বিনোদিনী একটি নটীর উপাখ্যান

বাংলা রঙ্গমঞ্চের কিংবদন্তি অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী। প্রয়াণের কয়েক দশক পরেও যিনি প্রাসঙ্গিক। নটী বিনোদিনীর আখ্যান নিয়ে গতকাল বড়পর্দায় মুক্তি পেয়েছে রামকমল মুখোপাধ্যায়ের বহুচর্চিত ছবি ‘বিনোদিনী-একটি নটীর উপাখ্যান’। মুখ্য ভূমিকায় রুক্মিণী মৈত্র। ইতিমধ্যেই প্রশংসিত তাঁর অভিনয়। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

‘চৈতন্যলীলা’ নাটক দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ। চৈতন্যের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছিলেন তাঁকে বলেছিলেন, ‘চৈতন্য হোক’। মঞ্চের সেই ‘চৈতন্য’কে রামকৃষ্ণ প্রথমে পুরুষ বলে ভুল করেছিলেন। পরে জানতে পারেন, অভিনয় করেছেন বছর বাইশের এক তরুণী। লোকমুখে, ইতিহাসের পাতায়, বাঙালির মনে ও মননে মিলেমিশে সেই ঘটনা আজও জীবন্ত! স্বয়ং অভিনেত্রীও তাঁর আত্মজীবনীতে এই ঘটনার উল্লেখ করে গেছেন। সেইসব আখ্যান নিয়েই পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছেন ‘বিনোদিনী- একটি নটীর উপাখ্যান’। বিগত ৫ বছর যাবৎ বহু বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হয়েছিল ছবিটি। ধৈর্য হারাননি পরিচালক। অবশেষে বিনোদিনী থিয়েটারেই বিনোদিনী সিনেমার মুক্তি। নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

‘বিনোদিনী-একটি নটীর উপাখ্যান’-এর গল্প শুরু হয় কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের পতিতা বস্তি থেকে। পতিতালয়ের ১৪৫ নং বাড়ির মেয়ে পুঁটি অর্থাৎ ছোট্ট বিনোদিনীর ছিল দু’বেলা খেতে না পাওয়া এক করুণ জীবন। কিন্তু একইসঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল নাচ, গান, থিয়েটারের প্রতি অসম্ভব টান। আচমকাই একদিন গিরিশ ঘোষের নজরে পড়ল পুঁটি। ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকল তাঁর জীবন। স্বল্প সময়ে পুঁটি হয়ে উঠলেন বিনোদিনী, রঙ্গমঞ্চের রানি। বিনোদিনীর আগুনে পুড়তে থাকল কলকাতার বাবু সমাজ। কিন্তু খুবই স্বল্প সে পরিসর। একটা সময় কাছের মানুষগুলোর বঞ্চনা আর প্রতারণার শিকার হয়ে, হয়তো বা অভিমানেই, চিরতরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অভিনয়ের দুনিয়া থেকে। সেই বিনোদিনী দাসীর অভিনয়, প্রেম, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, প্রতারণা, যন্ত্রণায় দগ্ধ জীবনকাহিনি দিয়ে সাজানো হয়েছে চিত্রনাট্য।

ছবিতে বিনোদিনী চরিত্রে রুক্মিণী মৈত্র। এই ছবি পুরোটাই তাঁর। অসাধারণ অভিনয় গুণে রুক্মিণী ধীরে ধীরে বিনোদিনী হয়ে উঠেছেন। পাঁচ বছর যাবৎ তিনি যে চরিত্রটাকে নিজের ভিতর লালন করেছেন, যাপন করছেন, ছবি দেখতে বসলেই তা বোঝা যায়। বিনোদিনী হয়ে ওঠার পথটা সহজ ছিল না। সিনেমার প্রথম ভাগে বিনোদিনী বা বিনি যতটা সহজ, দ্বিতীয় ভাগে ততটাই দৃপ্ত হয়ে উঠেছেন। চরিত্রের ওঠাপড়া, রূপান্তর রুক্মিণী ফুটিয়ে তুলেছেন দুরন্ত দক্ষতার সঙ্গে। কখনও ভেঙেছেন, কখনও অঝোরে কেঁদেছেন, কখনও হেসেছেন।
এক সাক্ষাৎকারে রুক্মিণী জানিয়েছেন, ‘‘বিনোদিনী চরিত্রটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। এমন সুযোগ পাওয়া ঈশ্বরের লিখন। ভগবান সব কিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখেন। তাই আমার মনে হয়, বিনোদিনীকে আমি বেছে নিইনি, উনি নিজেই আমাকে বেছে নিয়েছেন। ২০১৯ সালে রাম যখন আমার সঙ্গে মুম্বই থেকে যোগাযোগ করে এবং বলে যে সে বিনোদিনী করতে চায়, সেটাও আমাকে নিয়ে, শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। কিন্তু আমার সাহস ছিল। আর এমন একটা চরিত্র ফিরিয়ে দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।’’
রুক্মিণীর অভিনয় দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাঁর অনুরাগীরা। এমনকী, ফিল্ম সমালোচকরাও বিনোদিনী রূপে রুক্মিণীকে দেখে উচ্ছ্বসিত।

ছবির গানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। প্রতিটি গান অনবদ্য। ছবির সুরকার সৌমেন্দ্র-সৌম্যজিৎ। গানের সঙ্গে আবহও ছবিতে আলাদা মাত্রা এনেছে। ‘হরি মন মজায়ে লুকালে কোথা…’ গানটি শুনলে এক অন্য অনুভূতি তৈরি হয়। ‘কানহা’ বা ‘আজই বরিষ রাতে’ গান দুটিও অসাধারণ।
এই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাংলা ছবি পরিচালনা করলেন রামকমল মুখোপাধ্যায়। বিনোদিনী প্রসঙ্গে পরিচালক জানালেন, ‘‘নারীকেন্দ্রিক ছবি করতে চেয়েছিলাম। এমন একটা ছবি যা বহুকাল দর্শকের মনে থেকে যাবে। জটিল নয়, পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবি এটা।’’ কেন বিনোদিনী হিসেবে রুক্মিণীকেই বেছে নিলেন সেই প্রসঙ্গে পরিচালক জানান, ‘‘প্রথমদিন থেকে রুক্মিণীকেই চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল চরিত্রটা ও বুঝতে পারবে। অভিনেত্রী হিসেবে নিজের একশো শতাংশ দিয়েছে। সুদীপ্তা চক্রবর্তী এবং ভাস্কর সেনগুপ্তর কাছে ওয়ার্কশপও করেছে। তার প্রতিফলন দর্শক পর্দায় দেখছেন।’’

রুক্মিণী ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল বোস, ওম সাহানি, মীর আফসার আলি, গৌতম হালদার, চান্দ্রেয়ী ঘোষ প্রমুখ। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় প্রত্যাশিত। রাঙাবাবু চরিত্রে রাহুল বোস, কুমার বাহাদুরের চরিত্রে ওম সাহানি দারুণ। রুক্মিণীর সঙ্গে কুমার বাহাদুরের রসায়ন বেশ ভাল লাগে। গুরমুখ রায়ের চরিত্রে মীর, গোলাপের চরিত্রে চান্দ্রেয়ী ঘোষের অভিনয় মনে থেকে যাবে। অন্যদিকে চন্দন রায় সান্যাল, গৌতম হালদার অনবদ্য। প্রত্যেকে নিজের সেরাটা দিয়েছেন। এই ছবির জোরালো সম্পদ হল সংলাপ। চিত্রনাট্য, সংলাপ লিখেছেন পরিচালক স্বয়ং। নিজের বাড়িতে বাড়িতে বিনোদিনীর প্রত্যাবর্তন অজান্তেই চোখ ভিজিয়ে দেবে। প্রমোদ ফিল্মস এবং দেব এন্টারটেইনমেন্ট ভেঞ্চার-এর ব্যানারে তৈরি এই ছবির প্রযোজনা করেছেন প্রতীক চক্রবর্তী এবং দেব। ক্যামেরায় সৌমিক হালদার, সম্পাদনায় প্রণয় দাশগুপ্ত।

Latest article