শিশুকন্যা দিবস

কুমারী রূপে, দেবী রূপে পূজ্যা হয়েও প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এদেশের মেয়েরা। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও কন্যাভ্রূণ হত্যা ও কন্যাশিশু হত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাদের সমানাধিকার নিয়ে বার বার উঠেছে প্রশ্নচিহ্ন। এর বিরুদ্ধে সতর্কতা এবং সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি পালিত হয় জাতীয় শিশুকন্যা দিবস। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য কন্যাদের লিঙ্গ সাম্যতা, সমান সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী ক্ষমতায়ন। এই উপলক্ষে গতকাল দেশজুড়ে পালিত হল দিনটি। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

জামলো মাকদাম। ছত্তিশগড়ের বিজাপুরের ১২ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে। পাড়ার কয়েকজন মহিলার সঙ্গে তেলেঙ্গানায় গিয়েছিল লঙ্কার খেতে কাজ করবে বলে। জামলোর গ্রাম থেকে সেই জায়গার দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। সারাদিন অক্লান্তভাবে খেতমজুরি করত জামলো। এর ঠিক কিছুদিন পরেই কোভিড অতিমারির কারণে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। তখন পরিবহণ-ব্যবস্থা প্রায় স্তব্ধ। কঠিন সেই পরিস্থিতি। অভিবাসী শ্রমিকদের করুণ অবস্থা। রুজি রোজগার বন্ধ হল। এবার কী উপায়। বিদেশ বিভুঁইয়ে না রইল উপার্জন, না রইল মাথার ওপর ছাদ। উপায়ান্তর না দেখে অভিবাসী শ্রমিকরা দলকে-দল পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়ল বাড়ির পথে। সেই অস্থির পরিস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেইসময়। তখন সেইসব শ্রমিকের দেখাদেখি ওই মহিলা দলটিও পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। এপ্রিল মাসে ওই মহিলা খেতমজুরদের সঙ্গে জামলোও হেঁটে হেঁটেই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিল। প্রায় ১০০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছিল সে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বাড়ি থেকে ৫০ কিমি দূরে ছত্তিশগড়ের এক গ্রামের কাছে পৌঁছে জামলো অসুস্থ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা, ছাতিফাটা জলের কষ্ট, ডিহাইড্রেশনে মৃত্যু হয় তার। চিকিৎসকেরা জামলোর মৃত্যুর কারণ এটাই বলেছিলেন।

আরও পড়ুন-মাইকেলের জীবনে রমণীরা

ঠিক কতটা দারিদ্র গ্রাস করলে ১২ বছরের একটি মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শ্রমিক হয়ে যেতে হয় সেটা বোধহয় আমাদের অনেকেরই জানা নেই। পরিবার থেকে অত দূরে সেই কাজের জায়গায় সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে তার শরীর, মনে কী প্রভাব পড়ত তাও কেউ জানে না। আমরা শুধু এইটুকু জেনেছি ১২ বছরের জামলো বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছিল। তার পৌঁছনো হয়নি। সে হারিয়ে গেছে।
জাতীয় শিশুকন্যা দিবস শুনলেই মনে পড়ে যায় এমন কিছু ঘটনা আর মন অস্থির হয় এদেশের তথা বিশ্বের শিশুকন্যা এবং মেয়েদের সুরক্ষা ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। কারণ বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১৬০ মিলিয়ন শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। শুধু সেটাই শেষ নয়, এই শিশুরা প্রত্যেকে নোংরা, বিপজ্জনক, অবমাননাকর কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি ভারতে প্রতি ১০ জনের ১ জন শিশু শ্রমিক। আর সমীক্ষা অনুযায়ী এইসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কন্যা শিশু শ্রমিকেরা। কাজেই শিশুকন্যার সুরক্ষার প্রশ্নে, সমানাধিকারের প্রশ্নে, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশ্নে স্বস্তিজনক উত্তর খুব একটা নেই। তাই জাতীয় শিশুকন্যা দিবস নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কেন্দ্রকে তুলোধনা অভিষেকের

এ তো গেল শিশু শ্রম বা শিশুকন্যার শ্রমের বিষয়— এই তো সদ্য দু’মাস আগের ঘটনা। এক আন্তঃরাজ্য শিশুপাচার চক্রের হদিশ পেয়েছিল রাজ্য প্রশাসন। গয়া থেকে দু’দিন বয়সের এক শিশুকন্যাকে চুরি করে এনে এই রাজ্যে পাচারের চেষ্টা করছিল এক ধাপ্পাবাজ দম্পতি সাধন আর গীতা (নাম বদলে)। পুলিশ আধিকারিকরা নিঃসন্তান দম্পতি সেজে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুরন্ত এক্সপ্রেস থেকে শালিমার স্টেশনে এসে নেমেছিল সেই দম্পতি আর তারপরেই হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল পুলিশের হাতে। ভারতে শিশুপাচার তথা শিশুকন্যা পাচারের পরিসংখ্যান লক্ষণীয়। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৮ মিনিটে একটি করে শিশু পাচার হয় যার মধ্যে শিশুকন্যাও রয়েছে। দেশ তথা রাজ্যে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে নাবালিকা মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়ার কথা আকছার শোনা যায়। এহেন পাচার হয়ে যাওয়া কন্যার জায়গা হয়েছে পতিতালয়ে এমন উদাহরণও ভূরি ভূরি। পরবর্তীকালে সেই মেয়েটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, তাকে পুলিশ-প্রশাসন বাড়ি ফিরিয়ে দিলেও মেয়েটির আর কখনও সামাজিকভাবে মূলস্রোতে ফেরা হয় না। বাড়ির লোক তাকে গ্রহণ করতে চায় না সমাজে একঘরে হওয়ার ভয়ে। আসলে এগুলো বলার উদ্দেশ্য হল এটাই বোঝানো যে, দিন বদল হলেও আমাদের সামাজিক ধ্যান-ধারণা এখনও এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।

আরও পড়ুন-নেতাজির পথ ওদের রাস্তা নয়

এরপর আসি বাল্যবিবাহের প্রসঙ্গে। আজ থেকে ১৬৮ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বিধবা বিবাহ আইন’ ব্রিটিশ সরকারকে দিয়ে পাশ করাতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর এমন উদ্যোগটি নেওয়ার অনেক কারণের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল সেইসময় বাংলায় নাবালিকার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার অন্যায় রীতি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল সেই বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে আজও মুক্ত হয়নি এই রাজ্য তথা সমগ্র দেশ। এই তো কিছুদিন আগেই এক নাবালিকার জোর করে বিয়ে আটকাল রাজ্য পুলিশ। ঘটনাটা ঘটেছিল বোলপুরে। এনআরবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে বাল্যবিবাহ ক্রমবর্ধমান এক সমস্যা। বিগত পাঁচবছরে বাল্যবিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইনের অন্তর্ভুক্ত মামলার সংখ্যা একলাফে বেশ অনেকটা বেড়ে গেছে। গোটা ভারতের নিরিখে অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের হার জাতীয় গড় থেকে বেশি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে থেকেই এই বাল্যবিবাহ ও স্কুল ড্রপ আউট রুখতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি রাজ্যে ১৩-১৮ বছর বয়সি স্কুলছাত্রীদের জন্য ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প শুরু করেন।
সেখানে ১৮ বছর বয়স হলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অবিবাহিত মেয়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তার আগে বছরে হাজার টাকা করে দেওয়া হয় ছাত্রীদের। এই ‘ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার’ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল মেয়েদের স্কুলছুট ও অপরিণত বয়সে বিয়ে আটকানো। যার ফলে অনেকটাই রোখা গেছে বাল্যবিবাহ। স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর পরিসংখ্যান কমেছে অনেকটাই তবে গোটা দেশের নিরিখে সার্বিক ফল আশানুরূপ নয়।
২০০৬ সালে প্রহিবিশন অফ চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট প্রণিত হয়। এই আইন অনুযায়ী ১৮র কমবয়সি মেয়ে এবং ২১ বছরের কমবয়সি ছেলের বিয়ে নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ জুড়ে বাল্যবিবাহের এই বাড়বাড়ন্ত।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে স্কুলছুট ছাত্রীদের পরিসংখ্যান খুব বেশি না বাড়লেও উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে এই পরিসংখ্যান অনেকটাই বেশি প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ জাতীয় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্কিম আদৌ কি দেশের সর্বস্তরের মেয়েদের মুখে হাসি ফেরাতে পেরেছে? বাস্তব চিত্র কতটা সফল?
প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ভারতে পালিত হয় জাতীয় শিশুকন্যা দিবস। ভারতীয় সমাজে যাতে শিশুকন্যা, মেয়েরা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হয়, সেই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম ভারত সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক দিনটি উদযাপন শুরু করে। এই দিনটি আমাদের মনে করায় নাবালিকার জীবনের, শরীরের, মনের অধিকারের কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতবর্ষের মতো দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল লিঙ্গবৈষম্য। সবকিছুর শিকড় লুকিয়ে রয়েছে ওই লিঙ্গবৈষম্যের মধ্যেই। ভারতীয় সমাজে মেয়েরা চিরকাল এই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার। সেই বৈষম্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং কন্যা ও শিশুর অধিকার, মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মেয়েদের আইনি অধিকার, জীবনধারণের অধিকার, জীবন যাপনের অধিকারের লক্ষ্যে এই দিনটির গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিবছরের মতো এই বছরেও নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে পালিত হল জাতীয় শিশুকন্যা দিবস। প্রতিবছর এই দিনটির একটা থিম থাকে। এই বছর জাতীয় শিশুকন্যা দিবসের থিম ছিল ‘এমপাওয়ারিং গালর্স ফর এ ব্রাইট ফিউচার’ (Empowering Girls for a Bright Future)। অর্থাৎ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যপূরণে মেয়েদের ক্ষমতায়ন। প্রতিবছর এই দিনে মেয়েদের ক্ষমতায়নের বার্তা ছড়িয়ে দিতে সারা দেশে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই দিনটায় নেওয়া অনেক কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম হল লিঙ্গসাম্যতা, ছেলে-মেয়ে সমান সুযোগ-সুবিধা এবং সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার, অধিকার, পুষ্টির ও যত্নের অধিকার মেয়েদের প্রতি অহিংসতার মনোভাব, বৈষম্য, দূরীকরণ সংক্রান্ত নানা কিছু। কারণ মেয়েদের অবদান ও ভূমিকা এই সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে শিশুকন্যা জন্মের হার উল্লেখনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির উন্নয়নের নিরিখে তারা আজও শিশুপুত্রের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আংশিক বন্ধ উড়ালপুল

যে দেশে শিশুকন্যাকে পুজো করা হয় মাতৃরূপে, যেখানে নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্য, সেই দেশে আজও শিশুকন্যা তথা মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের চিত্রটা বেশ হতাশাব্যঞ্জকই। শহুরে সংস্কৃতি দিয়ে যার বিচার করলে ভুল হবে কারণ ভারতবর্ষের প্রাণভোমরা হল গ্রাম, গ্রামাঞ্চল। তাই বছর বছর যখন জাতীয় শিশুকন্যা দিবসটি ফিরে আসে তখন এই প্রশ্নগুলোই মাথার মধ্যে উঁকি দিতে থাকে। শিশুকন্যা দিবস শুনলে এটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে সরকার এই দেশের মেয়েদের জন্য আলাদা করে চিন্তাভাবনা করছেন, তাদের সার্বিক উন্নতির দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। কিন্তু সেটা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে? কারণ কন্যাভ্রুণ হত্যা, শিশুকন্যা পাচার, নাবালিকার বিয়ে, শিশু শ্রমের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় এগুলো দিনে দিনে বেড়ে চলেছে সুতরাং জাতীয় শিশুকন্যা দিবস নিয়ে আলোচনা করতে হলে, এই দিনটি যথাযথভাবে পালন করতে হলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আরও গভীরে ভাবনাচিন্তার দরকার রয়েছে। কারণ কোনও বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে একটা দিন পালনই যথেষ্ট নয়। বহু বছরের প্রোথিত হয়ে থাকা ধ্যানধারণা, চলে আসা নিয়ম রীতি মানুষের মন এবং মানসিকতার রাতারাতি বদল সম্ভব নয়। সেই বদল ঘটাতে হলে প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা করে যেতে হবে। শিশুকন্যার সার্বিক সুরক্ষার জন্য প্রত্যেককে একজোট হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মেয়েরা যাতে তাদের জন্মলগ্ন থেকেই সমাজের সমর্থন, সুবিচার পায় সেই লক্ষ্যে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাওয়াটাই জাতীয় শিশুকন্যা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য। আর সেখানেই সার্থক হয়ে উঠবে জাতীয় শিশুকন্যা দিবস।

Latest article