আক্রান্ত আট থেকে আশি
সমীক্ষা অনুযায়ী রেডন গ্যাসের প্রকোপে বছরে প্রায় ২১ হাজার অধূমপায়ীর ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটে। এর ফলে বায়ুদূষণ ঘটে মারাত্মক আকারে। বায়ুদূষণের এ ছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে যেমন দূষিত বায়ুতে নানা ধরনের ধূলিকণা থাকে, তা ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর। কারখানা ও বিভিন্ন গাড়িতে ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানির অংশ থেকে যায় বাতাসে আর তা শ্বাসের সঙ্গে গিয়ে ঢোকে শরীরে। এরই পাশাপাশি থাকে কাঠের উনুন জ্বালানো কিংবা গাছ পোড়ানোর জেরে তৈরি হওয়া দূষণ। এই সবকিছুর মধ্যে বেশি ক্ষতি করে গাড়ির ধোঁয়া। তাতে অ্যাসিড, মাটি, রাসায়নিক পদার্থের কণা বেশি থাকে। এই পার্টিকল খুবই ছোট হয়, ফলে আলাদা করে দেখতে পাওয়া যায় না। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (হু) দেখিয়েছিল, বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকা এ-সব দূষিত পদার্থ প্রতি বছর বহু মানুষের ক্যানসারের কারণ হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে চিনে এক ৮ বছরের শিশু ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তা যে ধূমপান থেকে হয়নি তার প্রমাণও মিলেছে। অর্থাৎ বায়ুদূষণের জেরে আট থেকে আশির ফুসফুসের ক্যানসার বাড়ছে। শিশুদেরও ছাড়ছে না। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। ‘হু’র রিপোর্ট বলছে, ডায়াবেটিস কিংবা হার্টের রোগ যাঁদের আছে, তাঁদের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি দেখা যাচ্ছে। আর আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরাই যাঁরা নিয়মিত বাইরে কাজ করেন কিংবা খোলা জায়গায় শরীরচর্চা করে থাকেন।
তবে একটা আশার আলো যে ধূমপায়ী নন, এমন ফুসফুসের ক্যানসার রোগীকে অন্তত পক্ষে আংশিক রোগমুক্ত রাখতে ইতিমধ্যেই সফল হয়েছেন কলকাতা-সহ দেশের বেশ কয়েক দল ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ। শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের ওপর ভর করেই মেডিক্যাল কলেজের দুই রোগীকে সুস্থ করে তুলেছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা এমন উদাহরণও রয়েছে।

আরও পড়ুন-জিনাতের খোঁজেই বাংলায়! না পেয়ে ফিরে গেল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার

অধূমপায়ীরা ফুসফুস ক্যানসার এড়াবেন কীভাবে?
রেডন গ্যাসের নিয়মিত পরীক্ষা এবং এই বিকিরণ কমানোর প্রচেষ্টা করা। এছাড়া অ্যাসবেসটস ও বায়ু দূষণকারী অন্যন্য ক্ষতিকারক বস্তুর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা।
পরোক্ষ ধূমপান বা যাকে বলে সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিং থেকে দূরে থাকা অর্থাৎ অন্য কেউ ধূমপান করছেন সেই ধোঁয়াটা না নেওয়া। কর্মক্ষেত্রে এবং পাবলিক স্পেসে ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ গঠন।
সুষম আহার যেমন প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট নেই এমন খাবার নিয়মিত খান, রোজ ব্যায়াম, যোগাসন, প্রাণায়াম করুন এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।

Latest article