অন্তরীক্ষে গ্রহের আশ্চর্য সংযোগ

নতুন বছরে মহাজাগতিক বিস্ময়ের যেন শেষ নেই, আকাশ গায়ে সারি দিয়ে বসেছে গ্রহদের পশরা— একই সঙ্গে খালি চোখে দেখা মিলছে অনেকগুলো গ্রহের, তাও আবার সুসজ্জিত! আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

গ্রহের বিরল সংযোগ
সূর্য আছে মাঝখানে, আলো ছড়ায় চারিদিকে। গ্রহগুলো ঘুরছে টানে, নাচছে সদাই আপন মনে। ওরা গতি মেপে আপন পথে চলে, নিয়ম মানে চক্র ধরে। ওই সৌরজগৎ নিয়ে পৃথিবীর মানুষের বিস্ময়ের শেষ নেই। খোলা আকাশের বুকে গ্রহ-তারাদের নানারকম খবর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয়, তবুও খালি চোখে আকাশ দেখার মজাই আলাদা। মিলিয়ন-বিলিয়ন মাইল দূরে, অন্ধকার রাতের আকাশে গ্রহ কিংবা ঝিকিমিকি তারাদের থেকে ছুটে আসা ফোটন যখন সরাসরি আমাদের রেটিনা স্পর্শ করে, সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়! এবারে সেই অনুভূতির বাঁধ ভেঙেছে— সূর্য ডোবার প্রায় ৪৫ মিনিট পর খালি চোখেই সূর্যের একপাশে দেখা মিলেছে চার-চারটি গ্রহ, টেলিস্কোপের সাহায্যে আড়ালে থাকা আরও দুটি গ্রহকে দেখা গেছে। একসঙ্গে একই তটে ছ’টি গ্রহ— শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, ও নেপচুনের এক বিস্ময়কর নৈসর্গিক সংযোগ!
শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি খালি চোখেই দেখা গেছে, তবে ইউরেনাস ও নেপচুনের জন্য টেলিস্কোপের সাহায্য লেগেছে। এই বিরল মহাজাগতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সাধারণ মানুষ একটুও পিছিয়ে থাকেননি, বহু জায়গায় আকাশ দেখার জন্য ক্যাম্পিং করা হয়েছে, এ-ব্যাপারে ছোট থেকে বড় সকলের উৎসাহের কমতি নেই! যেখানে আলোর দূষণ কম, আকাশ পরিষ্কার, সেখানেই এই ঘটনা ভালভাবে দেখা যায়। মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষায়, এই বিরল ঘটনাটিকে বলা হয় প্লানেটারি অ্যালাইনমেন্ট, সূর্যের একপাশে আকাশের একটি ছোট্ট পরিসরে একসঙ্গে সৌরজগতের অনেকগুলো গ্রহের বিরল সজ্জা! অনেকেই বলে থাকেন গ্রহগুলো নাকি এক সরলরেখায় অবস্থান করে, কিন্তু একথা সত্য নয়, তাদের একটি রেখা দিয়ে যোগ করা গেলেও তা সরলরেখা নয়। ত্রিমাত্রিক দশায় গ্রহদের পূর্ণ সংযোগ সম্ভব নয়, তবে আকাশের ৯০ ডিগ্রি পরিসরে এইপ্রকার একাধিক গ্রহের সজ্জা বিরল। বর্তমান সহস্রাব্দে এইরকম ঘটনা মাত্র সাতবার ঘটেছে।
সন্ধ্যার আকাশে এই দৃশ্য দেখার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে ২১ জানুয়ারি সাধারণ তারিখ হিসেবে ধরা হয়েছিল, তবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সময়ের তারতম্যে বিভিন্ন দিনে মানুষের চোখে ধরা দিয়েছে এই বিরল বিস্ময়। আকাশের ১৬৯ ডিগ্রি পরিসরে ১৮ জানুয়ারি আবুধাবিতে, ওই দিনই ১৭২ ডিগ্রি পরিসরে হংকং-এ, ২১ জানুয়ারি টোকিওতে ১৫৭ ডিগ্রি পরিসরে, ১৫২ ডিগ্রি পরিসরে ২২ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কে, এবং ২৩ জানুয়ারি ১৫৫ ডিগ্রি পরিসরে এথেন্সেও এই ছবি ফুটে ওঠে। আমাদের ভারতবর্ষে ২৫ জানুয়ারি এই বিরল প্রদর্শনী প্রাপ্ত হয়। বিজ্ঞানীদের আশানুরূপ, ২৬, ২৭, এমনকী ৩১ জানুয়ারিও এই দৃশ্য দেখা যায় আকাশপটে।

আরও পড়ুন-শিক্ষক-কবির উদ্যোগে বাংলা মন্ত্রে আরাধনা হল বাগদেবীর

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
সৌরজগতের সকল গ্রহ সূর্যের চারিদিকে নির্দিষ্ট বেগ ও দূরত্বে নির্দিষ্ট একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সবসময় ঘুরছে। এই নিরন্তর গতিশীলতার মধ্যে কখনও কখনও এমন একটি ক্ষণ আসে, যখন পৃথিবী থেকে তাদের অবস্থানগুলো দেখে মনে হয় গ্রহগুলো যেন একটি রেখায় যুক্ত। এই ঘটনা সচরাচর ঘটে না, কেননা প্রতিটি গ্রহের গতিবেগ এবং কক্ষপথের দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। একসঙ্গে ছ’টি গ্রহের এইরূপ সংযোগ সত্যিই বিরল! এটি গ্রহদের কক্ষপথীয় কারিগরি, জ্যোতির্বিদ্যায় প্লানেটারি অ্যালাইনমেন্ট। দেখতে গ্রহগুলোকে কাছাকাছি মনে হলেও তারা একে অপরের থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত। আকাশের বুকে এই জাতীয় আকস্মিক গ্রহীয় সংযোগ শুধুমাত্র একটি মনকাড়া দৃশ্যের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। যখন ৩টে গ্রহের সংযোগ দেখা যায় তখন মিনি, ৪টের সংযোগকে স্মল, ৫-৬টার সংযোগকে লার্জ, এবং একত্রে সৌরজগতের সব ক’টি গ্রহের সংযোগকে গ্রেট বা ফুল প্লানেটারি অ্যালাইনমেন্ট বলা হয়।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি, বুধ গ্রহ আকাশের কোণে এই সংযোগে অংশগ্রহণ করবে, এবং একসঙ্গে সন্ধ্যায় সাতটি গ্রহের সুবিন্যাস আমরা দেখতে পাব। বুধ, শুক্র, বৃহস্পতি, ও মঙ্গল গ্রহকে খালি চোখে দেখা যাবে। একজোড়া বাইনোকুলার কিংবা টেলিস্কোপের সাহায্যে ইউরেনাস ও নেপচুনকে, তবে শনিকে পর্যবেক্ষণ করা একটু কষ্টকর হলেও হতে পারে। এই গ্রেট প্লানেটারি অ্যালাইনমেন্ট ফেব্রুয়ারির ২২শে টোকিওতে, ২৫শে মেক্সিকো ও নিউইয়র্কে, ২৭শে হংকং-এ, আবার মার্চের দু’তারিখ বার্লিন ও লন্ডনে, ৩ তারিখ সিডনিতে, ৪ তারিখ সাও পাওলোতে, এবং ৮ তারিখ আমাদের দেশেও দেখা যাবে। এছাড়াও আগামী ১৫ এপ্রিল সকালের আকাশে বুধ, শুক্র, শনি ও নেপচুনের স্মল অ্যালাইনমেন্ট এবং ১১ অগাস্ট বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের একটি লার্জ মর্নিং অ্যালাইনমেন্ট আমাদের চোখে দৃশ্যমান হবে বলেই বিজ্ঞানীদের অনুমান।

আরও পড়ুন-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর উসকানির অডিও নিয়ে দ্রুত ফরেনসিক রিপোর্ট চাইল সুপ্রিম কোর্ট

অপবিজ্ঞান নয় বিজ্ঞান
নিসর্গবিদরা গবেষণা করে দেখেছেন, আগামী ২০৪০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ খালি চোখে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি গ্রহের সংযোগ দেখা যাবে। আবার ২০৮০ সালের ১৫ মার্চ নাকি নেপচুন বাদে বাকি ছ’টি গ্রহের সজ্জা সকালের আকাশে ফুটে উঠবে। সেদিন নাকি ১৯ মে, ২১৬১ সাল, যেদিন পৃথিবী-সহ সৌরজগতের সব ক’টি গ্রহই সূর্যের একপাশে একটি নির্দিষ্ট অ্যালাইনমেন্টে অবস্থান করবে। এ সবকিছুই বিজ্ঞান— কোনও কিছুই কাকতালীয় নয়! তবে সমাজমাধ্যমে অনেকক্ষেত্রেই এই প্রকার প্লানেটারি অ্যালাইনমেন্টকে প্লানেটারি প্যারেড আখ্যা দেওয়া হয়েছে। রটানো হচ্ছে নানা গুজব। অপবিজ্ঞানের কারসাজিতে তৈরি করা হচ্ছে নানারকম ভয়। রটছে ভিত্তিহীন বিপদের সম্ভাবনা-তত্ত্ব।
এই প্রকার বিরল সংযোগ বিজ্ঞানীদের জন্য একটি দারুণ সুযোগ। এআই এবং মেশিন লার্নিং-এর মতো প্রযুক্তির সাহায্যে সৌরজগৎ, আন্তঃগ্রহীয় ক্রিয়া, সংকেত, জোয়ার-ভাটার টান প্রভৃতি সম্পর্কে সূক্ষ্ম ও মূল্যবান তথ্য পেতে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা মরিয়া। ভবিষ্যতে এইসব প্রাপ্তি হয়তো মহাশূন্যের কোনও এক নতুন কমিউনিকেশন টেকনোলজির জন্ম দেবে, কে বলতে পারে! তবে স্যোশাল মিডিয়ায়, এই বিরল সংযোগের জন্য পৃথিবীতে ঝড়, ভূমিকম্প কিংবা সুনামির মতো দুর্যোগ দেখা দিতে পারার যে অপপ্রচার চলছে, তার কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। নেচার পত্রিকায় প্ল্যানেটরি অ্যালাইনমেন্ট, সোলার অ্যাক্টিভিটি, টাইডাল পুল, ক্লাইমেটিক চেঞ্জের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলেও তার প্রমাণসাপেক্ষ সম্ভাবনা এখনও মেলেনি। তাই কোনওরকম দুশ্চিন্তা ছাড়া, এই বিরল সৌন্দর্য উপভোগ করাই কাম্য।

Latest article