ওঁ ঘণ্টা-শূল-হলানি শঙ্খ-মুসলে চক্রং ধনুঃ সায়কং
হস্তাজৈদধতীং ঘনান্তবিলসচ্ছীতাংশুতুল্যপ্রভাম্।
গৌরীদেহসমুদ্ভবাং ত্রিজগতামাধারভূতাং মহা-পূর্বামত্র সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যাদিনীম্।।
নিজ করকমলে যিনি ঘণ্টা, শূল, লাঙল, শঙ্খ, মুষল, চক্র, ধনুক ও বাণ ধারণ করেন; শারদীয়া চন্দ্রের শোভাসম্পন্ন যাঁর মনোহর কান্তি; যিনি ত্রিলোকের আধারভূতা এবং শুম্ভাদি দৈত্যনাশিনী, গৌরীদেহসমুদ্ভূতা সেই অপূর্বা মহাসরস্বতীর (saraswati) আমি ধ্যান করি।
সৃষ্টির শুরু যে একক বিন্দু থেকে সেই একককে মাতৃরূপ ধারণা করা হয়েছে। সেই সৃষ্টিলগ্নে নির্গুণা পরমা প্রকৃতি ত্রিধা হলেন সত্ত্বগুণসম্পন্না সরস্বতী, রজগুণে মহালক্ষ্মী আর তমগুণে মহাকালী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে এভাবেই বর্ণনা রয়েছে মহাসরস্বতীর।
বসন্ত আওল রে
রং ছাড়া এই আটহাতি সরস্বতী আমাদের অচেনা। আমাদের চেনা সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী। ইনি বিদ্যার দেবী, হাঁস বাহন। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পুজো হয় মাঘী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে। এই পুজো যেহেতু কচিকাঁচাদের প্রাণের পুজো তাই আয়োজন খুব সাধারণ। সরস্বতী (saraswati) পুজোর বিশেষ গুণ এখানে জাতিভেদ নেই। বিদ্যালয়ে হিন্দু ছাত্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলপনা দেয় মুসলমান ছাত্রী। হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্যান্ডেল সাজায় অন্য ধর্মের ছেলেরা। আসলে জ্ঞানের জাত হয় না। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই, প্রসাদে তাই কুল পাওয়ার চাহিদা থাকবেই। কুল-রক্ষার এক সুন্দর নিয়ম। পুজোয় লাগবে দোয়াত, কালি, আমের মুকুল, পলাশ, কুন্দ, শ্বেতচন্দন, হলুদ গাঁদা। উপকরণ জানায় শীতের রুক্ষতার অবসান, বসন্ত সমাগত। সরস্বতী পুজোর দিন ফ্রক-বালিকার অপটু হাতে পরা হলুদ শাড়ি আর সদ্য স্নানের পর চুল থেকে পড়া জলের ফোঁটা কত সদ্য গোঁফ গজানো সাইকেল-কিশোরের হার্টের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াত এক সময়। গত শতাব্দীর মানুষজন আজও জানে সরস্বতী পুজো বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে।
নিচে থাকার অভিশাপ
ভারত ও চিনের সীমান্তে উত্তরাখণ্ডের শেষ গ্রাম কিংবা আধুনিক মতে ভারতের প্রথম গ্রাম মানাতে গেলে দেখা যায় সরস্বতী নদীকে। মানা থেকে বদ্রীনাথ পর্যন্ত মাত্র ৫ কিলোমিটার এই নদী তীব্র শব্দে এবং গতিতে পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখান থেকে সরস্বতী অলকানন্দা নদীর সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
আবার এলাহাবাদে প্রয়াগে তিন নদীর সঙ্গম। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী। গঙ্গা-যমুনার জলপ্রবাহ আলাদা করে দেখা গেলেও সরস্বতী অন্তর্লীনা।
পুরাণ মতে, গণেশ সরস্বতী নদীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন তাই সরস্বতী অন্তঃসলিলা হয়ে গিয়েছিল। সরস্বতী নদী সম্পর্কে গণেশের অভিশাপের সেই কাহিনি বহু পূর্বেকার। ব্যাসদেব বর্ণিত শ্লোকগুলি গণেশ লিখছিলেন। তখন সরস্বতী নদী পূর্ণ বেগে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীর শব্দে লেখার অসুবিধা তো হবেই তাই, গণেশ নদীকে মৃদুভাবে প্রবাহিত হতে অনুরোধ করেন, কিন্তু সরস্বতী নিজের ছন্দ বিচ্যুত হতে নারাজ। এই আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে গণেশ সরস্বতী নদীকে অভিশাপ দেন এবং তার পর থেকেই সরস্বতী অন্তঃসলিলা। সরস্বতী নদী, ব্যাস গুহা, গণেশ গুহা মানা গ্রামের পর্যটক আকর্ষণ। নদীকে অন্তঃসলিলা হওয়ার অভিশাপ কি বেদ-পরবর্তী যুগ থেকেই নারীর অবদমনের ইতিহাসের সূচনা, গণই জানে।
এক যে ছিল নদী
বেদের যুগে সরস্বতী (saraswati) ছিল এক পবিত্র প্রবাহ। ঋষিরা সরস্বতীর জলে স্নান করে রচনা করতেন অপৌরুষেয় বেদের শ্লোকগুলি। সরস্বতীর তীরে হত সামগান, মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ। সরস্বতী সরসবতী করে রাখত মাটিকে। খাদ্যের প্রাচুর্য থাকলে মানুষ মন দিতে পারে অন্য সৃষ্টিতে। তাই সরস্বতী পরোক্ষভাবে জন্ম দিয়েছেন জ্ঞানের। তাই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা সরস্বতীকে বলেছেন আর্যা, ব্রাহ্মী, কামধেনু, বেদগর্ভা, ধীশ্বরী। সরস্বতী হিমালয়ে জন্ম নিয়ে পাঞ্জাব এলাকা দিয়ে প্রবেশ করেছিল আরব সাগরে। এক বিস্তীর্ণ এলাকাকে রসবতী করে সরস্বতী জন্ম দিয়েছিল জ্ঞানের। তাই নদী হয়ে উঠেছিল দেবী, মাতৃকা। ঋক বেদে রয়েছে গায়ত্রী ছন্দে সরস্বতী স্তুতি। পবিত্র অন্নরূপযজ্ঞবিশিষ্ট যজ্ঞফলরূপ ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী আমাদের অন্ন বিশিষ্ট যজ্ঞ কামনা করুন। সুনৃত বাক্যের উৎপাদয়িত্রী, সুমতি লোকেদের শিক্ষাদাত্রী সরস্বতী আমাদের যজ্ঞ গ্রহণ করেছেন। সরস্বতী প্রবাহিত হয়ে প্রচুর জল ফল দান করেছেন এবং জ্ঞান প্রদান করেছেন। স্তোত্রে সরস্বতীকে পাবকা বলা হয়েছে কারণ ইনি মানব হৃদয়ের পাপ নাশ করে মনকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ করেন। সরস্বতীর জল নির্মল ও পবিত্র। সরস্বতীকে বলা হয়েছে বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নবতী। সরস্বতীর জল সেচের সাহায্যে বিস্তীর্ণ এলাকাকে রসবতী করে তুলত। সরস্বতীকে ধিয়াবসুঃ বলা হয়েছে কারণ যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের ফল স্বরূপ ইনি সম্পদাদি বঞ্ছিত বস্তু প্রদান করেন। নদীর মাধ্যমে বাণিজ্য করে দেশ প্রভূত উন্নতি করতে পারে। এভাবে সরস্বতী বাঁচিয়ে রেখেছিল অতি প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা। বেদে সরস্বতীর প্রশস্তি করে বলা হয়েছে, অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী— জলের মধ্যে, নদীর মধ্যে, দেবীদের মধ্যে সরস্বতী শ্রেষ্ঠ। এক ভৌগোলিক অভিশাপে সরস্বতী হলেন বিলুপ্ত।
মহাবিদ্যা নীলাসরস্বতী
তিব্বত এবং ভারতের কিছু অংশে নীলাসরস্বতীকে কখনও কখনও মহাবিদ্যা তারার রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নীলাসরস্বতী প্রথাগত সরস্বতী থেকে খুব একটা পৃথক দেবী নন, যিনি তাঁর জ্ঞান এবং সৃজনশীল শক্তিকে তান্ত্রিক সাহিত্যে ব্যবহার করেন। যদিও সরস্বতীর ঐতিহ্যগত রূপটি শান্ত, মমতাময়ী এবং শান্তিপূর্ণ। নীলাসরস্বতী উগ্র রূপের প্রকাশ, সাধারণ সরস্বতী হল সৌম্য-শান্ত প্রকাশ। আরও অধিকাংশ অন্যান্য প্রকাশ রয়েছে। পূর্বের তান্ত্রিক সাহিত্যে নীলাসরস্বতীর ১০০ নাম আছে। তন্ত্রসারে তাঁর উপাসনার জন্য পৃথক ধ্যান শ্লোক এবং মন্ত্র রয়েছে। তিনি ভারতের কিছু অংশে, তবে বেশিরভাগই ভারতের বাইরে, দেবী তারার অবতার হিসাবে পূজিত হন। তিনি শুধু পূজিত হননি, দেবী সরস্বতীর রূপ হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছেন। সরস্বতী মহাবিদ্যা হিসাবে মাতঙ্গী রূপে পূজিতা।
আরও পড়ুন- বাংলায় এবার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি বাঘেদের! সামনে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য
কচ্ছপী
সরস্বতী বীণাপাণি অর্থাৎ হাতে তাঁর বীণা। মীড়-গমক-মূর্ছনার অনুরণনে সুর-লহরির আবেশময় রূপ শুধু বীণাযন্ত্রেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। বীণা আদি ও মৌলিক যন্ত্র। ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, কর্নাটকী সঙ্গীতে বীণার ব্যবহার অতি প্রাচীন। মৃদু অথচ মধুর সুরের একমাত্র যন্ত্র বীণা। দেবী সরস্বতীর সাধনায় মানুষের মধ্যে ঘটে জ্ঞানের প্রকাশ। অন্তরের অ-সুরের বিলোপের পর কণ্ঠে আসে সুরের প্রকাশ। নম্র সুন্দর মৃদু মধুর বাকভঙ্গি পূর্ণ জ্ঞানের প্রকাশ। তাই বীণা তার প্রতীক। রুদ্র, হংস ইত্যাদি নানা বীণার মধ্যে সরস্বতীর বীণার নাম কচ্ছপী। সরস্বতী নদীর মতো বীণাও বর্তমানে লুপ্তপ্রায়। আসলে সরস্বতী অর্থাৎ জ্ঞানের পথটাই বর্তমানে সরু গলিতে পরিণত হয়েছে।
ভাল বনাম দুষ্ট সরস্বতী
ম্যাটার-অ্যান্টি ম্যাটার, পজিটিভ এনার্জি-নেগেটিভ এনার্জি, ইলেকট্রন-পজিট্রন— এরকম সব কিছুর মতো সরস্বতীর সঙ্গে আছেন তাঁর নেগেটিভ পার্ট দুষ্ট সরস্বতী। মানুষের জিভে সরস্বতী বসে মানুষের জ্ঞানের প্রকাশে সহায়তা করেন। দুষ্ট সরস্বতী বসলে কুকথা বেরিয়ে আসে। রামায়ণের গল্পে আছে রাবণের মেজ ভাই কুম্ভকর্ণের কথা। ব্রহ্মাকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করেন কুম্ভকর্ণ, ইচ্ছাবর চাইবেন ইন্দ্রাসন। এদিকে রাজপাট হারাবার ভয়ে ইন্দ্র সাহায্য চাইলেন দেবী সরস্বতীর কাছে। সরস্বতী তাঁর নেগেটিভ পার্টকে পাঠালেন কুম্ভকর্ণের জিভে, বেচারা ইন্দ্রাসন চাইলেন, উচ্চারণ হল নিদ্রাসন। কী নিদারুণ পরিহাস! দুষ্ট সরস্বতীর প্রভাবে এক মহাতপস্বী, বীর চরিত্র হয়ে গেলেন এক কমিক ক্যারেক্টার। আবার বিপরীতে, সরস্বতী সাধনায় কালিদাস হয়ে ওঠেন মহাকবি। এক কিংবদন্তি অনুযায়ী, অপমানিত কালিদাস প্রাণ বিসর্জনের জন্য এক সরোবরে গিয়েছিলেন। তখন দেবী সরস্বতী তাঁকে বিরত করেন। দেবীর কৃপায় কালিদাস একজন মহাপণ্ডিত হয়ে ওঠেন।
বাল্মীকি হওয়ার আগে ছিলেন দস্যু রত্নাকর। সাধনায় হলেন বাল্মীকি। সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। বাল্মীকির ললাটে আবির্ভূত হয়েছিলেন সরস্বতী। বাল্মীকির কণ্ঠে সরস্বতীর প্রভাবেই ‘মা নিষাদ’ শ্লোকটি ধ্বনিত হয়েছিল। সুপথ অনুসরণ করলে মানুষ সুন্দরভাবে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, সেই একই জিভে কুপথ দেয় কুবাক্য। মানুষের মন জয় করতে আজও লাগে সুনিপুণ বাগ্মিতা। তাই সরস্বতী পুজো সর্বত্র।
আজও আছে গোপনে
শুধু উত্তরে নয়, বাংলাতেও ছিল সরস্বতী নদী। ভাগীরথী নদীর একটি শাখানদী, যা ১৬ শতক পর্যন্ত সক্রিয় ছিল, কিন্তু বর্তমানে এর প্রায় অস্তিত্ব নেই। সপ্তম শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে সরস্বতীর উৎপত্তিস্থলে পলি জমতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে ষোড়শ শতক নাগাদ প্রায় শুকিয়ে যায়। সেই সরস্বতীর অবশেষ এখন নিতান্তই খাল, ক্ষীণজলের ধারা, দূষিত জলাশয় আকারে ত্রিবেণী থেকে বেরিয়ে কিছু পথ পার করে হারিয়ে গেছে প্রবাহপথ। একটি মজে যাওয়া শাখা হাওড়ার কাছে এখনও বইছে। তারপর বুজে গেছে অথবা আটকে গেছে জনগণেশের অভিশাপে।
পাঁচ হাজার বছর আগে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ায় না হয় বৈদিক সরস্বতী অবলুপ্ত হয়েছিল, বাংলায় সরস্বতীর অবসান সম্পূর্ণ অযত্নে, পলি পড়ে। সরস্বতী আসলে জ্ঞান। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানগরিমা, উপনিষদের দর্শন সময়ের সঙ্গে চাপা পড়েছে। বাংলার নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি সংস্কারের অভাবে অনুকরণপ্রিয়তে আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। তবুও হাজা-মজা পলি-পড়া কিংবা অন্তঃসলিলা ধারায় কোথাও আজও টিকে আছে প্রাচীন জ্ঞানগরিমা, কৃষ্টি সরস্বতী নামে।