আবেগের অন্য নাম লিটল ম্যাগাজিন

বইমেলার অলিখিত তাজ হল লিটল ম্যাগাজিনের নির্ধারিত অঞ্চল। আলাদা আবেগ, জোরালো অনেক অনুভূতির আশ্চর্য সহাবস্থান সেখানে। অবিচ্ছেদ্য সদর্প উপস্থিতি। বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের মহিমা, স্বাধিকার, সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য ও দর্শনের নতুন খোঁজ দিলেন মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

১৭৩১ সালে এডুয়ার্ড কেভ-এর ‘দ্য জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিন’ প্রথম মাসিক কাগজ। তিনি একাধারে এর প্রিন্টার-এডিটর ও পাবলিশার্স। এর আগে রিভিউ, পিরিওডিকাল, জার্নাল শব্দ ছেড়ে এই প্রথম ম্যাগাজিন শব্দের ব্যবহার। ‘দ্য ডায়াল, ট্রান্সসেন্ডেন্টালিস্টদের ত্রৈমাসিক জার্নাল, ১৮৪০ সালের জুলাই থেকে ১৮৪৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। ফুলার এবং রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসন দ্বারা সম্পাদিত তৎকালীন আমেরিকার সামাজিক ও সাহিত্য বিভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ডায়াল গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকান লেখকদের একটি সিরিজের ক্যারিয়ার শুরু করতে সাহায্য করেছিল। এটি এক অন্যধারার কম পুঁজির কাগজ। মার্গারেট অ্যান্ডারসনের ‘দ্য লিটল রিভিউ’কে প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে মনে করা হয়।
১৮৭২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন অবাণিজ্যিক ও অনিয়মিত বাংলা ভাষার প্রথম কাগজ। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রই বাংলার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই বৈপ্লবিক পরিবর্তন খেলাধুলােয় : ব্রাত্য

লিটল ম্যাগাজিন এক অনন্য মাধ্যম, যা সাহিত্যের প্রথাগত ধারা থেকে বেরিয়ে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন চিন্তাচেতনার জায়গা তৈরি করেছে। একাধারে সাহিত্যিক মুক্তির প্রতীক, সমাজের বিভিন্ন স্তরের গল্পের বাহক এবং সৃজনশীল চর্চার একটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। লিটল ম্যাগাজিন তার স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে সাহিত্য, শিল্প, দর্শন এবং সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
লিটল ম্যাগাজিনের ধারণা ও উৎপত্তি বিষয়ে বিবিধ মত। ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলতে বোঝানো হয় সেইসব ছোট পরিসরের সাহিত্য পত্রিকা যা মূলধারার বাণিজ্যিক প্রকাশনার বাইরে থেকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সাহিত্য ও সংস্কৃতির নতুন ধারা সৃষ্টি করে। এই প্রকাশনায় লোকপ্রলোভনের বিপরীতে স্বাধীনচেতা নতুন পাঠকের জন্য নতুন বিষয় ও মননের চর্চাই বিচার্য। প্রসঙ্গত, এ বিষয়ের আলোচনায় এসে যাচ্ছে একটি নাম, শ্রীবসন্ত জানা। কয়েক দশক আগে বাড়িতে পরিচারকের কাজ করতে কলকাতায় এসেছিলেন। ১৯৬৯ সাল নাগাদ এই সামান্য মানুষটি তাঁর স্বোপার্জিত সামান্য অর্থের বিনিয়োগে প্রকাশ করলেন ‘তিলোত্তমা’ পত্রিকা।
বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৩০-এর দশকে হলেও, ১৯৫০-এর দশক থেকে লিটল ম্যাগাজিন বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কবি ও লেখকেরা প্রচলিত ধারার সাহিত্য পত্রিকায় নিজেদের স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে না পারার কারণে লিটল ম্যাগাজিনের দ্বারস্থ হন। এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় লিটল ম্যাগাজিনের সাহসী ভূমিকা বাংলার ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে এটি নতুন শক্তি লাভ করে, এবং আজও এটি সাহিত্যচর্চার বিকল্প ধারা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
লিটল ম্যাগাজিনের মূল শক্তি হল এর প্রথাবিরোধী চরিত্র। এটি প্রথাগত সাহিত্য পত্রিকার মতো বিশাল আয়োজন বা প্রচারের উপর নির্ভর করে না বরং সৃজনশীলতার বিকল্প পথ খোঁজে। এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল :
স্বাধিকার ও স্বাধীনতা : লিটল ম্যাগাজিন লেখকদের প্রথাগত নিয়ম-কানুনের বাইরে গিয়ে সাহিত্যের নতুন দিক আবিষ্কার করার সুযোগ দেয়।
প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর : এতে সমাজের প্রান্তিক ও অবহেলিত মানুষের জীবনের গল্প উঠে আসে।
সাহসী চিন্তাধারা : লিটল ম্যাগাজিন রাজনীতি, সমাজ ও ধর্ম নিয়ে যে ধরনের কথা বলে, তা মূলধারার সাহিত্যে সহজে পাওয়া যায় না।
নতুন লেখকদের প্ল্যাটফর্ম : নবীন লেখকদের জন্য এটি সৃজনশীল চর্চার মুক্তক্ষেত্র।
সীমিত প্রকাশনা ও প্রচার : সাধারণত হাতে লেখা বা সীমিত সংখ্যায় মুদ্রিত হয় যা একে ব্যতিক্রমী করে তোলে।
লিটল ম্যাগাজিনের বড় ভূমিকা হল সমাজের প্রথাগত চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ করা। এটি বিভিন্ন সময় সমকালীন সামাজিক সমস্যা যেমন শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, দারিদ্র এবং মানবাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরে। লিটল ম্যাগাজিন বাংলা সংস্কৃতিকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ দেয়। লোকজ সংস্কৃতি, নাগরিক জীবন এবং ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব লিটল ম্যাগাজিনের বিষয়বস্তুতে উঠে আসে।
লিটল ম্যাগাজিন নারীর অধিকার ও কণ্ঠস্বর তুলে ধরার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। নারীবাদী সাহিত্য ও দর্শনের বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শিল্প ও সাহিত্যে লিটল ম্যাগাজিনের অবদান বিস্তৃত। লিটল ম্যাগাজিন কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধের মাধ্যমে সাহিত্যের বিকল্প ধারার সূচনা করে।
কবিতা ও গদ্যে আধুনিকতার বিস্তার ও প্রভূত পরীক্ষা নিয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার বিস্তার লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই শুরু হয়। জীবনানন্দ দাশ, শঙ্খ ঘোষ, মণীন্দ্র গুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উৎপলকুমার বসু, বীতশোক ভট্টাচার্য, জয় গোস্বামী, সুব্রত সরকার, গৌতম চৌধুরী, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম বসু, মৃদুল দাশগুপ্ত, রাহুল পুরকায়স্থ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রানা রায়চৌধুরী, প্রসূন ভৌমিক, রাজীব সিংহ, বিপ্লব চৌধুরী, হিন্দোল ভট্টাচার্য, পলাশ দে, যশোধরা রায়চৌধুরী, মিতুল দত্ত, চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো কবিদের কবিতা এসব ম্যাগাজিনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুন-কুম্ভ-দুর্ঘটনা নিয়ে সংসদে আলোচনা করতেই হবে, ফের সরব হলেন সুদীপ

লিটল ম্যাগাজিন গল্প ও প্রবন্ধের বিকল্প ধারা
লিটল ম্যাগাজিন গল্প ও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে প্রচলিত সাহিত্য কাঠামো ভেঙে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। এখানে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দর্শনের বিষয়গুলো সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়।
শিল্পকলার প্রকাশ : লিটল ম্যাগাজিন শুধুমাত্র সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি চিত্রকলা, নাটক এবং সিনেমার মতো শিল্পমাধ্যমের সঙ্গেও যুক্ত। অনেক লিটল ম্যাগাজিনে চিত্রশিল্পীদের কাজ প্রকাশিত হয়েছে।
দর্শন ও নতুন চিন্তাধারার খোঁজ : লিটল ম্যাগাজিন দর্শন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য। এটি প্রচলিত দার্শনিক ভাবনার বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তাধারা উন্মোচন করে।
মানবিক দর্শন : লিটল ম্যাগাজিনে মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।
পরিবেশবাদী দর্শন : প্রাকৃতিক পরিবেশের সংরক্ষণ এবং পরিবেশের প্রতি মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
নারীবাদী দর্শন : নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতার বিষয়ে লিটল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়।

শেষ তিন দশকের উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন
শূন্যদশক : ১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে ২০০০-এর দশক পর্যন্ত ‘শূন্যদশক’ নামের লিটল ম্যাগাজিনটি সাহিত্যের বিকল্প ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি তরুণ লেখকদের নিয়ে কাজ করেছে এবং তাঁদের নতুন ধারার সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
বিজল্প : নয়ের দশকে বিজল্প লিটল ম্যাগাজিনটি সাহিত্য, দর্শন এবং সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করেছে। নতুন লেখক কবি ও শিল্পীদের কমিউন বিজল্প। যেখানে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠতরাও সমাদৃত।
পশ্চিমবঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’, ‘অন্যথা’, ‘এবং চতুষ্কোণ’, ‘গান্ধার’, ‘ঐহিক’, ‘মাসিক কবিতা পত্র’, ‘সাম্পান’, ‘গহন’, ‘রাবণ’ ও বাংলাদেশের ‘লোক’ এবং ‘শালুক’ লিটল ম্যাগাজিনগুলো উল্লেখযোগ্য। সীমিত পরিসরের কারণে অনেক কাগজের কথা অনুল্লেখিত থেকে গেল।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ : লিটল ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আর্থিক সংকট। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হওয়ায় টিকে থাকা প্রতিদিন কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রচারের অভাব অন্য একটি কারণ। মূলধারার প্রকাশনার তুলনায় কম জনপ্রিয় হওয়ায় পাঠকসংখ্যাও সীমিত। এর সঙ্গে ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জও কম নয়।
ডিজিটাল যুগে মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনকে টিকে থাকার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যেতে হচ্ছে।
এসব সত্ত্বেও বাংলা লিটল ম্যাগাজিন তার স্বমহিমায় সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং দর্শনের বিকল্প ধারা সৃষ্টি করেছে। প্রথাগত সাহিত্য কাঠামো ভেঙে সমাজের প্রান্তিক মানুষ, নারী এবং তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হয়ে ধরা দিয়েছে। লিটল ম্যাগাজিনের সৃজনশীলতা এবং সাহসিকতা ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এটি আরও বিস্তৃত পরিসরে সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। ছবি : শুভেন্দু চৌধুরী

Latest article