দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটা বড় ভূমিকা পালন করে মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্ত শব্দটির উৎপত্তি ঔপনিবেশিক আমলে, ১৯ শতকের প্রথম দিকে মেট্রোপলিটন শহরে মধ্যবিত্ত শব্দটির উৎপত্তি খুব করে হয়েছিল। এই সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মধ্যবিত্তদের সম্প্রসারণ ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে বড় ভূমিকা রয়েছে। মধ্যবিত্তের ধারণাটি আরও স্পষ্ট করে যে, একটি শহুরে পরিবারে একজন গৃহিণী ক্রমবর্ধমান দামের মধ্যে সংসার চালানোর যুদ্ধ করে চলেছে, আর একজন উত্তেজিত ও সংসারের বোঝা বহনকারী সাধারণ মানুষ আরও একটু ভালভাবে বাঁচার জন্য দিনরাত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে অর্থনীতির চাকাকে সচল করে রেখেছে এই মধ্যবিত্তরা এবং বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, আগামী দশ বছরে মধ্যবিত্তদের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে চলেছে। তবে ক্রমবর্ধমান মুদ্রার অস্থিরতা এবং অবমূল্যায়ন ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় সরকারের করা এক আর্থিক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে ৬.৩ থেকে ৬.৮ শতাংশ। চলতি অর্থ বছরে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ তা হতে হবে ৬.৪ শতাংশ। আবার এই একই রিপোর্টে আশা করা হচ্ছে পরের দুই দশকে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি হতে হবে। পুরোটাই যেন ধোঁয়াশার।
২০৪৭-এর মধ্যে ভারতকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেখা হচ্ছে, তবে ততদিন পর্যন্ত মধ্যবিত্তদের স্ট্যাটাসটা বেঁচে থাকবে তো? চলতি অর্থ বছরে জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৪ শতাংশ, যা বিগত ২১ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। এবার আসা যাক সঞ্চয়ের পথে, মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ সঞ্চিত থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে এবং পেনশনভোগীদের সংসারের চাকা চলে সঞ্চিত অর্থের সুদের পরিমাণের ওপর। বিগত একদশক ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সেভিংসের সুদের হার তলানিতে ঠেকেছে। যদি কয়েকটি বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সুদের মাপকাঠি দেখি, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সেভিংসের সুদের হার ২.৭ শতাংশ (১০ কোটির নিচে) এবং ৩ শতাংশ (১০ কোটির ওপরে) যেখানে হোম লোনের সুদের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে শুরু। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সেভিংসের সুদের হার ২.৭৫ শতাংশ (১ লক্ষ টাকা পযন্ত) ও ২.৯ শতাংশ (১ লক্ষ টাকার ওপরে) যেখানে হোম লোনের সুদের হার ৮.৬ শতাংশ থেকে শুরু। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সেভিংসের সুদের হার ২.৭ শতাংশ (১০ লক্ষ টাকা পযন্ত) আর ২.৯ শতাংশ (১০ লক্ষ টাকার ওপরে) যেখানে হোম লোনের সুদের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে শুরু, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সুদের হারও কমবেশি একই প্রায়। সুতরাং সুদ দেওয়া এবং সুদ পাওয়ার ফারাকটা বিস্তর। সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা থেকে ঘুরে শেয়ার মার্কেটের দিকে গেছিল, কিন্তু তৃতীয় এনডিএ সরকার গঠনের পর থেকে শেয়ার মার্কেটও মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার মার্কেট থেকে মূলধন তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে দিন দিন শেয়ার মার্কেটে ধস অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় মার্কেট থেকে বিদেশের মার্কেটকে বিনিয়োগের অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছে। এই অর্থ বছরে বাজেট ঘোষণার সময়ও BSE sensex প্রায় ৫০০ পয়েন্ট, NIFTY 50 প্রায় ১৫০ পয়েন্ট ও Bank NIFTY প্রায় ৬০০ পয়েন্ট পড়েছে। সুতরাং এর থেকে স্পষ্ট শেয়ার বাজারও চলতি বাজেট ঘোষণাতে হতাশ। বিগত এক মাসে শেয়ার মার্কেটে ক্ষতি প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। অপরদিকে টাকার অবমূল্যায়নের জেরে মুদ্রাস্ফীতির অবস্থাও তথৈবচ। মুদ্রাস্ফীতি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি যখন দ্রব্যের দামস্তর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং অর্থের মূল্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। শেষ তিনটি মাসে অর্থাৎ অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার যথাক্রমে ৬.২১, ৫.৪৮ ও ৫.২২ শতাংশ। ৫ শতাংশের ওপরে গেলে যা সাধারণ মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। এবার দেখি ডলারের তুলনায় টাকার অবনমন, এই বছরে জানুয়ারি মাসের শেষে ১ ডলারের তুলনায় টাকার দাম ছিল ৮৬.৫৯ টাকা যা এই সময়ে ২০২৪-এ ছিল ৮২.৯৮ টাকা, সুতরাং এই এক বছরে ডলারের মূল্য বেড়েছে ৪.১৭ শতাংশ, যা অস্বাভাবিক। তার ফলে বিদেশি পণ্য কেনার খরচ বেড়েছে এবং স্বভাবতই সাধারণ মানুষকে অধিক মূল্যে জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন- এবার মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ও সুরে সরস্বতী বন্দনার গান
বিনিয়োগের আর একটি ক্ষেত্র হল সোনা, আর মধ্যবিত্তরা সোনা ধাতুর প্রতি একটু নরম। গৃহবধূ থেকে ব্যবসায়ীরা সোনা কেনার প্রতি বরাবরই আকর্ষণীয়, সেখানে দাঁড়িয়ে বিগত কয়েকবছরে সোনার দাম যে হারে বাড়ছে তাতে সোনা মিউজিয়ামে দাঁড়িয়ে দেখার মতো দ্রব্য হতে চলেছে। ২০২৪-এ যেখানে ২৪ ক্যারেট ১০ গ্রাম সোনার মূল্য ছিল ৬৫০০০ টাকার মতো, আজ ২০২৫-এ তার দাম ৮৫০০০ টাকার কাছে, অর্থাৎ এই এক বছরে সোনার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অন্যতম জায়গা ছিল বিমাক্ষেত্র, বাজেটে বিমাক্ষেত্রকেও সম্পূর্ণ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হল, এর ফলে বিমার খরচ আগামী দিনে যে বাড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা, সঞ্চয়ের ক্ষেত্র হিসেবে যে যে পথগুলি দেখত তার প্রতিটি ক্ষেত্রই হয়তো হাতের বাইরে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ। এই যে বাজেট পেশ হল, তাতে কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গেল, যেমন আয়করের মাত্রা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে মধ্যবিত্তদের আয়করের সুরাহা দেওয়া হল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতবর্ষে ক’টা মানুষের মাসিক বেতন ১ লক্ষ টাকা বা তার বেশি? যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত তাঁদের কি বাজার মূল্য অনুযায়ী সমানুপাতিক হারে বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে? আর যে হারে দ্রব্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সংসার খরচ করে কী পরিমাণ সঞ্চয় করবে তারা? আর সঞ্চয়ের অর্থ রাখবেই বা কোথায়? আগামী দিনে এই প্রশ্নগুলো সর্বদা এখন মানুষের মনে ঘুরপাক করবে।